বিশ্বকাপে ‘সবচেয়ে বাজে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ কি এবারের ইংল্যান্ডই, ইতিহাস কী বলে
বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এমন বাজে পারফরম্যান্স করবে, এমনটা কি কেউ ভেবেছিল! সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এ মুহূর্তে অন্যতম সেরা দলই বলা হয় বেন স্টোকস, জস বাটলার, জনি বেয়ারস্টো, আদিল রশিদ, মার্ক উডদের ইংল্যান্ডকে। ২০১৯ সালে নিজেদের মাঠে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতার পর তারা ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়াতে জিতেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও। কিন্তু সেই দলটিই মাত্র এক বছর পর ওয়ানডে বিশ্বকাপে এসে যা খেলছে, সেটি অবিশ্বাস্য। এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচ খেলে ৫টিতেই হেরেছে তারা। প্রতিটি হারই উড়ে যাওয়ার মতো।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে এত বাজে পারফরম্যান্সের ইতিহাস খুব বেশি নেই। ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুটি আসরের শিরোপাজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৩ সালে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশিপটা হাতের মুঠোতেই ছিল ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসদের। কিন্তু হিসাবের বাইরে থেকে সেই শিরোপা ক্যারিবীয়দের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ভারত। সে অন্য এক ইতিহাস। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাইরে যে দলগুলো ৫০ ওভারের বিশ্ব শিরোপা জিতেছে, তারা ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ তকমা নিয়ে পরের বিশ্বকাপে কেমন করেছে তা দেখা যাক।
১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী ভারত ঘরের মাঠে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে উঠেছিল। পরে ২০১১ সালে দ্বিতীয় শিরোপাটি জেতার পর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও খেলেছিল সেমিফাইনাল।
১৯৮৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিল অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া। ফেবারিট তারা সেবার মোটেও ছিল না। অনেকটা ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবেই প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। তবে ১৯৯২ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার পারফরম্যান্স ছিল অপ্রত্যাশিত। এবারের ইংল্যান্ডের সঙ্গে অনেকটাই মিল ছিল অস্ট্রেলিয়ার পারফরম্যান্স। অ্যালান বোর্ডার, ডেভিড বুন, ক্রেইগ ম্যাকডারমট, ব্রুস রিড, স্টিভ ওয়াহরা সেবার নিজেদের প্রথম চার ম্যাচের তিনটিতেই হেরে গিয়েছিল। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের পর শেষ দিকে হেরেছিল পাকিস্তানের কাছে। অস্ট্রেলিয়াকে সেবার পঞ্চম স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
১৯৯২ বিশ্বকাপ ইমরান খানের নেতৃত্বে জিতেছিল পাকিস্তান। সেবার খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইমরান-জাভেদ মিয়াঁদাদ-ওয়াসিম আকরাম-রমিজ রাজা-আমির সোহেলদের বিশ্বকাপ জেতাটা ছিল স্মরণীয় এক ব্যাপার। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে পাকিস্তান ১৯৯৬ সালে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত পরের বিশ্বকাপে শুরুও করেছিল অন্যতম ফেবারিট হিসেবে। গ্রুপ পর্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে তারা হেরেছিল শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে পাকিস্তান শেষ অবধি বেঙ্গালুরুতে হেরে যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে।
১৯৯৬ সালে ক্রিকেট-বিশ্বকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনৎ জয়াসুরিয়া, অরবিন্দ ডি সিলভা, মুত্তিয়া মুরালিধরনদের শ্রীলঙ্কা। কিন্তু সেই লঙ্কানরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বিশ্বকাপে খেলতে গিয়ে চাপ সামলাতে পারেনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সুপার সিক্সেই উঠতে পারেনি তারা। বিদায় নেয় গ্রুপ পর্যায় থেকেই। গ্রুপ ‘এ’-তে ভারত, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার সঙ্গে লড়ে ছয় দলের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল পঞ্চম। তারা জিতেছিল শুধু জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার বিপক্ষে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার সোনালি সময়ের শুরু যেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপ দিয়েই। পরের দুটি আসরে জিতে বিশ্বকাপ জয়ের হ্যাটট্রিকও করেছে তারা। ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতকে ফাইনালে উড়িয়ে দিয়েছিল রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। ২০০৭ সালে রিকি পন্টিং অধিনায়ক হিসেবে নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতে নাম লেখান ক্লাইভ লয়েডের পাশে। সেবার ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারায় তাঁর দল।
টানা তিনবার বিশ্বকাপ জেতা অস্ট্রেলিয়ার ‘সোনালি যুগ’শেষ হয় ২০১১ সালে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে। যদিও অস্ট্রেলিয়া সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল, কিন্তু সে ম্যাচে হেরে গিয়েছিল ভারতের সঙ্গে। ২০১৫ সালে নিজেদের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পঞ্চম ওয়ানডে বিশ্বকাপটি জেতে অস্ট্রেলিয়া। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে সেই অস্ট্রেলিয়াই সেমিফাইনালে উঠে হেরে যায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। রাউন্ড রবিন লিগের ৯ ম্যাচের ৭টিতেই জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। হেরেছিল শুধু ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
এখন পর্যন্ত ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা দল দুটি—ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া। ক্যারিবীয়রা একবার আর অস্ট্রেলিয়া দুবার ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে বিশ্বজয়ের স্বাদ নিয়েছে। এই দুই দলের বাইরে শুধু ভারতই পরের বার ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নে’র মতো খেলতে পেরেছে। যদিও ১৯৮৭ ও ২০১৫—দুবারই সেমিফাইনালে হৃদয়ভঙ্গের অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। ’৮৭-তে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম ইংল্যান্ড আর ২০১৫ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সেমিতে হেরে গিয়েছিল তারা।
২০১৯ আসরে ট্রফি হাতে তোলা ইংল্যান্ড এবার ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ তকমা লাগিয়ে যে খেলা খেলছে, সেটির কাছাকাছি আছে ১৯৯৯ আসরের শ্রীলঙ্কা আর ১৯৯২ আসরের অস্ট্রেলিয়া। ’৯৯-এ শ্রীলঙ্কা ছয় দলের গ্রুপে হয়েছিল পঞ্চম, আর এবারের আসরে ইংল্যান্ড এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচ খেলে ১০ দলের মধ্যে দশম। ’৯২-তে অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল চার ম্যাচ, এবার এরই মধ্যে পাঁচটিতে হেরে গেছে ইংল্যান্ড।
ওয়ানডে বিশ্বকাপের ইতিহাসে তাই বেন স্টোকস, জস বাটলার, জো রুট, জনি বেয়ারস্টো, মার্ক উডদের ইংল্যান্ড এক বিস্ময় হয়েই থেকে যাবে। ‘সবচেয়ে বাজে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ ইতিহাসে সবার ওপরের নামটা কি তবে ইংল্যান্ডেরই নয়?