এসওএস, এসওএস, এসওএস।
ঘোর বিপদ থেকে উদ্ধারের জরুরি বার্তাটা একবার লিখে ক্ষান্ত হননি রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বিপদের ভয়াবহতা বোঝাতে তিনবার লিখেছেন। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আকুল আবেদন—কেউ আমাদের বোলারদের বাঁচান।
ভারতীয় অফ স্পিনারের টুইটে বোলারদের আর্তনাদ শোনা গেছে গত এপ্রিলের শেষ দিকে। আইপিএলে বোলাররা তখন বেদম মার খাচ্ছিলেন। দুই শ রান উঠছিল নিয়মিত, আড়াই শ রানও জয় নিশ্চিতের জন্য যথেষ্ট হচ্ছিল না। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট–সেরা স্যাম কারেন তো প্রশ্নই তুলে ফেলেন, ক্রিকেট-কি বেসবলে পরিণত হচ্ছে?
আইপিএলের মতো বেসবলের অনুভূতি আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতেও সংক্রমিত হবে কি না, তা আপাতত অজানা। তবে কুড়ি ওভারের খেলায় ম্যাচের একটা পর্যায়ে ব্যাটসম্যানরা কিন্তু বেসবলের ‘ব্যাটার’ রূপেই আবির্ভূত হন, সে পৃথিবীর যে প্রান্তে আর যে দলই হোক না কেন! প্রতিটি বল তুলে মারার সেই পর্বটার একটা আতঙ্ক–ছড়ানো নাম আছে—ডেথ ওভার।
টি-টোয়েন্টির পরিভাষায় ডেথ ওভার বলা হয় ইনিংসের ১৭ থেকে ২০—এই চার ওভারকে। ব্যাটিং আগে হোক বা পরে, ব্যাটসম্যানরা এই সময় রীতিমতো খুনে মেজাজে থাকেন। রান বাড়িয়ে নেওয়া কিংবা জয় নিশ্চিত করতে এ সময় মাঠে পাঠানো হয় স্পেশালিস্ট হিটারদের। একেকজন বোলারকে তখন বল থ্রোয়ারই কল্পনা করে নেন তাঁরা। আর ঠিক এই সময়টাতেই ব্যাটসম্যানের ‘ক্রিয়া’য় প্রতিপক্ষের দরকার হয় বোলারের ‘প্রতিক্রিয়া’। যে কাজটা অনেকের চোখে মৃত্যুকূপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। হয় ব্যাটসম্যানকে কুপোকাত করে কূপে ফেলো, নয়তো নিজেই অতল গভীরে নিক্ষিপ্ত হও। আর ‘মারা বা মরা’র এই চ্যালেঞ্জেই কেউ হয়ে ওঠেন নায়ক, কেউবা খলনায়ক। ২০১৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেই যেমন শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের কাছে টানা চার ছক্কা খেয়ে ইংল্যান্ডকে বেদনার সাগরে ভাসিয়েছিলেন বেন স্টোকস। আবার ২০০৭ সালে প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে ভারতকে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় এনে দিয়েছিলেন যোগিন্দর শর্মা, যখন সমীকরণ ছিল ৪ বলে ৬ রানের।
পরবর্তী সময়ে পুলিশ হয়ে ওঠা যোগিন্দর সেদিন জোহানেসবার্গে ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনির ‘বাজি’। কিন্তু এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধোনির দেশ বাজি নয়, ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট নিয়েই মাঠে নামছে। রানবন্যা আর বোলারদের আর্তনাদের কথা উঠে এসেছে যে আইপিএলের সূত্রে, সেখানেই ব্যাটসম্যানদের জন্য রীতিমতো বিভীষিকা হয়ে উপস্থিত যশপ্রীত বুমরা। অ্যাকশন-ভিন্নতার জন্য আলাদাভাবে নজরকাড়া এই পেসার প্রথম ১১ ম্যাচে ডেথে বল করেছেন মোট ১৪.৫ ওভার। রান কত দিয়েছেন জানেন?
