এখন তো মনে হয়, ওসব পূর্বজন্মের স্মৃতি।
সেবার আইপিএল চলছিল। মোস্তাফিজুর রহমান মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বোলার। কাদের সঙ্গে যেন একটা ম্যাচে মাঠে নামানো হলো না তাঁকে। ব্যস, আর যায় কোথায়! আক্ষেপ-হতাশা-ক্ষোভমিশ্রিত গলায় পুরো বাংলাদেশ যা বলল, তার পরিমার্জিত সংস্করণ এই, ‘রোহিত শর্মাকে ভীমরতিতে ধরেছে। না হলে ফিজকে কেউ বসিয়ে রাখে!’
২০২২ সালে ফেরা যাক। মোস্তাফিজ দিব্যি সুস্থ। খেলাও আইপিএলের নয়, বিশ্বকাপের আঁচ সঙ্গী করে গড়ানো ত্রিদেশীয় সিরিজে মাঠে নামার কথা জাতীয় দলের হয়ে। অথচ মোস্তাফিজ বাইরে বসে রইলেন টানা তিন ম্যাচ। রাগ-ক্ষোভের পাট তো বহু আগেই চুকেছে, উল্টো স্বস্তির বাতাবরণই টের পাওয়া গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ‘যাক, অবশেষে তো বাদ পড়ল!’
মোস্তাফিজকে নিয়ে জনমতের কেন এই পালাবদল, তার কারণ লিখতে গেলে চর্বিতচর্বণই হবে। উইকেট নিতে পারছেন না, রানও বিলাচ্ছেন দেদার। প্রথম আলোতেও লেখা হয়েছে, মোস্তাফিজ ‘করে না তো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস’। এই মোস্তাফিজ আর ম্যাচ জেতাতে পারছেন না।
কিন্তু মোস্তাফিজকে দলের বাইরে ঠেলেই কি পাওয়া গেল জয়ের খোঁজ? পাওয়া যে যায়নি, তা আপনার অজানা নয়। বোলারদের হতশ্রী পারফরম্যান্সও বলছে, বাংলাদেশের সমস্যার মহৌষধ কেবল মোস্তাফিজকে ছুড়ে ফেলাতেই নয়।
ত্রিদেশীয় সিরিজে ১৭৩ রান করেও জেতা যায়নি এক দিন, এর আগের দিনই আবার নিউজিল্যান্ড দাঁড় করিয়েছিল ২০৮ রানের পাহাড়। দুরূহ ওভারগুলোতে যাঁর হাতে বল তুলে দিয়ে ‘কিছু একটা ও করবেই’ আশায় থাকেন অধিনায়ক, যাঁকে বলে ‘এক্স ফ্যাক্টর’বোলার, সেই একজনের খোঁজ সাকিব আল হাসান করে বেড়িয়েছেন ইতিউতি। লাভ হয়েছে ঘণ্টা! তিন ম্যাচে ইনিংসের শেষ ৪ ওভারে বাংলাদেশের বোলাররা রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি প্রায় ১২। সবচেয়ে মিতব্যয়ী ছিলেন যিনি, সেই সৌম্য সরকারকে বল করতে ডাকা হয়েছিল ঠেকায় পড়ে।
কেবল তিন ম্যাচ নয়, ডেথ ওভারে বাংলাদেশের তথৈবচ দশা বেশ কিছুদিন ধরেই। এ বছর ইনিংসের শেষাংশে কমপক্ষে ২০ বল করেছেন, এমন বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে ইকোনমি রেটটা ৯-এর নিচে রাখতে পেরেছেন শুধু হাসান মাহমুদ। বাদবাকি পেসারদের অবস্থা এতই হতশ্রী যে ওভারপ্রতি ১০.৯১ রান খরচ মোস্তাফিজ হয়ে যাচ্ছেন দ্বিতীয় সেরা!
