ফুটবল ভালোবাসা এভারটন–ভক্ত হার্টলি যেভাবে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের ভরসার নাম
কথায় আছে, মেঘের পরে সূর্য হাসে। টম হার্টলির টেস্ট অভিষেকের চিত্রটা বোঝাতে এই কথাকে রূপক অর্থে ব্যবহার করা যায়। হায়দরাবাদ টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসে হার্টলি অভিষেকে ‘মেঘ’, সূর্যের দেখা পেয়েছেন ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে। আর সে সূর্যের এমনই তেজ যে ভারত জ্বলেপুড়ে ছারখার!
টেস্ট অভিষেকে প্রথম বলেই ছক্কা হজম করতে হয়েছে। পঞ্চম বলেও! টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম ২ ওভারেই দিয়েছেন ২৫ রান। আর ভারতের প্রথম ইনিংসে ২৫ ওভার বোলিং করে ১৩১ রানে ২ উইকেট। ওই ইনিংসে ইংল্যান্ডের একমাত্র বোলার হিসেবে ওভারপ্রতি গড়ে ৫–এর বেশি রান দিয়েছেন। এই হলো হার্টলির অভিষেক টেস্টের প্রথম খণ্ড—মেঘ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির দলের হয়ে ওয়ানডে অভিষেকও হয় হার্টলির। তবু তাঁর টেস্ট দলে ডাক পাওয়ায় চমকে গিয়েছিলেন অনেকেই। হায়দরাবাদ টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসের সেই চমকটা নিশ্চয়ই প্রশ্নেও রূপান্তরিত হয়েছিল।
যে হার্টলি ভারতের প্রথম ইনিংসে দেদার রান দিয়ে নিজের অভিষেক নিয়েই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে—২৬.২ ওভারে ৬২ রানে ৭ উইকেট। ইংল্যান্ড যে পাঁচ বোলার ব্যবহার করেছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ ওভার করে বল করা খেলোয়াড়দের মধ্যে এবার হার্টলির ইকোনমি সর্বনিম্ন—২.৩৫। ওভারসংখ্যাও বাকিদের তুলনায় সর্বোচ্চ। অর্থাৎ তাঁর ওপর ভরসা ছিল অধিনায়ক বেন স্টোকসেরও, যাকে অন্য ব্যঞ্জনায় বলতে পারেন হার্টলির সূর্যের হাসি।
কিন্তু এই হাসির উৎস কোথায়? শিকড় কী? কে এই টম হার্টলি?
ইন্টারনেটের এই যুগে গত পরশু হার্টলি যখন উইকেট নিচ্ছিলেন, তখনই নিশ্চয়ই গুগল করে ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এই স্পিনার সম্পর্কে অনেকে জেনে নিয়েছেন। নিশ্চয়ই আরও জানেন, উচ্চতাকে ব্যবহার করে বল তোলার পাশাপাশি নিখুঁত লাইন–লেংথ তাঁর শক্তির জায়গা। আসলে ভারতের কন্ডিশন মাথায় রেখে অক্ষর প্যাটেলের মতো একজনকে খুঁজছিল ইংল্যান্ড। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রব কি বলে রেখেছেন, হার্টলি ‘সেখানে সত্যিই কার্যকর ভূমিকা রাখবে’।
তাহলে নিশ্চয়ই এটাও অজানা নয়, গত বছরের নভেম্বরে আবুধাবিতে ইংল্যান্ড লায়ন্সের শীতকালীন অনুশীলন ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন হার্টলি। ভারত সফর সামনে রেখে সেটা ছিল লাল বলে খেলার জন্য স্পিনারদের পরখ করে দেখার অনুশীলন ক্যাম্প। আর ইংল্যান্ডের টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার আগে ল্যাঙ্কাশায়ারের এই স্পিনার মাত্র ২০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সারির দলের হয়ে ওয়ানডে অভিষেকও হয় হার্টলির। তবু তাঁর টেস্ট দলে ডাক পাওয়ায় চমকে গিয়েছিলেন অনেকেই। হায়দরাবাদ টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসের সেই চমকটা নিশ্চয়ই প্রশ্নেও রূপান্তরিত হয়েছিল।
২৪ বছর বয়সী এই স্পিনার কি দারুণভাবেই না সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন! ইংল্যান্ডকে শুধু জেতানইনি, ১৯৪৮ সালে কিংবদন্তি জিম লেকারের পর ইংল্যান্ডের প্রথম স্পিনার হিসেবে অভিষেকে নিয়েছেন ৭ উইকেট। বলতে পারেন, কে লেখেন এই চিত্রনাট্য? উত্তরটা সবার জানা। তবে হার্টলির চিত্রনাট্যে কিন্তু তাঁর বাবার অবদানও আছে। হার্টলির বাবা ছিলেন ক্রীড়াবিদ। বিল হার্টলি ৪০০ মিটারে দৌড়াতেন। যেনতেনভাবে নয়। ১৯৭৪ ইউরোপিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতেছেন। সে বছর কমনওয়েলথ গেমসেও একই ইভেন্টে রুপা।
টম হার্টলি শৈশবে ছিলেন ফুটবলের ভক্ত। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব এভারটনকে সমর্থন করেন। ক্লাবটির দুই ফুটবলার লেইটন বেইনস ও ফিল জাগিয়েলকাকে আদর্শ মানতেন। ফুটবলের সংস্পর্শে এলেও শৈশবে ক্রিকেটই খেলেছেন বেশি।
