ড্রেসিংরুমে ‘দ্বন্দ্ব’ থেকে ভিসা জটিলতা—বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তান দলে হচ্ছেটা কী
আর কিছু কী আছে বাকি!
পাকিস্তান ক্রিকেটের সমর্থকেরা বিশ্বকাপের আগে হয়তো দলের উদ্দেশ্য এই প্রশ্নটাই করবেন। বিশ্বকাপের আগে যেখানে দলগুলোকে মানসিকভাবে স্বস্তিতে রাখার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তান ক্রিকেটে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক অস্বস্তিকর ঘটনা। সেই ঘটনাগুলোর দায় অবশ্য পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সামান্যই, বরং নিজেদের ভুক্তভোগীই দাবি করতে পারেন তাঁরা। তবে এই ঘটনাবহুল সময়ের ভুক্তভোগী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ক্রিকেটই হতে পারে।
হাইব্রিড মডেল ও বিশ্বকাপে যাওয়া না–যাওয়া
সেই এশিয়া কাপ থেকে শুরু পাকিস্তান ক্রিকেটের টানাপোড়েন। পাকিস্তানের মাটিতে এশিয়া কাপ হওয়া না–হওয়া নিয়ে তো আর দ্বন্দ্ব কম হলো না। ভারত পাকিস্তানে যেতে রাজি না হওয়ার জেরে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পাকিস্তানকে ছাড়া এশিয়া কাপ আয়োজনের আলোচনা পর্যন্ত উঠেছিল। শেষমেশ এশিয়া কাপবিষয়ক জটিলতার সমাপ্তি ঘটে হাইব্রিড মডেলে টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। এশিয়া কাপ নিয়ে ভারতের অনড় সিদ্ধান্তের কারণেই কি না পাকিস্তানও ভারতে বিশ্বকাপ খেলার সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখেছিল অনেক দিন। শেষ পর্যন্ত গত মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাবে পাকিস্তান। তবে ভারতের মাটিতে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা নিয়ে জোরালো উদ্বেগ জানিয়ে রাখে তারা। বিশ্বকাপের মাত্র দুই মাস আগে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা নিশ্চয়ই কোনো দলকে স্বস্তিতে রাখার কথা নয়।
আহমেদাবাদ স্টেডিয়াম ও সূচি বদল
বিশ্বকাপের সূচি চূড়ান্ত করার আগে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম নিয়ে অস্বস্তির কথা জানিয়ে রেখেছিল পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। মূলত আহমেদাবাদের অবস্থান ভারতের যে অঞ্চলে, সেখানে পাকিস্তান দলের জন্য সার্বিক পরিবেশ বেশি প্রতিকূল থাকবে বলে ধারণা পিসিবির। তবে পাকিস্তানের অস্বস্তি পাশ কাটিয়ে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামেই ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ রাখে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই। শুরুতে ম্যাচটি ১৫ অক্টোবর হওয়ার কথা থাকলেও ধর্মীয় উৎসবের কারণে এক দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান ‘হাইভোল্টেজ ম্যাচটি হবে ১৪ অক্টোবর।
এশিয়া কাপে ভরাডুবি
বহুল আলোচিত এশিয়া কাপে পাকিস্তান গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ওই সময় ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর দলও ছিল তারাই। কিন্তু বাবর আজমের দল এশিয়া কাপ শেষ করেছে সুপার ফোর পয়েন্ট তালিকার তলানিতে থেকে। এর সঙ্গে যোগ করুন ভারতের বিপক্ষে ২২৮ রানের রেকর্ড ব্যবধানে হার। বাবররা সুপার ফোরে জিততে পারেননি চোটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও। পুরো এশিয়া কাপে পাকিস্তানের জয় শুধু বাংলাদেশ ও নেপালের বিপক্ষে।
নাসিম শাহর চোট
এশিয়া কাপের ব্যর্থতার ধাক্কা হয়তো বাববরা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, কিন্তু বিশ্বকাপে নাসিমের শূন্যতা কি পূরণ হবে! বোধ হয় না। কারণ, নতুন বলে ২০ বছর বয়সী এই পেসারই দলের মূল বোলার হয়ে উঠেছিলেন। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে কাঁধে চোট পাওয়া এই ফাস্ট বোলার দীর্ঘ সময়ের জন্য মাঠের বাইরেই ছিটকে গেছেন। বিশ্বকাপে তাঁর জায়গায় ডাকা হয়েছে হাসান আলীকে।
