বাবরের চোখধাঁধানো সেঞ্চুরিতে ম্যাচে ফিরল পাকিস্তান
৪১ ম্যাচে গড়ানো টেস্ট ক্যারিয়ারে ৭২ ইনিংসে তাঁর মাত্র সপ্তম সেঞ্চুরিই হলো। কিন্তু এরই মধ্যে বাবর আজম দুবার প্রশ্নটা তুলে দিতে বাধ্য করেছেন—এটিই কি টেস্টে তাঁর সেরা সেঞ্চুরি?
গত মার্চেই করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর ম্যাচ বাঁচানো ১৯৬ রানের ইনিংসটি এখনো চোখে লেগে আছে। মাস তিনেক যেতে না যেতেই গল টেস্টের দ্বিতীয় দিনে আজ আবার বিস্ময়ে মুগ্ধ করে রেখেছেন বাবর। ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি পেয়েছেন, তাতে শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে ২২২ রানের জবাবে পাকিস্তান ইনিংস শেষ করতে পেরেছে ২১৮ রানে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেঞ্চুরিটা করেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক, সেটি তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গল্প হয়েই থাকবে।
তা-ও এমন দিনে সেঞ্চুরিটা এল, যেদিনে ইনিংসে ২১ রান করার পথেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের মাইলফলক পেরিয়েছেন বাবর, সেটিও রেকর্ড গড়েই। মাইলফলকটাতে পাকিস্তান তো বটেই, এশিয়ার ব্যাটসম্যানদের মধ্যেই দ্রুততম বাবর (২২৮ ইনিংস), সব মিলিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে পঞ্চম দ্রুততম।
ক্রিকেট ইতিহাসে অবশ্য এর চেয়েও বড় দাগ রেখেছেন প্রবাত জয়াসুরিয়া। আজ তাঁর দাপটেই ৮৫ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল পাকিস্তান। এর পাঁচটিই জয়াসুরিয়ার। টেস্ট ইতিহাসে নিজের প্রথম তিন ইনিংসেই পাঁচ উইকেট পাওয়া তৃতীয় বোলার এই বাঁহাতি স্পিনার। তাঁর আগের দুজন অস্ট্রেলিয়া ক্ল্যারি গ্রিমেট ও ইংল্যান্ডের টম রিচার্ডসন।
কিন্তু বাবরের অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরির পর সব মাইলফলক যেন আড়ালেই পড়ে গেছে। শেষ ৬৪ রানই যে বাবর করেছেন ১১তম ব্যাটসম্যান নাসিম শাহকে সঙ্গী করে! নাসিম দারুণ সঙ্গ দিয়ে গেছেন বাবরকে। শেষ পর্যন্ত নাসিম অপরাজিত ছিলেন ৫২ বলে ৫ রানে। শেষ জুটিতে ৭০ রানই পাকিস্তানের ইনিংসে সর্বোচ্চ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি চতুর্থ উইকেটে বাবর-রিজওয়ানের ৪০ রানের।
জুটিতে রানের হিসাবে নাসিমের অবদান দিয়ে কিছু আসে-যায় না, রাজিতাকে চার মেরে ইনিংসে প্রথম রানই নাসিম করেছেন ৩৯তম বলে। রানটা করে যেভাবে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছেন, সেটিও দারুণ লাগার কথা সবার কাছেই। কিন্তু যেভাবে একের পর এক বল খেলে লঙ্কান বোলারদের হতাশ করেছেন, বাবরকে সময় আর নির্ভরতা জুগিয়েছেন, সেটিও মুগ্ধতা ছড়ানোর বিবেচনায় বাবরের সেঞ্চুরির চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে থাকবে না।
তবু দিন শেষে সব আলো তো বাবরের দিকেই থাকবে! কাল দিনের শেষ ভাগে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়েছিল, বাবর দিন শেষ করেছিলেন ১ রানে অপরাজিত থেকে। আজ দিনের তৃতীয় বলেই সঙ্গী আজহার আলীকে হারালেন, এরপর তাঁকে এক প্রান্তে অসহায় দর্শক রেখে রিজওয়ান, নওয়াজরা যেন বিদায়ের মিছিলে নেমেছেন। ৮৫ রানেই ৭ উইকেট হারায় পাকিস্তান। মধ্যাহ্নবিরতিতে যাওয়ার সময় রান ৭ উইকেটে ১০৪, বাবরের রান তখন ৩৪।
বাবরের বাইরে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আর তিনজন আজ দুই অঙ্কে যেতে পেরেছেন—রিজওয়ানের (১৯) পর নয় ও দশে নামা দুই ব্যাটসম্যান ইয়াসির শাহ (১৮) ও হাসান আলী (১৭)। অষ্টম উইকেটে বাবরের সঙ্গে ইয়াসিরের জুটিটা হলো ২৭ রানের, নবম উইকেটে হাসানের সঙ্গে ৩৬ রানের। তার মানে, শেষ তিনটি জুটিতে নিচের সারির তিন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে বাবর পাকিস্তানকে এনে দিয়েছেন ১৩৩ রান।
তিনটির মধ্যে শেষ জুটিই যে এত মুগ্ধতা ছড়াবে, তা কে অনুমান করতে পেরেছিল? বাবরকে ফেরাতে না পারলে সে ক্ষেত্রে মধ্যাহ্নবিরতির পর পাকিস্তানের লেজের দিকের তিন ব্যাটসম্যানকে ফেরানোর হয়তো পরিকল্পনা ছিল শ্রীলঙ্কার, পরিকল্পনার দুই-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন হয়ে যায় মধ্যাহ্নবিরতির ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। কিন্তু নাসিমকে নিয়ে বাবরের অসাধারণ লড়াইয়ের সেখানেই শুরু!
