ম্যাক্সওয়েল: বিগ শো থেকে দায়িত্ববান বাবা
মুম্বাইয়ে গত পরশু অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান ম্যাচ শেষে ক্রিকেট–বিশ্বে আলোচনার বিষয় একটিই—গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অপরাজিত ২০১। ম্যাক্সওয়েলের বীরত্বগাথায় আফগানদের মুঠো থেকে ম্যাচ ফসকে গেছে। তৃতীয় দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া উঠে গেছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
২১ চার, ১০ ছক্কায় সাজানো ১২৮ বলের ইনিংসটিকে অনেকেই ওয়ানডের সর্বকালের সেরার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে কৌতূহলও যেন বেড়েই চলেছে। বার্তা সংস্থা এএফপি ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে পাঁচটি অন্য রকম তথ্য দিয়েছে।
রীতিবিরুদ্ধ ব্যাটিং
সুইপ, রিভার্স সুইপ, ফ্লিক, স্ম্যাশ—তাঁর মন যখন যা চাইছে, ব্যাটও সেভাবেই চলছে। মাংসপেশির টান নিয়ে যতই ব্যথায় কাতর হয়েছেন, আফগান বোলারদের ব্যথা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন। এভাবেই পরশু নিজের প্রথম দ্বিশতক পূরণ করেছেন ম্যাক্সওয়েল, যা ওয়ানডে ইতিহাসে রান তাড়া করতে নেমেও প্রথম আর অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বড় মঞ্চে এমন পাগলাটে ব্যাটিং করে আসছেন বলেই তো তাঁর নাম হয়ে গেছে ‘ম্যাড ম্যাক্স’ বা ‘দ্য বিগ শো’। বিশ্বকাপের প্রধান সম্প্রচারকারী চ্যানেল স্টার স্পোর্টস পরশুর অতিমানবীয় ইনিংসটির পর তাঁকে সম্বোধন করেছে গ্লেন ‘সুপারম্যান’ ম্যাক্সওয়েল নামে। টুইটারে স্টার স্পোর্টস লিখেছে, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল একলা হাতে অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে তুললেন! এটা পরবাস্তব। অবাস্তব। এই ইনিংসের দুই সপ্তাহ আগেই নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪০ বলে শতক করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল, যা বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম।
চোটপ্রবণ
চোটের সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের সখ্য নতুন কিছু নয়। এই তো পরশু যে ইনিংস খেললেন, সেটাও চোট থেকে ফিরেই। আহমেদাবাদে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের কদিন আগে সতীর্থের সঙ্গে গলফ খেলতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে অসাবধানতাবশত চলন্ত গলফ কার্ট (একধরনের ছোট গাড়ি) থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। কনকাশন (মাথায় আঘাতজনিত) প্রটোকল মেনে তাঁকে ছয় দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। যে কারণে আফগানিস্তান ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে পারেননি। গত বছর ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ওয়ানডে সিরিজ শুরুর চার দিন আগে আরেকটি অদ্ভুতুড়ে চোটে পড়েন ম্যাক্সওয়েল। বন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপন করতে গিয়ে পা ভেঙে যায় তাঁর। জন্মদিন অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বন্ধুর সঙ্গে দৌড়ানোর সময় বাড়ির উঠানে পা পিছলে পড়ে যান। একটি ধাতব প্লেট তাঁর বাঁ পায়ে ঢুকে যায়। সেই চোট থেকে সেরে উঠতে পায়ে অস্ত্রোপচারও করাতে হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে সেই পায়ের অ্যাঙ্কেলে নতুন করে ব্যথা শুরু হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাননি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো বিশ্বকাপেও খেলতে পারবেন না। কিন্তু শতভাগ ফিট হয়ে ঠিকই ফিরেছেন।
সংসারী লোক
দীর্ঘদিনের প্রেমিকা বিনি রমনকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিনির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে গত বছরের মার্চে। সপ্তাহখানেক পর ভারতে এসে হিন্দু রীতিতে বিনিকে বিয়ে করেন। গত সেপ্টেম্বরে এই দম্পতির ঘর আলোকিত করেছে একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয়েছে লোগান মাভেরিক ম্যাক্সওয়েল। বিশ্বকাপে দ্রুততম শতকের আগের রাতটি নির্ঘুম কেটেছে বলে জানিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। সারা রাত তিনি পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন। পরশু রাতে ম্যাচ শেষে আবারও পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘যাঁরা আমাকে বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে আমি অভিভূত। এখন বাবার দায়িত্ব পালনের সময় এসেছে।’
মানসিক অবসাদ
২০১৯ সালের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া দল ছেড়ে চলে যান ম্যাক্সওয়েল। পরে জানা যায়, তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছেন। যে কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্রিকেট থেকে দূরে থাকবেন। ম্যাক্সওয়েলকে ‘বিশেষ খেলোয়াড়’ উল্লেখ করে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। বিরাট কোহলিও তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। ম্যাক্সওয়েল জানান, ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় তিনি মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে নিজের হাত ভাঙতে চেয়েছিলেন। তবে দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ায় দুই মাস পরই বিগ ব্যাশ লিগ দিয়ে ফেরেন এবং ওই টুর্নামেন্টের সেরা একাদশেও জায়গা করে নেন।
ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রিয়পাত্র
অলরাউন্ড দক্ষতার কারণে বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছে পছন্দের নাম ম্যাক্সওয়েল। নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ইংল্যান্ড ও ভারতের টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে তিনি বেশ জনপ্রিয়। বিগ ব্যাশ লিগের দল মেলবোর্ন স্টারসের হয়ে যেভাবে খেলে যাচ্ছেন, একইভাবে আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়েও আলো ছড়াচ্ছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তাঁকে ‘ডার্লিং অব আইপিএল অকশন’ (আইপিএল নিলামের প্রিয়তম) খেতাব দিয়েছে।
২০২১ সালে বেঙ্গালুরুতে নাম লেখানোর আগে দিল্লি ক্যাপিটালস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও পাঞ্জাব কিংসের হয়েও খেলেছেন তিনি। ইংল্যান্ডেও তিনি জনপ্রিয়। এখন পর্যন্ত পাঁচটি কাউন্টি দলের হয়ে খেলেছেন। দলগুলো হলো হ্যাম্পশায়ার, সারে, ইয়র্কশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার ও ওয়ারউইকশায়ার। এ ছাড়া দ্য হানড্রেডে খেলেছেন লন্ডন স্পিরিটের হয়ে।