ভাগ্য নাকি সাহসীদের পক্ষে থাকে। তাহলে এই ম্যাচে আফগানিস্তানের জেতাটা ঠিকই আছে। সাহস বলে যদি কিছু থাকে, তা তো শুধু আফগানরাই দেখিয়েছে। বাংলাদেশ দলকে এমনিতেই কখনো কেউ সাহসী বলে ‘অপবাদ’ দিয়েছে বলে খুব একটা শোনা যায়নি। এদিন তো দেওয়ার প্রশ্নই নেই। আফগানিস্তান জিতেছে, ঠিকই আছে।
আফগানিস্তানই সম্ভাবনার একটা দুয়ার খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের জন্য। তা যে এতটা বাস্তব হয়ে উঠবে, এতটাই করে ফেলার মতো—সেটি আসলেই কল্পনা করা যায়নি। পুরো বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের বোলাররা আলো ছড়িয়েছেন। এদিন তারা আরও দারুণ। সেমিফাইনালে ওঠার দৌড়ে আফগানিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশকেও শামিল করে দেওয়ার কৃতিত্বটা পুরোপুরিই রিশাদ-তাসকিনদের।
১২.১ ওভারে ১১৬ করে ফেলা কোনো উইকেটেই বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। সেন্ট ভিনসেন্টের এই উইকেটে তো আরও না। তা যতই বৃষ্টির পর বল ভালোমতো ব্যাটে আসুক না কেন! প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের হারানোর কী ছিল! করতে পারলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। এত বড় একটা অর্জনের হাতছানি। এর পেছনে ছুটতে গিয়ে ৫০ রানে অলআউট হয়ে গিয়ে গোহারা হারলেই বা কী আসে যায়! পুরো ২০ ওভার খেলে জিতলেও বিদায়, ১২.১ ওভারের মধ্যে জিততে না পারলেও বিদায়। তাহলে কোনটা আরাধ্য হওয়া উচিত, এ নিয়ে কোনো দ্বিধাই থাকার কথা নয়।
এই পরিস্থিতিতে পড়লে আফগানিস্তান নির্ঘাত এমনই ভাবত। আর বাংলাদেশ কী করল? আস্কিং রেটের সঙ্গে কিছুক্ষণ পাল্লা দেওয়ার পর দ্রুত কয়েকটা উইকেট পড়তেই রণে ভঙ্গ। শুরু হয়ে গেল কোনোমতে ম্যাচটা জেতার চেষ্টা। যেন এই একটা ম্যাচে জয় নিয়ে দেশে ফিরতে পারলেই এই বিশ্বকাপ একেবারে সুজলা-সুফলা হয়ে যায়। এ করতে গিয়ে তো শেষ পর্যন্ত আমও গেল, ছালাও গেল। সাহস না থাকলে এমনই হয়।
সেমিফাইনালে উঠতে তখন ২৩ বলে ৫১ রান করতে হতো বাংলাদেশকে। ওভারপ্রতি ১৩ রানের মতো। অবশ্যই কঠিন। তবে কঠিন হলেও অসম্ভব তো নয়। সেই প্রশ্নটাই আবার আসছে—আপাত অসম্ভব হলেও কি তা করার চেষ্টা থাকবে না? হলে হবে, না হলে নাই। তা করতে গিয়ে হেরে গেলেই বা কী আসে যায়!
সেন্ট ভিনসেন্টের উইকেটের কথা বলছিলাম। এই মাঠে বিশ্বকাপের আগের ম্যাচগুলোর কথা মনে রাখলে ১২,১ ওভারে ১১৬ রান করে ফেলার কথা ভাবাটা অবশ্যই অনেক সাহসের ব্যাপার। কিন্তু এদিন যা পরিস্থিতি, তাতে পরিকল্পনা করে সাহসী হওয়ার কী আছে? আর কোনো বিকল্প তো থাকারই কথা নয়। ব্যাটিংয়ে নামার সময় মন্ত্র হওয়া উচিত ছিল একটাই— ১২.১ ওভারেই জেতার জন্য জীবন দিয়ে দেব। তাতে যদি হেরে যাই তো হেরে যাব। কী আসে যায়!