ইনিংসের ৬০তম ওভারের শেষ বলে হাসান আলী আউট হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ফিফটি পেয়েছেন বাবর (৯৮ বল, ৫ চার)। সেখান থেকে শেষ জুটিতে মূলত ওভারের শেষের দিকের এক-দুটি করে বলই দিয়েছেন নাসিমকে, তা না হলে শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রেখেছেন। ওভারের প্রথম তিন-চারটি বলের ক্ষেত্রে বল অনেক দূরে গেলেও রান নেননি। কিন্তু বাকি এক-দুই বলে তো নাসিমকে ঠিকমতো বলটা খেলতে হতো। তা নাসিম করেছেন, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া সাহসে ভর করে বাবর ইনিংস এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
ধীর গতিতেই এগিয়েছেন, জুটিতে প্রথম ১৬ ওভারে এসেছে ২৪ রান। কিন্তু টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে ব্যাটিং র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা বাবরের পরিস্থিতি বুঝে এমন টেস্ট ব্যাটিংও হয়তো তাঁর সব সংস্করণে মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার কথাই জানান দিয়েছে আরেকবার। এর মধ্যেও অবশ্য আগ্রাসনও ছিল। সেঞ্চুরির আগেই একবার রাজিতাকে টানা তিন চার মেরেছেন, ছক্কা মেরেছেন তিকশানার বলে।
মাঝে ৮০তম ওভারের শেষে নতুন বল এল, ঘূর্ণি পিচে তাতে স্পিনারদের দিয়েই জুটিটা ভাঙার চেষ্টা করেছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু হলো না। ৮৪ ওভার শেষে ৯ উইকেটে ১৯৪ রান নিয়ে চা বিরতিতে যায় পাকিস্তান। ওভারের শেষ বলটি নাসিম ঠেকিয়ে দিতেই বাবরের কী চাপা উচ্ছ্বাস! তাঁর সেঞ্চুরি তখন মাত্র ৫ রান দূরে, বিরতিটা তখন না এলেই হয়তো ভালো হতো তাঁর জন্য। কিন্তু সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই বাবরের! শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পাকিস্তান ব্যবধান যে তখন মাত্র ২৮ রানের, নবম উইকেট পড়ার সময়ও যেটি ছিল ৭৪ রানের!
চা বিরতির পর অবশ্য বাবরের সেঞ্চুরি পেতে সময় লাগেনি। বিরতি থেকে ফিরে দ্বিতীয় বলেই চার মারলেন তিকশানার বলে, তাঁর ইনিংসের দশম চার। এর পরের বলেই সিঙ্গেল। সেঞ্চুরি!
এরপর বেশিক্ষণ অবশ্য আর টিকতে পারেননি। জয়াসুরিয়ার দুই ওভারে একটি করে চার ও ছক্কা মেরেছেন, আগ্রাসনের ইঙ্গিত ছিল তাঁর ব্যাটে। কিন্তু ৯১তম ওভারের পঞ্চম বলে তিকশানাকে লেগ সাইডে ঠেলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টাতেই আউট। বল ব্যাটেই লাগেনি, প্যাডে লেগেছে। এলবিডব্লু। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি বাবর।
কিন্তু ২২৪ বলে ১১৯ রানের ইনিংসটিই যে ম্যাচে ভালোভাবে ফিরিয়ে এনেছে পাকিস্তানকে। দ্বিতীয় ইনিংসে নেমে দিমুথ করুণারত্নের উইকেট হারিয়ে ৩৬ রান নিয়ে দিন শেষ করেছে শ্রীলঙ্কা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা : ২২২ ও ১১.৫ ওভারে ৩৬/১ (ওশাডা ১৭*, করুনারত্নে ১৬, রাজিতা ৩*; নওয়াজ ১/১২)।
পাকিস্তান ১ম ইনিংস: ২১৮/১০ (বাবর ১১৯, রিজওয়ান ১৯, ইয়াসির ১৮, হাসান ১৭, শফিক ১৩, নাসিম ৫*; জয়াসুরিয়া ৫/৮২, মেন্ডিস ২/১৮, তিকশানা ২/৬৮, রাজিতা ১/৪২)।