ডেথ ওভারে কে কেমন (কমপক্ষে ২০ বল)
২০২২ সালের গোড়া থেকে যে ছয় ম্যাচে বাংলাদেশ আগে বল করেছে, সেই ম্যাচগুলোর পরিসংখ্যান আমলে নিলে ছবিটা স্পষ্ট হয় আরও। এই ম্যাচগুলোতে প্রথম ১৬ ওভারে বাংলাদেশ রান হজম করেছে ১৬১, ১১৬, ১২০, ৯৪, ১৪০ এবং ১৪২। অর্থাৎ শেষ ৪ ওভারে বাংলাদেশ রান হজম করেছে ওভারপ্রতি ১১.৯১। সংখ্যাগুলো কতটুকু বাজে, তা বুঝতে নিচের ছকে চোখ রাখা জরুরি। একই সময়ে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই ‘ডেথ ওভারে’ রান হজম করেছে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
২০২২ সালে প্রথমে বল করলে কোন দল কেমন
এ তালিকাতেই দেখা যাচ্ছে, ডেথ ওভারে রান খরচায় বাংলাদেশ আর ভারতের পার্থক্য নেই খুব একটা। কিন্তু জয়-পরাজয়ের খতিয়ানটা বের করতেই দুই দলে তফাত হয়ে যাচ্ছে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের। বাংলাদেশ যেখানে পরে ব্যাট করে জিতেছে মাত্র একটি ম্যাচে, ভারত সেখানে ১১ ম্যাচের ৯টিতেই মাঠ ছেড়েছে জয়ীর বেশে। কেন এই আকাশ-পাতাল পার্থক্য, তা খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশের আরও এক সমস্যার কথা।
ডেথ বোলিং যাচ্ছেতাই হলেও ম্যাচ জেতা যায়, যদি এর আগের ১৬ ওভারেই ম্যাচ নিজেদের পকেটে পুরতে পারা যায়। গত আইপিএলের ফাইনালিস্ট রাজস্থান রয়্যালসের পরিকল্পনাটা যেমন ছিল। ট্রেন্ট বোল্ট, প্রসিধ কৃষ্ণা, যুজবেন্দ্র চাহাল ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন উইকেট নিয়ে প্রথম ১৬ ওভারেই প্রতিপক্ষকে ঠেলে দিচ্ছিলেন ম্যাচ থেকে দূরে। গেল আইপিএলের টালি খাতা টেনে বের করলে দেখা যাচ্ছে, শেষ ৪ ওভারে খেলা গড়ানোর আগে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়া ১২ বোলারের তালিকায় আছেন এই চারজনই এবং ওভারপ্রতি কেউই রান খরচা করেননি ৭.৫৭-এর বেশি।
রাজস্থানের পরিকল্পনার ছায়া দেখা যাচ্ছে ভারতের বোলিংয়েও। আবার এই মানদণ্ডেই ফুটে উঠছে ইনিংসের শুরুতেও বাংলাদেশের ম্যাচ বের করতে পারার অক্ষমতার চিত্র। গত বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত যে ১৬ ইনিংসে বল করেছে বাংলাদেশ, সেখানে প্রথম ১৬ ওভারে তারা উইকেট তুলতে পেরেছে গড়ে ৩.৫৬টি। ২০২২ সালে শীর্ষ দলগুলোর মধ্যে কেবল ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকাই প্রথম ১৬ ওভারে উইকেট তুলতে পেরেছে বাংলাদেশের চেয়ে কম।
আদতে এই উইকেট না তুলতে পারার ডমিনো ইফেক্টটাই টের পাওয়া যাচ্ছে ইনিংসের শেষাংশে। আগে বল করে পাওয়ারপ্লেতে বাংলাদেশি বোলাররা রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি মাত্র ৬.৯০, যেকোনো বিচারেই সংখ্যাটা অনবদ্য। আগে বল করলে ভারত, নিউজিল্যান্ড, সঙ্গে আফগানিস্তান, বাংলাদেশের বাইরে এই তিন দলই শুধু পাওয়ারপ্লে ইকোনমি রেটটা রাখতে পেরেছে ৭–এর নিচে।
