রোহিত গুরুনাথ শর্মার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার রাতের গল্পটা তো লেখা হয়েছিল এই মাঠেই। ভারত বিশ্বকাপ জিতেছে, আতশবাজি ফুটছে, সেই রোশনাইয়ে আলোকিত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ২৮ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে উন্মাতাল পুরো দেশ। রোহিত শর্মা তখন কী করছিলেন?
১২ বছরের আগের কাহিনি। যেটিতে এখন তিনি ঢুকতেই চান না। ২০১১ বিশ্বকাপের আগেও ভারতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন। থাকার কথা ছিল বিশ্বকাপ দলেও। এই কদিন আগেই ওই সময়ের এক নির্বাচক শেষ মুহূর্তে রোহিত শর্মার বাদ পড়ার নেপথ্য কাহিনি খুলে বলেছেন। নির্বাচকদের বেছে নেওয়া ১৪ জনের ব্যাপারেই একমত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। শুধু রোহিত শর্মার বদলে তিনি চান লেগ স্পিনার পীযূষ চাওলাকে। অধিনায়ক যখন চাইছেন, তা তো মেনে নিতেই হবে।
সেদিন ভেঙে পড়া রোহিত শর্মার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন যুবরাজ সিং। এমন কি আর বয়স তোমার, আরও কত বিশ্বকাপ খেলবে—যদিও এ কথায় তখন সান্ত্বনা পাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নয় রোহিতের। সেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আজ বিশ্বকাপ ফাইনালের ঠিক আগের ধাপে দাঁড়িয়ে রোহিত শর্মা। দুটি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে এর আগেই। যার একটিতে এমন এক কাণ্ড করে রেখেছেন, কুইন্টন ডি কক আরেকটি সেঞ্চুরি করে না ফেললে আরও চার বছর যা রেকর্ড হয়েই থাকবে। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৫ সেঞ্চুরির সেই আনন্দ ম্লান হয়ে দিয়েছিল যে দল, সেমিফাইনালে আজ সামনে সেই নিউজিল্যান্ড এবং রোহিত শর্মা ভারতের অধিনায়ক।
যে অধিনায়কত্ব তিনি নিতেই চাননি। সৌরভ গাঙ্গুলী তখন ভারতের বোর্ড সভাপতি। মহাবিতর্কের জন্ম দিয়ে বিরাট কোহলির অধিনায়কত্ব-অধ্যায় শেষ হয়েছে। যে বিতর্কে জড়িয়ে গেছেন সৌরভ নিজেও। কোহলির উত্তরসূরি হিসেবে অবশ্যম্ভাবী পছন্দ রোহিত শর্মা। দলের তারকা খেলোয়াড়দের একজন, আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসকে একের পর এক শিরোপা জিতিয়ে অধিনায়ক হিসেবেও চিনিয়েছেন নিজেকে। এরপরের ধাপটাই তো হওয়ার কথা ভারতের অধিনায়কত্ব। কিন্তু রোহিত শর্মা মাথায় এই কাঁটার মুকুট পড়তে রাজি নন। অনেক বোঝানোতেও কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সৌরভ বলে দেন, ‘তুমি রাজি হলে ভালো। নইলে আমি আমার মতো করে অধিনায়ক হিসেবে তোমার নাম ঘোষণা করে দিচ্ছি।’
তিন দিন আগে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের পর সৌরভ কি ফোন করে এটি মনে করিয়ে দিয়েছেন? জানা যায়নি। তা নেদারল্যান্ডস ম্যাচের পরই কেন? বিশ্বকাপ জিতলে না ওটা মনে করিয়ে দেওয়াটা বেশি প্রাসঙ্গিক হয়। তা তখন না হয় সৌরভ আবার মনে করিয়ে দেবেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের পর মনে করিয়ে দিতে পারতেন, কারণ ওই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেই সৌরভের ২০ বছরের পুরোনো এক রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন রোহিত। এক বিশ্বকাপে ভারতীয় অধিনায়কের সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড। ২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভের ৪৬৫ রান ছাড়িয়ে এখন যা এই বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ৫০৩ রান।
ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করার যে চাপ, কোনো খেলার কোনো অধিনায়ককেই সম্ভবত তা নিতে হয় না। এ নিয়ে অস্বস্তি ছাড়া অধিনায়কত্ব নিতে রোহিত শর্মার অনাগ্রহের আর কী কারণ থাকবে! সেই চাপকে জয় করার প্রমাণ পরিসংখ্যানে। অধিনায়কত্ব রোহিত শর্মার ব্যাটিংয়ে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। ভুল বলা হলো। ফেলেছে, তবে তা ইতিবাচক অর্থে। যে ৪৩টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে অধিনায়ক রোহিত শর্মার ব্যাটিং গড় ৫৫.৮০। ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৯.১৪। স্ট্রাইক রেটও জানিয়ে দিচ্ছে, আরও বেশি মন খুলে খেলার কথা, যা প্রায় ১৮ বেশি (ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৯১.৬৩, অধিনায়ক হিসেবে ১০৯.২২)।
এই স্ট্রাইক রেটের হিসাবটা এবারের বিশ্বকাপের রোহিত শর্মাকে বুঝতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। রান খারাপ করেননি, বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৪ নম্বরে তাঁর নাম। তবে এখন পর্যন্ত ভারতের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় রানসংখ্যার চেয়ে বড় ভূমিকা অধিনায়ক যেভাবে তা করেছেন। এই বিশ্বকাপে রান করেছেন ১২১ স্ট্রাইক রেটে। ৪০০-এর বেশি রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি।
শুরুতেই ঝড় তুলে প্রতিপক্ষকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়ার দায়িত্বটা নিজে থেকেই নিয়ে নিয়েছেন। সেই ঝড়ই ঠিক করে দিচ্ছে ভারতীয় ইনিংসের গতিপথ। তাতে ঝুঁকি তো থাকছেই। চারবার পঞ্চাশ ছাড়িয়ে, দুবার আশির ঘরে গিয়েও মাত্র যে একটি সেঞ্চুরি, তার কারণও হয়তো এটাই। অধিনায়ক যখন ব্যক্তিগত অর্জনের কথা ভুলে গিয়ে এমন দলের জন্য ‘শহীদ’ হতে রাজি থাকেন, সেই মানসিকতা বাকি খেলোয়াড়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। টানা ৯ ম্যাচ জয়ের কিছুটা রহস্য তো এখানেও লুকিয়ে।
দায়িত্ব নিয়েছেন বিরাট কোহলির কাছ থেকে। এর আগে ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এমন প্রভাবশালী দুই অধিনায়কের উত্তরসূরির অধিনায়কত্ব-মডেলটা যেন এই দুজনের সংমিশ্রণ। ধোনির মতো নিরাবেগ নন, আবার কোহলির মতো উচ্চকিতও না। নিজের মতো করে নতুন অনেক কিছুও করছেন। বড় বড় ছক্কা মারার সময়ও তাঁর ব্যাটে যেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব থাকে, দলের পরিবেশটাকেও অমন বানিয়ে নিয়েছেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে মিলে। বিশ্বকাপের মতো এত বড় আসরে ভারতীয় দলের ড্রেসিংরুম নিয়ে একটাও উল্টোপাল্টা খবর হয়নি, প্রমাণ তো এখানেই। ম্যাচের পর ম্যাচ টানা জিতে যাওয়াটাও অবশ্যই সাহায্য করেছে। ভারত রাউন্ড রবিন লিগের ৯টি ম্যাচ খেলেছে ৯টি ভিন্ন শহরে। এর মধ্যে ধর্মশালায় নিউজিল্যান্ড ম্যাচের আগেই শুধু একটু দম ফেলার সময় পেয়েছে। দলীয় সংহতি বাড়াতে নানা কিছু করা হয়েছে তখন। যার মধ্যে ফ্যাশন শোও ছিল। এই খবরটা বাইরে আসেনি বলে খুব খুশি রোহিত শর্মা। তা সেই ফ্যাশন শোতে কী হয়েছিল? রোহিত হেসে বললেন, ‘কিছু জিনিস আমাদের মধ্যেই থাকুক না!’
এই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই শুরু ক্রিকেট-জীবন। আজ সেখানেই খেলতে নামছেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। পেরিয়ে আসা পথটা নিয়ে ভাবেন কখনো? রোহিত জবাব দেন, ‘সময় কই! ভাবব, ১৯ নভেম্বরের পরে ভাবব।’
১৯ নভেম্বর মানে ফাইনাল। ওই কথার অর্থ তাই আপনার বুঝে নেওয়ার কথা।