দলে দ্বন্দ্বের গুঞ্জন
এশিয়া কাপে ভরাডুবির পর পাকিস্তান ড্রেসিংরুমেও দ্বন্দ্বের গুঞ্জন শোনা গেছে। তাও দলের দুই মূল ক্রিকেটারদের মধ্যে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর টিম মিটিংয়ে বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন অধিনায়ক বাবর আজম ও ফাস্ট বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি। ড্রেসিংরুমে অধিনায়ক বাবর বলেছেন, তাঁর দলের খেলোয়াড়েরা দায়িত্ব নিয়ে খেলছেন না। এর জবাবে নাকি আফ্রিদি বলেছেন, ‘অন্তত যারা ভালো ব্যাটিং ও বোলিং করেছে, তাদের কৃতিত্ব দাও।’ এর জবাবটা বাবর দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি জানি কে ভালো পারফর্ম করেছে!’ দুজনের এই বিতণ্ডা থামান উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ রিজওয়ান। যদিও শাহিন আফ্রিদির বিয়ের অনুষ্ঠানে একসঙ্গে বাবর, শাহিন আফ্রিদির ছবি পাকিস্তানি সমর্থকদের কিছুটা নিশ্চিন্ত করতে পারে।
রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে প্রস্তুতি ম্যাচ
২৯ সেপ্টেম্বর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে পাকিস্তান। যে ম্যাচ বাবরদের খেলতে হবে রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে। কারণটা মোটেও সাদামাটা নয়—বাবরদের নিরাপত্তা। মূলত একাধিক ধর্মীয় উৎসবের কারণে পাকিস্তান দলকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়—কয়েক দিন আগে এমন জানিয়ে দিয়েছিল ভারতের তেলাঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ পুলিশ। সে কারণেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচটা রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে খেলবে পাকিস্তান। এর আগে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কাছে সূচি বদলানোর অনুরোধ জানিয়েছিল হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এইচসিএ)। বিসিসিআই সে অনুরোধ রাখতে পারেনি।
পাকিস্তান দলের ভিসা জটিলতা
আগামী সোমবার দুবাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের। উদ্দেশ্য ছিল ভারতে যাওয়ার আগে দুবাইয়ে সময় কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে দলীয় ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করা। বিশেষ করে এশিয়া কাপে ব্যর্থতার পর বিশ্বকাপের আগে নিজেদের মনোযোগ ঠিক রাখতেই দুবাইয়ে পুরো দলকে একত্র করতে চেয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। তবে সেটা আর হলো কই? পাকিস্তান এখনো তাদের ভারতযাত্রার ভিসা হাতে পায়নি। ভিসা বিলম্বে এলে দুবাইয়ে আটকা পড়ে যেতে হবে ভাবনায় শেষ পর্যন্ত প্রাক্–টুর্নামেন্ট সেশন বাতিল করতে হয়েছে। জানা গেছে, বাবর আজমের নেতৃত্বাধীন দল আগামী বুধবার দুবাই হয়ে বৃহস্পতিবার হায়দরাবাদে পৌঁছাবে।
বয়কট–হুমকি
বিস্ময়কর হলেও সত্য, পাকিস্তান ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সই না করেই। বোর্ডের দেওয়া সুবিধা খুব একটা পছন্দ না হওয়াতেই এখনো বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করেননি পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। এর প্রতিবাদে নাকি বিশ্বকাপের আগে কোনো একটা পদক্ষেপও নিতে পারেন ক্রিকেটাররা। আপাতত তাঁরা বিশ্বকাপের সময় জার্সিতে স্পনসরের লোগো না পরার কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ক্রিকেট পাকিস্তান।
সব মিলিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেটে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এত আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্কের মধ্যে কি বিশ্বকাপে নিজেদের সেরাটা খেলতে পারবে বাবর আজমের দল? উল্টোভাবে ভাবলে, কে জানে এই আলোচনা–বিতর্কই আবার পাকিস্তানকে জ্বলে উঠতে উসকে দেয় কি না!