সাকিব-তামিম কেন কথা বলেন না
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। দেড়-দুই বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টি তাই এখন স্পর্শের সীমার মধ্যে। সাকিব-তামিমের একে অন্যের সঙ্গে কথা না–বলা নিয়ে এখন কথা বলাই যায়।
তার আগে একটু পেছন ফিরে যাওয়া যাক। গত বছরের ২৩ মার্চ। সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্ক প্লাবিত লাল–সবুজ ঢেউয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদেরই মাঠে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। সেই জয়ের মতোই সেদিন নীরবে ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে গেছে একটা ছবি। ম্যাচ জেতানো জুটির দুই ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান জয় উদ্যাপনে আলিঙ্গন করছেন একে অন্যকে।
পরদিন তাঁদের একজনকে বলেছিলাম, এমন ছবি অনেক দিন পর দেখা গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটে! তবে ছবিটা যেন হারিয়ে না যায়। জয়ের ছবি হোক জীবনেরও ছবি। বাকধর্মঘট এবার তুলে নিলেই ভালো।
জবাবে তিনি কী বলেছিলেন, তা এখন আর না বললেও চলে। একটি ক্রিকেট ওয়েবসাইটকে দেওয়া বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের সাক্ষাৎকারে এরই মধ্যে সবাই জেনে গেছেন মাঠের বাইরে সাকিব-তামিমের সম্পর্ক এখনো শীতল। তাঁদের একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা এখনো বন্ধ।
মাঠে দলের প্রয়োজনে তাঁরা কথা বলেন। প্রতিপক্ষের উইকেট পড়লে একসঙ্গে উদ্যাপন করেন। ব্যাটিংয়ে জুটি বেঁধে রান করেন। কিন্তু এর বাইরে সতীর্থ হিসেবে যে একটা সম্পর্ক থাকে, সেটা বন্ধুত্বের পর্যায়ে না হোক, একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক; সেটাই তাঁদের মধ্যে অনেক দিন ধরে নেই।
ঠিক কোন দিন থেকে সেই সম্পর্কে এমন অবনতি, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে একটু একটু করে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে অন্তত দুই বছর ধরে তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন না, যাকে বলা যায় ‘আড়ি’ নেওয়া। ব্যাপারটা এই পর্যায়ে গেছে যে ড্রেসিংরুম, টিম হোটেল বা অন্য কোথাও সতীর্থদের আড্ডায় একজন থাকলে আরেকজন সেখান থেকে সরে যান অথবা সেখানে যানই না।
একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের অভিযোগও আছে কিছু। কিছু আলোচনায় সেসব শুনে বেশির ভাগই ব্যক্তিগত পর্যায়ের বলে মনে হয়েছে। কিছু পারিবারিক বিষয়ও থেকে থাকতে পারে। আবার কিছু অভিযোগ এ রকমও আছে, যেগুলো দলসংক্রান্ত। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এ নিয়ে বিস্তারিত না বলাই ভালো। তা ছাড়া সেসব অভিযোগ দীর্ঘ মেয়াদে একজন সতীর্থের সঙ্গে কথা বন্ধ রাখার মতো অজুহাত হতে পারে বলে কখনো মনে হয়নি।
বিসিবি একবার পেরেছিল দুজনকে একসঙ্গে বসিয়ে আলোচনাটা তুলতে। তাঁদের বলা হয়েছিল সবকিছু ভুলে সম্পর্ক সহজ করে ফেলতে। সেখানে একজন কিছুটা ইতিবাচক থাকলেও আরেকজন সাড়া দেননি। তিনি মিটিমিটি হেসেছেন এবং এরপর থেকে আবার দুজন দুজনের সঙ্গে কথা না বলেই থেকেছেন।
সাকিব-তামিমের মতো দুজন সিনিয়র খেলোয়াড়, যাঁদের সবাই বলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা, বড় গর্ব, তিন সংস্করণ মিলিয়ে যাঁরা বাংলাদেশ দলকে মাঠে নেতৃত্ব দেন এবং একজন আরেকজনের নেতৃত্বে খেলেনও; তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই অচলায়তন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যজনক।