অমন ভাবতেই মনে হয় একটু সাহস লাগে। আফগানিস্তানের যে তা আছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারোরই। সুপার এইটে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের যে অ্যাপ্রোচ, তাতে ওটা আছে বলেও কেউ সন্দেহ করেনি। কিন্তু তাই বলে এই দিনেও না! মাত্র একটা ম্যাচ জিতেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে যাওয়ার সুবর্ণ একটা সুযোগ এসে গেছে পাকেচক্রে, সেটিকে কাজে লাগানোর প্রাণপণ চেষ্টা হবে না! ১৯ বলে যখন ৪৩ রান লাগে, তখন মাহমুদউল্লাহ একটা পুরো ওভার খেলে ৫টি বলই ডট দেবেন! যা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে!
নেমেছেন তাওহিদ হৃদয় আউট হওয়ার পর। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র হৃদয়ের ব্যাটেই শোনা গেছে টি-টোয়েন্টির সুর। যে সাহস নিয়ে শুরুতেই এত কথা, সেই সাহসের প্রতিফলনও একমাত্র তাঁর ব্যাটিংয়েই। এদিনও যে ৭ মিনিটই ছিলেন উইকেটে, তাতেও ওই তাওহিদ হৃদয়।
৮ বলে ১৪ করার পর নবম বলে হৃদয় আউটও হয়েছেন অ্যাটাকিং শট খেলেই। সেমিফাইনালে উঠতে তখন ২৩ বলে ৫১ রান করতে হতো বাংলাদেশকে। ওভারপ্রতি ১৩ রানের মতো। অবশ্যই কঠিন। তবে কঠিন হলেও অসম্ভব তো নয়। সেই প্রশ্নটাই আবার আসছে—আপাত অসম্ভব হলেও কি তা করার চেষ্টা থাকবে না? হলে হবে, না হলে নাই। তা করতে গিয়ে হেরে গেলেই বা কী আসে যায়!
অথচ তখন নেমে মাহমুদউল্লাহ কী করলেন! ৯ বলে ৬ রান। একটা চার আর দুটি সিঙ্গেল। বাকি ছয় বলই ডট। এর মধ্যে এক ওভারেই ৫টি। বাংলাদেশ ম্যাচে হেরেছে আরও অনেক পরে। তবে আসল হারটা তো তখনই হয়ে গেছে।
মাহমুদউল্লাহর ওপর রাগ করবেন কী, বাংলাদেশ দলই তো এর অনেক আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেমিফাইনালের মতো ওসব তুচ্ছ ব্যাপারে না ভেবে নিরাপদে জয়ের চেষ্টা করাই ভালো। তাওহিদ হৃদয় যে অমন ব্যাট চালিয়েছেন, সেটি তাঁর সহজাত তাড়না থেকে। সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন তো জানিয়েই দিলেন, ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরই তারা মাথা থেকে সেমিফাইনালের চিন্তা দূর করে দিয়েছেন। হাততালি দিন ভাই, হাততালি দিন।
এক ম্যাচে যেন খেলেছে তিন দল! মাঠে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান, আর মাঠের বাইরে এ নিয়ে মহা টেনশনে অস্ট্রেলিয়া।
খেলার নাটকীয়তার সঙ্গে বৃষ্টি যোগ হয়ে আশ্চর্য এক দিন গেল। আসলে তো দিন নয়, রাত। রাত বললেও শুধু হচ্ছে না, গভীর রাত। সেন্ট ভিনসেন্টের সময় রাত ১টারও বেশ পরে খেলা শেষ হয়েছে। রশিদ খান যখন সাইমন ডুলের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে দেশবাসীর উদ্দেশে পশতুতে কী যেন বলছেন, তখন দেড়টার বেশি বাজে।
বেশি রাতে সবকিছুই একটু অন্যরকম লাগে। আর এই ম্যাচটা এমনিতেই ছিল অন্যরকম। এক ম্যাচে যেন খেলেছে তিন দল! মাঠে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান, আর মাঠের বাইরে এ নিয়ে মহা টেনশনে অস্ট্রেলিয়া। প্রথমে যারা বাংলাদেশের অমঙ্গল কামনা করেছে। বাংলাদেশ যেন ১২.১ ওভারে জিতে যেতে না পারে।
বাংলাদেশের ব্যাটিং তাদেরকে আশ্বস্ত করার পর মিচেল মার্শরা পারলে বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নেমে পড়েন। পরাজয়টাও হয়তো বাংলাদেশের চেয়েও অস্ট্রেলীয়দের বুকেই বেশি বিঁধেছে। এই পরাজয়ে বাংলাদেশের কীই-বা এমন ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি যা হয়েছে তা তো অস্ট্রেলিয়ারই।
নাজমুলদের ওপরে আপনি আর কী রাগ করছেন, এর চেয়েও বেশি রাগ মনে হয় মিচেল মার্শের!