মানুষের হার না মানার নতুন রূপকথা লিখলেন ম্যাক্সওয়েল
আধুনিক উপন্যাস, হয়তো আধুনিক মানুষেরও যাত্রা শুরু মিগেল দ্য সেরভান্তেসের ‘দন কিহোতো’ থেকে। দন কিহোতোয় লা মাঞ্চার এক বোকা যুবক অবিশ্বাস্য সব অভিযানে বের হতো। বলা বাহুল্য, সেসব অভিযানগুলো ছিল অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত, ফলে কিহোতো কখনো সফল হতে পারেননি।
গতকাল ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ জেতাকে মনে হচ্ছিল দন কিহোতোর সেসব অবাস্তব অভিযানের মতোই কিছু একটা; যার প্রমাণ হিসেবে ইএসপিএনক্রিকইনফোর ম্যাচে ‘উইন প্রোবাবিলিটি’র সূচক সামনে নিয়ে আসা যায়। মিচেল স্টার্ক যখন আউট হয়ে ফিরে যান, তখন অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনা ছিল ০.৪৬, মানে আধা পয়েন্টেরও কম।
তারপর যা ঘটেছে তা রূপকথার গল্পলেখকও হয়তো নিজের গল্পে ঘটানোর সাহস দেখাবেন না! লেখক বড়জোর একটা ট্র্যাজেডিই সেখানে ঘটাতে পারেন। নাটকীয়তার পর নায়কের হারের গল্পই শেষ পর্যন্ত হয়তো লিখবেন। কিন্তু নিজের গল্পটা ভিন্নভাবে লেখার ব্রত নিয়েই মাঠে এসেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। যেখানে রূপকথার গল্পলেখকও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কিংবা ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটি দিয়েই যাত্রা শুরু করল রূপকথার নতুন একটি গল্প।
কিহোতোর গল্পের সঙ্গে আরেকটি মিল আছে ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসের। কিহোতো যেভাবে সব অভিযানে সঙ্গী হিসেবে সানচো পানশাকে পেয়েছেন, একইভাবে গতকাল অবিশ্বাস্য ইনিংসটি খেলার পথে ম্যাক্সওয়েলকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছেন প্যাট কামিন্স (৬৮ বলে ১২ রান)। রীতিমতো ধ্যানী ঋষির মতো ক্রিজে আগলে দাঁড়িয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। আর সামনে থেকে উপভোগ করেছেন ম্যাক্সওয়েলের খেলা, অনেকের মতে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনিংসটিও।
ম্যাক্সওয়েলের নামটি শুনলে সবারই আগে মনে পড়ে স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে পড়া জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল নামের এক পদার্থবিজ্ঞানীর কথা। যিনি তড়িৎ চৌম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞানের জগতে অমর হয়ে আছেন। তাঁর সম্পর্কে এটুকুই শুধু জানি। ঠিক একইভাবে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে গতকাল রাতে অমরত্ব পেয়েছেন ক্রিকেটের ম্যাক্সওয়েলও।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটিকে মানব অভিধানের কোনো বিশেষণ দিয়ে বোঝানো রীতিমতো দুঃসাধ্য। ১২৮ বলে ২০১ রানের এ ইনিংসটি খেলেছেন আক্ষরিক অর্থে এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে। শতকের পর থেকে বেশির ভাগ সময় ক্র্যাম্পের যন্ত্রণায় কাতরেছেন। এমনকি এ জন্য সুযোগ থাকার পরও সিঙ্গেল রান নিতে পারেননি। যখনই নিয়েছেন ব্যথায় কুঁকড়ে গেছেন। তাঁর হাঁটার ভঙ্গি দেখে ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ বলেছেন, ‘ম্যাক্সওয়েল অন্য প্রান্তে পৌঁছেছেন চার্লি চ্যাপলিনের মতো হেঁটে।’
চ্যাপলিন যেমন হাস্যকর ভঙ্গিতে জীবনের গভীর কোনো বেদনার গল্প বলে যেতেন, ম্যাক্সওয়েলের সেই ‘হাস্যকর’ হাঁটাতেও লুকিয়ে ছিল তীব্র যন্ত্রণা। এমনকি যেকোনো সময় ম্যাক্সওয়েল মাঠ ছাড়তে পারেন এই আশঙ্কাতে একাধিকবার বাউন্ডারি লাইনের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিলেন সতীর্থ অ্যাডাম জাম্পা। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল তো স্বর্গীয় এক ইনিংস খেলে অমরত্ব পেতে চেয়েছেন। তাই কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি। নয়তো তিন শর কাছাকাছি রান তাড়ায় এক শর মধ্যে ৭ উইকেট হারানোর পর ৬ নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানটি দ্বিশতক করেন কীভাবে! আফগান বোলারদের ওপর ম্যাক্সওয়েল বয়ে গেছেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো। সারাক্ষণই যেন ১১ নম্বর বিপৎসংকেত হয়ে আঘাত হেনেছেন তাঁদের ওপর।