২০২০ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেকের পরের বছর দ্য ক্রিকেটারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টম বাবাকেই নিজের আদর্শ বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাবা বাগানে আমার সঙ্গে ফুটি (অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল), ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলা খেলতেন। খেলাধুলায় আমি নিজের পথ বেছে নেওয়ায় তিনি খুশি হয়েছিলেন। অ্যাথলেটিকসে যেতে জোরাজুরি করেননি। ক্রিকেটেরও বড় ভক্ত তিনি। তিনি যা করেছেন, তা দেখে মনে হয়, আমাকেও তাঁর মতো হতে হবে।’
টম হার্টলি শৈশবে ছিলেন ফুটবলের ভক্ত। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব এভারটনকে সমর্থন করেন। ক্লাবটির দুই ফুটবলার লেইটন বেইনস ও ফিল জাগিয়েলকাকে আদর্শ মানতেন। ফুটবলের সংস্পর্শে এলেও শৈশবে ক্রিকেটই খেলেছেন বেশি। বিল হার্টলি দ্য ক্রিকেটারকে বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় সে ফুটবল খেলত। খেলাটা পছন্দ করত এবং একাডেমিতেও ঢুকেছিল। কিন্তু সেখান থেকে চলে আসতে হয়। সে ভালো ফুটবলার হলেও তারা যা খুঁজছিল, সেসব তার মধ্যে পায়নি। এরপর সে মার্চেন্ট টেলরের হয়ে (ক্রিকেট) খেলতে শুরু করে।’
লিভারপুলের ক্রসবিতে মার্চেন্ট টেলর স্কুলে ১০ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন টম। বয়সভিত্তিকে ল্যাঙ্কাশায়ারের প্রতিনিধিত্ব করলেও স্কুল ছাড়ার পর পেশাদার চুক্তি পাননি। ২০১৭–১৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় ক্লাব ক্রিকেট খেলে আসার পর লিভারপুলের ডিস্ট্রিক্ট প্রতিযোগিতা ও ওমর্সকার্কের হয়ে প্রচুর উইকেট নেওয়ার পর ২০১৯ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের প্রথম পেশাদার চুক্তির অধীনে আসেন হার্টলি। আবুধাবিতে ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে অনুশীলনে ‘মেন্টর’ হিসেবে পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক অফ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ানকে।
আশার ঢাক বাজছে ইংল্যান্ডের মার্সেসাইড অঞ্চলের ম্যাগহালেও। সেখানে পারিবারিক নার্সারি ও বসবাস টম হার্টলির মা–বাবার। গতকাল টেলিভিশনে ছেলের কীর্তি দেখেছেন তাঁরা। ছেলে দেশকে জেতানোর পর খুব বড় কোনো উদ্যাপন করেননি মা–বাবা। হারবাল চা দিয়ে উদ্যাপন সেরেছেন। ফেসবুকে তাঁর মা অ্যান–লুইস মনের অনুভূতি জানিয়েছেন এক শব্দে, ‘ওয়াও!’
তবে ক্রিকেটের পাশাপাশি এভারটন এখনো টানে টমকে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ টেবিলে এ মৌসুমে ধুঁকছে এভারটন। অবনমন তালিকায় থাকা তিনটি ক্লাব থেকে এক ধাপ ওপরে আছে। প্রিয় ক্লাবটি নিয়ে ইংল্যান্ডের আই নিউজকে গত বছরের নভেম্বরেই বলেছেন, ‘আমি এভারটনের বড় ভক্ত। এখন তারা কঠিন সময় পার করছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে তাদের খেলা দেখতে যেতাম। টিম কাহিল, লেইটন বেইনস, ফিল জাগিয়েলকাদের প্রতি সপ্তাহেই দেখেছি। আশার কথা হলো, এই মৌসুমে আমাদের চেয়ে আরও তিনটি বাজে দল আছে।’
আশার ঢাক বাজছে ইংল্যান্ডের মার্সেসাইড অঞ্চলের ম্যাগহালেও। সেখানে পারিবারিক নার্সারি ও বসবাস টম হার্টলির মা–বাবার। গতকাল টেলিভিশনে ছেলের কীর্তি দেখেছেন তাঁরা। ছেলে দেশকে জেতানোর পর খুব বড় কোনো উদ্যাপন করেননি মা–বাবা। হারবাল চা দিয়ে উদ্যাপন সেরেছেন। ফেসবুকে তাঁর মা অ্যান–লুইস মনের অনুভূতি জানিয়েছেন এক শব্দে, ‘ওয়াও!’ বাবা বিল হার্টলি অবশ্য এত অল্পে সারতে পারেননি। নিজে ক্রীড়াবিদ ছিলেন বলেই বোধ হয় এমন সব পরিস্থিতিতে কেমন লাগে, তা জানেন।
ফেসবুকে বিল লিখেছেন, ‘শুধু গর্ব দিয়ে এটা বোঝানো যায় না। আমাদের ছেলের শুরুটা কী দারুণ হলো! আশা করি, সামনে এমন আরও অনেক দেখা যাবে...আমাদের গ্রাহক এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে যে সমর্থন পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এটা জেনে ভালো লাগছে যে অনেকেই তার শুভকামনা করেছে...ওমসকার্ক ক্রিকেট ক্লাবকে ভুলে গেলেও চলবে না। সেখান থেকেই সবকিছুর শুরু। আপাতত হারবাল চা খাচ্ছি, তাতে হৃৎপিণ্ডের গতি কিছুটা কমবে।
মা–বাবার মন বলে কথা! গতি তো বাড়বেই।