হ্যাঁ, কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, দুজন যদি মাঠে ঠিক থাকেন তাহলে মাঠের বাইরে তাঁরা কথা বললেন কি বললেন না, তা নিয়ে এত আলোচনা কেন? সেটা তো তাঁদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিভিন্ন খেলায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে সতীর্থ হয়েও কথা না বলার উদাহরণও টানতে পারেন অনেকে।
কিন্তু এটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে এখানে যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের X, Y, Z নন। তাঁরা সাকিব-তামিম, বাংলাদেশ দলের দুই নেতা, যাঁদের অনুসরণ করে চলেন দলের অন্যরা।
বাংলাদেশ দলে এখন যে গ্রুপিংয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা সাকিব-তামিমের মধ্যে কথা না বলার সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি। নেতৃত্বে যখন ফাটল থাকবে, তখন দলে ফাটল ধরবে, এ তো নতুন কিছু নয়! তারপরও ক্রিকেটারদের ধন্যবাদ দিতে হয়, কারণ দুই সিনিয়রের বিভাজনের বড় কোনো সুযোগ তাঁরা কখনো নেননি। যতটুকু বিভাজিত তাঁরা হয়েছেন, সেটা আসলে দুই ‘বড় ভাইয়ে’র মন জুগিয়ে চলতে গিয়েই।
গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাকিব-তামিমের এই সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ দলের কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা এই অস্বস্তিকর অবস্থার অবসান চান। এক ক্রিকেটার বলেছিলেন, সব সময় তাঁদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে দেখলে না আবার ওই ভাই মাইন্ড করে ফেলেন! এইজনের সঙ্গে খেতে গেলে যদি ওই জন রাগ করেন! কারও কারও নাকি এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে, দুই ‘বড় ভাইয়ে’র একজনের অনুপস্থিতিতে হওয়া আলোচনায় আরেকজন কী বলেছেন, সেসব পরে তাঁকে অনুপস্থিত থাকা ‘বড় ভাই’কে বিস্তারিত বলতে হয়েছে।
অভিযোগ তো এমনও আছে, জাতীয় দলের হয়ে দুজন যে মাঝেমধ্যেই এই সিরিজ, ওই টুর্নামেন্ট থেকে বিরতি নেন; সেসবের পেছনের কারণও তাঁদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। একজনের নেতৃত্বে আরেকজন ইচ্ছে করে নিজের পারফরম্যান্স ‘সীমিত পর্যায়ে’ রাখেন কি না, দলের আশপাশে সে রকম আলোচনাও দু-একবার শোনা গেছে।
তবে টিম ম্যানেজমেন্টের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে আরও পরিষ্কার হওয়া গেছে, দুই সিনিয়রের সম্পর্কের এই বন্ধ দরজা দলের জন্য কতটা অস্বস্তিকর এবং অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। কোচিং স্টাফের এক সদস্য বলেছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে দুজনের সঙ্গে আলাদা কথা বলে তাঁদের বোঝাতে চেয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই সমস্যা দলে বাজে ছায়া ফেলছে। কিন্তু দুজনের কেউই নাকি তাঁকে খুব একটা পাত্তা দেননি। তাঁকে তাঁরা বলেনওনি কেন একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলেন না।
বিসিবির কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ হয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে তাঁরাও বলেছেন, অনেকবার চেষ্টা করেও পারেননি সাকিব-তামিমকে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে রাজি করাতে (যেটা বিসিবি সভাপতিও সাক্ষাৎকারে বলেছেন)।
আক্ষেপ করে এক পরিচালক বলেছেন, ‘বাইরে থেকে মানুষ বুঝতে পারে না, আমরা কিসের মধ্যে আছি। দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং হাইরেটেড খেলোয়াড়ের মধ্যে কথা বন্ধ! বোর্ডও পারছে না তাঁদের কথা বলাতে! এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী আছে!’
আরেক পরিচালক মজা করে বলেছিলেন, ‘ওদের একসঙ্গে করতে হলে আগে ওদের দুই পরিবারকে একসঙ্গে করতে হবে। আসল সমস্যা তো ওখানে!’