এই ম্যাচে ক্র্যাম্পের ব্যথা নিয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে ম্যাক্সওয়েল যেসব শট খেলেছেন, সেগুলো কখনো কখনো মনে করিয়ে দিচ্ছিল তামিল সিনেমার সুপারস্টার রজনীকান্তকে। ক্রিকেটের ব্যাকরণকে অকেজো বানিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান যেসব শট খেলছিলেন, তা গতকালের আগপর্যন্ত কেবল রজনীকান্তের তামিল সিনেমাতেই শুধু সম্ভব ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা যে কখনো কখনো রূপকথার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়, সেটাই যেন কাল ব্যাটে-বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। যেখানে তাঁর ব্যাটিংয়ের সামনে রীতিমতো পাড়ার বোলারের কাতারে নেমে এসেছিলেন মুজিব উর রেহমান–আজমতউল্লাহ ওমরজাইরা। অথচ ম্যাক্সওয়েল–ঝড় শুরু হওয়ার একটু আগেও মনে হচ্ছিল এই বোলারদের খেলা অসম্ভব। নাভিশ্বাস তুলে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডারকে ধসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। আরেকটি আফগান-রূপকথা মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার, সঙ্গে সেমিফাইনালের হাতছানি তো আছেই।
কিন্তু ম্যাক্সওয়েল মার শুরু করতেই সব যেন ভোজবাজির মতো বদলে গেল। মনেই হচ্ছিল না ৯১ রানে ৭ ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই বোলাররা। আফগানিস্তানের বোলারদের দেখে মনে হচ্ছিল ম্যাক্সওয়েলের জাদুতে তাঁরা রীতিমতো বিবশ হয়ে গেছেন। যেন মাঠে তাঁরা নয়, খেলছিল তাঁদের ছায়ারা।
কয়েক দিন আগে ইন্টার মায়ামিতে লিওনেল মেসির কানাডিয়ান সতীর্থ কামাল মিলারও বলেছেন, মেসির খেলা দেখতে গিয়ে তিনি নিজের খেলায় মনোযোগ দিতে পারেন না। মেসি এমনই মুগ্ধতাজাগানিয়া খেলোয়াড়! কাল আফগান বোলারদের অবস্থা দেখেও তেমনটাই মনে হচ্ছিল। ম্যাক্সওয়েলের অবিশ্বাস্য সব শট দেখতে গিয়ে হয়তো নিজেদের কাজটাই ভুলে গিয়েছিলেন তাঁরা। যে কারণে হাত ফসকে গেছে সহজ ক্যাচও। আর অন্য দিকে ভাগ্য যে সাহসীদের পক্ষে থাকে, সেটি প্রমাণিত হয়েছে সুযোগ পেয়ে ম্যাক্সওয়েল আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠায়। দলকে বাঁচাতে আক্ষরিক অর্থেই যেন যোদ্ধার ভূমিকায় নেমেছিলেন ম্যাক্সওয়েল।
ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ ম্যাক্সওয়েলকে তুলনা করেছে মানব ইতিহাসের সেরা যোদ্ধাদের সঙ্গে। যেখানে তারা আলেক্সান্দার-চেঙ্গিস খান-জুলিয়াস সিজারের কাতারেই ম্যাক্সওয়েলকে রাখার কথা বলেছে। একই সঙ্গে এ ইনিংসটি দিয়ে মানুষের সামর্থ্যের সীমারও পরীক্ষা হওয়ার কথাও বলেছে তারা। কিন্তু মানুষ তো শেষ পর্যন্ত এমনই। তার ভেতর থেকেই প্রবাহিত হয় শক্তির সীমাহীন এক ধারা। হয়তো সব সময় এই শক্তি মানুষ দেখাতে পারে না। কিন্তু যেদিন মানুষের এ দিকটি সামনে এসে হাজির হয়, তখন সে আর হার মানতে পারে না। মানুষের সে রূপটি নিয়েই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’তে লিখেছিলেন, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হতে পারে না।’
হ্যাঁ, সেই গল্পের সান্তিয়াগো নামের বুড়ো যেমন সমুদ্র থেকে লড়াই করে ফিরে এসেছিলেন, তেমনই অবিশ্বাস্য এক জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন ম্যাক্সওয়েলও। তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটি কোনো ব্যক্তি মানুষের জয় নয়, এটি অসংখ্য হারতে থাকা মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর পাথেয়ও।