বদলের হাওয়ায় উড়ছে জিম্বাবুয়ে
বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা গেল জিম্বাবুয়ে দলে। আগের মাসেই বুলাওয়েতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলটার ক্রিকেটারদের মধ্যে আটজনই নেই শেষ ম্যাচের দলে। জিম্বাবুয়ের ১৫ জনের দলে একঝাঁক নতুন ক্রিকেটারের ভিড়। স্থানীয় এক সাংবাদিক খেলোয়াড়দের নামগুলো দেখে তো দলটাকে ‘বি টিম’ই বলে দিলেন।
এ তো গেল শুধু শেষ ম্যাচের কথা। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেই জিম্বাবুয়ের হয়ে অভিষেক হয়েছে চার ক্রিকেটারের, টি-টোয়েন্টিতে একজনের। কৌতূহলটা এখানেই—জিম্বাবুয়ে হঠাৎ এত নতুন ক্রিকেটার পেল কীভাবে! উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে এল বদলে যাওয়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ঘরোয়া খেলার কাঠামোটাই।
২০২০ সালে দেশের সেরা ৯টি ক্লাব নিয়ে একটি ৪৫ ওভারের টুর্নামেন্ট চালু করে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড। ৩৬ ম্যাচের টুর্নামেন্টের নাম ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লিগ (এনপিএল)। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান তাভেঙ্গওয়া মুকুহলানি টুর্নামেন্ট উদ্বোধনের দিন ক্লাব ক্রিকেট ফিরিয়ে আনার কথা বলছিলেন, ‘জাতীয় দলই একটা দেশের ক্রিকেটের সব নয়।
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে যে ভবিষ্যৎটা এনে দিতে চাই, সেখানে পাইপলাইন থাকবে সমৃদ্ধ। সেটা ক্লাব ক্রিকেট থেকেই শুরু হতে হবে। শক্তিশালী ক্লাব ক্রিকেট প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের সমস্যার সমাধান করবে। আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ঠিক হলে জাতীয় দলে সমস্যা থাকবে না। আমরা এত দিন জাতীয় দল নিয়েই ভেবেছি, জাতীয় দলে কীভাবে ক্রিকেটার আসবে, সেটা নিয়ে নয়।’
এরপর মাত্র দুই বছরে পাল্টে গেল সবকিছু। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক চামু চিবাবা বলছিলেন, ‘এনপিএলের কারণে অনেক ক্রিকেটার ক্রিকেটে থাকছে। এরপর যাচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে, যেটা জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। ছেলেরা এখন অনেক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এটা আগে ছিল না।’
জিম্বাবুয়ের সেরা ক্লাবগুলোই খেলে এনপিএলে। সবাই চায় এতে নাম লেখাতে। এখানে খেললেই ঘরোয়া ক্রিকেটের পরের ধাপে যাওয়া যায়। সে কারণে টুর্নামেন্টটা বেশ প্রতিযোগিতাপূর্ণও। ক্লাব, ক্রিকেটার—সবাই চান এনপিএলে জায়গা করে নিতে। এই টুর্নামেন্টে খেলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও।
রিচার্ড এনগারাভা, ভিক্টর নিয়াউচি, টনি মুনইয়ঙ্গো, জন মাসারা, ব্র্যাড ইভান্সরা উঠে এসেছেন এনপিএল খেলেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করা ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন। অথচ দুই বছর আগেও এটা ছিল না জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে। নির্বাচক, কোচ, অধিনায়কের স্বাধীনভাবে দল সাজানোর সুযোগ ছিল না। নতুন বোর্ড ক্রিকেটীয় কাজগুলো ক্রিকেটের লোকজনের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে এনেছে ডেভ হটনকে। প্রথম শ্রেণির ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে গত বছর দুজন করে বিদেশি ক্রিকেটার খেলানোর নিয়ম চালু করেছেন তিনি। ছয় দলের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এখন ইংলিশ কাউন্টির ক্রিকেটাররাও খেলছেন। স্বাভাবিকভাবে তাতে খেলার মানও বাড়ছে।
জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণি ও ক্লাব ক্রিকেটের নিয়মিত পেসার ব্রাইটন ঝায়োই সেটাই বলছিলেন, ‘ডেভ (হটন) বিদেশি ক্রিকেটারদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ফিরিয়েছে। সবার বিশ্বাস আগামী মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আরও ভালো হবে। ক্লাব ক্রিকেট যেহেতু ভালো হচ্ছে, বাকিটাতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ, একটা ছোট্ট ক্লাবেরও এখন সুযোগ আছে রোববারের ভর্তি গ্যালারির সামনে ভালো খেলে আলোচনায় আসার, আগে যেটা ছিল না।’
কয়েক দিন আগে ডেভ হটনকে জাতীয় দলেরও প্রধান কোচের দায়িত্ব দিয়েছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটের বদলের হাওয়াটা তিনি জাতীয় দলেও নিয়ে এসেছেন। ক্রিকেটারদের স্বাধীনভাবে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মাঠের বাইরের চাপ সরিয়ে ওড়ার সাহস জোগাচ্ছেন। সিরিজ চলাকালীন দলের অনুশীলনের ধরনও পাল্টে ফেলেছেন তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের সময় যেমন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটারদের অনুশীলনের চেয়ে বেশি ছিল বিশ্রাম। অনুশীলনের দিনগুলোতেও ছিল না বাঁধাধরা ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং করা। ব্যাপারটা যেন এমন, ক্রিকেটাররা যা খুশি করবেন, তাতে কোচের কিছু যায় আসে না। মাঠে পারফর্ম করলেই হলো।
কিন্তু হটনের জাতীয় দলের সঙ্গে থাকার কোনো ইচ্ছাই নেই। তাঁর ইচ্ছা জিম্বাবুয়ের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করা। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন সেটাই।
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার শুরুটা হয়তো সেখান থেকেই। জাতীয় দলের সঙ্গে থাকাটাই যেখানে সব কোচের স্বপ্ন, সেখানে হটন ভাবছেন অন্যভাবে। আর সে কারণেই দেশের ক্রিকেট নিয়ে অন্যভাবে ভাবাতে পারছেন জিম্বাবুয়ের সবাইকে।