অবশ্য বিসিবি একবার পেরেছিল দুজনকে একসঙ্গে বসিয়ে আলোচনাটা তুলতে। তাঁদের বলা হয়েছিল সবকিছু ভুলে সম্পর্ক সহজ করে ফেলতে। সেখানে একজন কিছুটা ইতিবাচক থাকলেও আরেকজন সাড়া দেননি। তিনি মিটিমিটি হেসেছেন এবং এরপর থেকে আবার দুজন দুজনের সঙ্গে কথা না বলেই থেকেছেন।
বিসিবি সভাপতি প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন, বাকিটা এখন হাথুরুর হাতে। তারও আগে সাকিব-তামিমের হাতে। তাঁরা যদি সত্যিই পারেন ব্যক্তিগত সম্পর্কেও সেঞ্চুরিয়নের জয়ের মুহূর্তের ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে, তাহলে যে হাততালিটা পাবেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে শত আলোকবর্ষ দূর থেকেও।
অভিযোগ তো এমনও আছে, জাতীয় দলের হয়ে দুজন যে মাঝেমধ্যেই এই সিরিজ, ওই টুর্নামেন্ট থেকে বিরতি নেন; সেসবের পেছনের কারণও তাঁদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। একজনের নেতৃত্বে আরেকজন ইচ্ছে করে নিজের পারফরম্যান্স ‘সীমিত পর্যায়ে’ রাখেন কি না, দলের আশপাশে সে রকম আলোচনাও দু-একবার শোনা গেছে। তবে ক্রিকেটের প্রতি দুজনেরই নিবেদনটা অনেক বেশি বলে সে আলোচনা খুব বেশি প্রশ্রয় পায়নি।
এসব গত এক-দেড় বছরের কথা। সাকিব-তামিমের মধ্যে কথা বলা বন্ধ আরও আগে থেকে। সেটা কী কারণে, তা খুঁজতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু সমস্যার কথা জানা গেছে, কিন্তু সেসব ইস্যুতে যে এমন দায়িত্বশীল দুজন মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে কথা না বলে থাকতে পারেন, তা ভাবতে পারাই বিস্ময়কর। যাঁরা দলটাকে এক সুতায় বাঁধবেন বলে সবার আশা, তাঁরাই যখন ছেলেমানুষের মতো নিজেরাই দুটো ভিন্ন নাটাইয়ে সুতা বাঁধতে থাকেন, তখন তো আর কিছু করার থাকে না।
তবে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে নতুন করে কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিসিবি কিছুটা আশান্বিত যে এবার বরফ গলবে, নয়তো হাতুড়ির আঘাতে বরফ ভাঙা হবে। সত্যি বলতে হাথুরুকে দিয়ে ড্রেসিংরুমে স্বস্তি এবং স্বাস্থ্য ফেরানোর যে কথা শুরু থেকে বলা হচ্ছে, সেটা এটাই। তাঁর অন্যতম দায়িত্বই হলো সাকিব-তামিমকে পথে এনে দলের শৃঙ্খলা ফেরানো এবং অদৃশ্য বিভাজন দূর করা। ক্রিকেটারদের সঙ্গে প্রথম সভায় প্রচ্ছন্নভাবে কোচ সেই বার্তাটা দিয়েছেনও—সবার আগে দল।
কিন্তু শঙ্কা হলো, সেটা করতে গেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট বড় একটা ‘সিস্টেম লসে’র মধ্যে পড়ে যেতে পারে। বিসিবি সভাপতিও তাঁর সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় সে ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে।
তারপরও ঝড় উঠলেই ভালো। কারণ, ঝড় উঠলেই ঝড় থামে। দীর্ঘমেয়াদি নিম্নচাপ কখনোই স্বস্তিকর নয়। উপকূলে সেটা শুধু ভয় আর শঙ্কাকেই দীর্ঘমেয়াদি করে তোলে। বাংলাদেশের ক্রিকেট উপকূলে সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব এরই মধ্যে অনেকটা মেয়াদ পেয়েও গেছে। উপকূলের মানুষেরা দিন পার করছেন চাপা অস্বস্তি নিয়ে। এবার এর অবসান হওয়া দরকার।
বিসিবি সভাপতি প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন, বাকিটা এখন হাথুরুর হাতে। তারও আগে সাকিব-তামিমের হাতে। তাঁরা যদি সত্যিই পারেন ব্যক্তিগত সম্পর্কেও সেঞ্চুরিয়নের জয়ের মুহূর্তের ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে, তাহলে যে হাততালিটা পাবেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে শত আলোকবর্ষ দূর থেকেও।