মাত্র ৯০, প্রতি ওভারে ৬.৭ রান করে! এ সময়ে উইকেটও নিয়েছেন ১০টি। বুমরা যে ডেথ ওভার বোলিংয়ে কতটা ভয়ংকর, সেটা বোঝাতে ভারতের বিশ্বকাপ দলে থাকাদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা অর্শদীপ সিংয়ের দিকে তাকানো যেতে পারে। আইপিএলে নিজের প্রথম ১০ ম্যাচে ডেথ ওভারে ৮ উইকেট পেলেও ১২.২ ওভারে ১২.৭৩ করে রান দিয়েছেন এই বাঁহাতি। ভারত অবশ্য বিশ্বকাপ ডেথ বোলিংয়ে নির্ভর করবে আরেক পেসার মোহাম্মদ সিরাজের ওপরও, যিনি আইপিএলে প্রথম ১০ ম্যাচে মাত্র ৩ উইকেট পেলেও ইকোনমি রেখেছেন ৮.৬৭-এ।
ভারতীয়দের ক্ষেত্রে আইপিএল যেমন, পাকিস্তানিদের বেলায় পিএসএল। শাহিন আফ্রিদি-মোহাম্মদ আমিররা অবশ্য অন্যান্য লিগেও খেলে থাকেন। পাকিস্তান যাঁদের নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে নামছে, তাঁদের মধ্যে আমিরই হয়ে উঠতে পারেন ডেথ বোলিংয়ের মূল নায়ক। চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক এক মাস আগপর্যন্ত ডেথ ওভারে সাড়ে বিশ ওভার বল করে আমিরের উইকেট ১২টি, ইকোনমি ৯.৩২। একই সময়ে আরেক বাঁহাতি পেসার শাহিনের শিকার ১০ উইকেট, তবে ইকোনমি প্রায় এগারো (১০.৮৮)। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১ মে সময়ে টি-টোয়েন্টি ডেথ বোলিংয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট আর সবচেয়ে বেশি ডট বল করা বোলারের নামটি অবশ্য অনেককে চমকে দিতে পারে—ক্রিস জর্ডান।
ইংল্যান্ডের ৩৫ বছর বয়সী এই বোলিং অলরাউন্ডার এ বছর ১৯টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ডেথ ওভারে করেছেন ২৭.১ ওভার। পিএসএল, বিগ ব্যাশ ও আইএলটি২০-তে খেলা ম্যাচগুলোতে ৮.৫০ ইকোনমিতে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ৫৩টি ডটও তাঁরই। সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর স্বীকৃত টি–টোয়েন্টিতেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা বোলারদের মধ্যে ডেথ ওভারে জর্ডানের উইকেট (৩৮) ও ডট বল (১৬০) সবচেয়ে বেশি। জর্ডানের এই ডেথ বোলিং সাফল্যই যে তাঁকে বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে দিয়েছে, সেটি দল ঘোষণার সময় স্পষ্ট করেই বলেছেন ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর অব ক্রিকেট রব কি। ইংল্যান্ডের সর্বশেষ সিরিজের দলে না থাকলেও ডেথ বোলিংয়ের জন্যই ক্রিস ওকসকে সরিয়ে বিশ্বকাপে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। টি-টোয়েন্টির বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা অবশ্য ডেথ বোলিংয়ের জন্য চোট থেকে ফেরা জফরা আর্চার আর স্যাম কারেনের দিকেও চেয়ে থাকবে।
ট্রফির দাবিদার হিসেবে মাঠে নামতে যাওয়া আরেক দল অস্ট্রেলিয়া ভরসা করবে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্কের ওপর। ২০২২ বিশ্বকাপের পর থেকে গত দেড় বছরে মাত্র ২টি করে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি খেলেছেন এ দুজন। অস্ট্রেলিয়ার ডেথ বোলিংয়ের দায়িত্বটা অনেকাংশেই ছিল নাথান এলিসের কাঁধে। যে দায়িত্বে বাঁহাতি এ পেসার ১২ ওভারে খরচ করেছেন সাড়ে এগারো রান, উইকেট ৫টি। বিশ্বকাপে তাই ডেথ ওভারে স্টার্ক, কামিন্সদেরই নিতে হবে মূল দায়িত্ব। দুজনের অভিজ্ঞতার ব্যাপার তো আছেই, স্টার্কের ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানের পা তাক করা জোরালো গতির ইয়র্কার আর কামিন্সের ক্ষেত্রে ম্যাচ ও ব্যাটসম্যানের গতি–প্রকৃতি পড়তে পারার গুণ ডেথ ওভারে তাদের এগিয়ে রাখবে।
ঠিক একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা আনরিখ নর্কিয়া ও কাগিসো রাবাদা, নিউজিল্যান্ড ট্রেন্ট বোল্ট ও জিমি নিশাম আর শ্রীলঙ্কা মাতিশা পাতিরানা ও নুয়ান তুষারার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশের টি–টোয়েন্টি ডেথ বোলিংয়ে নির্ভরতার নাম মোস্তাফিজুর রহমান। অনুকূল কন্ডিশন পেলে ‘কাটার মাস্টার’ ডেথ ওভারে ব্যাটসম্যানদের জন্য কেমন দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন, সেটা অনেকবারই দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এবারের আইপিএলে চেন্নাইয়ের হয়ে ১৪.২ ওভার বল করে ডট দিয়েছেন ৩১টি, উইকেট ৭টি। ডেথ ওভারে অন্তত ১০ ওভার বল করা বিদেশিদের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
তবে একটা জায়গায় মোস্তাফিজ, বুমরা, স্টার্ক হতে শুরু করে সবাইকে পেছনে ফেলে দিচ্ছেন আন্দ্রে রাসেল। ৩৬ বছর বয়সী এই ক্যারিবীয় পেসারই এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা ডেথ ওভারের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা আর সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া বোলার। ২০১২ সাল থেকে এ বছরের ১২ মে পর্যন্ত টি–টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ডেথ ওভারে (২২২ ইনিংসে) ২৭৫.৪ ওভার বল করে সাড়ে নয় ওভারই (৫৪৩) মেডেন নিয়েছেন রাসেল ১০.২৭ ইকোনমিতে উইকেট ১৪১টি। গত এক যুগে টি–টোয়েন্টি ইতিহাসে ডেথ ওভারে এর চেয়ে বেশি আছে একজনেরই (ডোয়াইন ব্রাভোর ২৬৬), যিনি এখন খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে ব্যস্ত।
বিশ্বকাপটা ওয়েস্ট ইন্ডিজে হবে বলে রাসেলকে আরও ধারালোরূপে দেখার সম্ভাবনা আছে যথেষ্টই। কিন্তু দিন শেষে তিনি হাসতে পারবেন তো! আট বছর আগে তাঁর স্বদেশি ব্রাফেট যেভাবে শেষ ওভারে স্টোকস আর ইংল্যান্ডের কাছ থেকে মুঠোয় থাকা জয় কেড়ে নিয়েছিলেন, তেমন কিছু দেখা যাবে না তো এবারও? ডেথ বোলিং বিশেষজ্ঞদের নায়ক কিংবা খলনায়ক হওয়ার যুদ্ধে সবাইকে স্বাগত।