তবে বাংলাদেশের এই দারুণ সূচনা দিক হারিয়েছে ইনিংসের ৭-১৬ ওভারে। সব দলই প্রতিপক্ষের রান আটকানোর জন্য উইকেট তুলেছে এই পর্যায়ে, ম্যাচপ্রতি ২ কিংবা এর বেশি। নিউজিল্যান্ড ৪ ম্যাচে আগে বল করে যেমন মিডল ওভারে উইকেট নিয়েছে ১৪টি। কিন্তু এ কাজই করতে পারেনি বাংলাদেশ। উইকেট নিতে পারেনি ম্যাচপ্রতি ২টিও, উল্টো রান হজম করেছে ওভারে ৮.৫০। ইকোনমি রেটের হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকা আর পাকিস্তানের অবশ্য ঠাঁই হচ্ছে বাংলাদেশেরও নিচে।
মাঝের ওভারে কে কেমন
কিন্তু পাকিস্তানও যে বেশির ভাগ ম্যাচে জয়মাল্য পরেই বেরিয়ে যাচ্ছে, এর কারণ, ইনিংসের শেষ ভাগে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে তারা। উইকেট নেওয়া-খোয়ানো খুব একটা প্রভাব ফেলে না তখন, রান আটকানোই উদ্দেশ্য থাকে বোলারদের। এ কাজই পাকিস্তানি বোলাররা করতে পেরেছেন খুব ভালো। শীর্ষ দলগুলোর মধ্যে ডেথ ওভারে আফগানিস্তানের ইকোনমি রেট ৯-এরও নিচে। পাকিস্তান আছে এরপরই, তাদের বোলাররা রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ৯.৫৮।
বাংলাদেশ চরমভাবে মার খেয়েছে এখানেও। দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররা ডেথ ওভারে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ১৩.০৮। নিকৃষ্টের হিসাবে এর ওপরেই জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশের বোলারদের, তাঁদের ইকোনমি রেট ১২ ছুঁই ছুঁই।
হয় ভারতের মতো ইনিংসের শুরুতে আর মাঝে উইকেট নাও, নয়তো পাকিস্তানের মতো ইনিংসের শেষে রান আটকাও—আগে ফিল্ডিং করলে ম্যাচ জেতার কৌশল এই দুটোই। তবে বাংলাদেশের বোলাররা দূরত্ব মেনে চলছেন দুই দেশের পরিকল্পনাতেই। শ্রীধরন শ্রীরাম তাই যতই ইমপ্যাক্ট আর ইনটেন্ট শেখান ব্যাটসম্যানদের, বোলাররা গোড়া থেকেই গাইতে ধরেছেন ভিন্ন স্কেলে। তাই প্রথম সারির টি-টোয়েন্টি দলগুলোর হিসাবে ২০২২ সালে জয়-পরাজয়ের অনুপাতে বাংলাদেশের ঠাঁই একদম তলানিতে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ধারাটা বদলাবে, এর পক্ষে বোধ হয় বাজি ধরার লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিলই হবে। ব্যাটসম্যানের শরীরে নাচন বইয়ে দেওয়ার মতো সুইং বোলার নেই, উইকেট তোলার জন্য মিস্ট্রি স্পিনার কিংবা লেগ স্পিনার নেই, ভারত হওয়াটা তো কিছু অসম্ভবই। মোস্তাফিজকে দলে ফিরিয়ে ম্যানেজমেন্ট তাই হাঁটতে পারে ডেথ ওভারে ম্যাচের কর্তৃত্ব দখলের পরিকল্পনায়। যে কাজটা তাঁর চেয়ে ভালো করে কেউ করতে পারত না বলেই মোস্তাফিজের আগে-পরে বসেছিল বিশ্বসেরা তকমা।
মুশকিলটা হচ্ছে, এখনকার মোস্তাফিজকে দেশসেরা বলতে গেলেও জুড়তে হচ্ছে গণ্ডাখানেক পাদটীকা।
(*সব পরিসংখ্যান ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল পর্যন্ত)