সর্বকালের সেরা ওপেনারদের যেকোনো তালিকাতেই থাকে তাঁর নাম। কারণটা মূর্ত হয়ে আছে ১০৮ টেস্ট আর ১২৮ ওয়ানডের ক্যারিয়ার রেকর্ডেই। অভিষেকে ৯৩ ও ১০৭ দিয়ে শুরু টেস্ট ক্যারিয়ারে সাড়ে সাত হাজারের বেশি রান। ওয়ানডেতে ৫১৩৪ রানকে এখন যদি এমন কিছু মনে না-ও হয়; ব্যাটিং গড়টা এখনো চমকে দেওয়ার মতো—৪৫.০৩।
সত্তর ও আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বজয়ী দলের অন্যতম সদস্য। অন্যতম মানে তো ‘অনেকের মধ্যে একজন’। যা বললে সম্ভবত তাঁর একটু অমর্যাদাই হয়। বরং এভাবে বলা ভালো, তিনি ছিলেন তারকাখচিত সেই দলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তিন-চারজন তারকার একজন। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বিধ্বংসী এক ব্যাটসম্যান। এই পরিচয় তো সর্বজনীন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এসব ছাপিয়ে গর্ডন কাথবার্ট গ্রিনিজের অন্য একটা পরিচয়ই সম্ভবত সবচেয়ে বড়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা করা ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিজয়ী দলের কোচ।
গর্ডন গ্রিনিজ বাংলাদেশে এলেই তাই ফিরে আসে সেই স্মৃতি। ফিরে আসে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচ, কিলাত ক্লাব, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলা…। গর্ডন গ্রিনিজের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিচ্ছেদও বিশ্বকাপেই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচের আগে বরখাস্ত করার চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর হাতে। সেই তিক্ততা মন থেকে মুছে ফেলে এরপর নানা উপলক্ষে অনেকবারই এসেছেন বাংলাদেশে, যেটিকে তিনি বলেন ‘সেকেন্ড হোম’।
সর্বশেষ এলেন ঢাকা লিট ফেস্টের অতিথি হয়ে। কাল দুপুরে মঞ্চে তাঁর সঙ্গী সাবেক জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যান হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। সঞ্চালক হিসেবে থাকলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিকের অলরাউন্ডার ইউসুফ রহমান। ইউসুফ বাবু নামেই যাঁকে বেশি চেনে বাংলাদেশের ক্রিকেট। গ্রিনিজ আর মাসাকাদজাকে নিয়ে আয়োজিত এই পর্বের নাম ‘আই অন দ্য বল’।
ক্রিকেট নিয়ে আলোচনার জন্য যথার্থ নাম। তবে এখানে নামটা দ্ব্যর্থক। আগের দিন এই নামেই ইউসুফ রহমানের একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। বইয়ের বিষয় এই ভূখণ্ডে ক্রিকেটের ইতিহাস। বই প্রকাশের সেই অনুষ্ঠানেও অতিথি ছিলেন গ্রিনিজ ও মাসাকাদজা। লিট ফেস্টের আলোচনাও এই বইকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায় কি না, এমন একটা প্রশ্ন ছিল মনে। বইয়ের প্রসঙ্গ অবশ্য খুব কমই এল। একেবারে শেষে এক দর্শকের প্রশ্নের উত্তরেই যা একটু।
এর আগে অনুমিতভাবে গর্ডন গ্রিনিজই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। বললেনও দারুণ। এ সময়ের ক্রিকেট নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলার সুযোগ থাকার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বেছে নেওয়ার কারণ, ১৯৮৪ সালে লর্ডস টেস্টে অপরাজিত ২১৪ রানের অমর ওই ইনিংস…। যে ইনিংসের কল্যাণে দুই সেশন আর পনেরো মিনিটের মতো সময়ে ৩৪২ রানের লক্ষ্য তাড়া করার অসম্ভবও সম্ভব করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই জয়ও ৯ উইকেটে! তারপরও এটিকে নিজের সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি দিতে না চাওয়া থেকেই পরিষ্কার, গর্ডন গ্রিনিজের ক্যারিয়ারে এমন মণিমুক্তার কেমন ছড়াছড়ি!
সঞ্চালকের প্রশ্নে বাধ্য হয়ে ফিরে গেলেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালেও। লর্ডসের যে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়ে শুধু ক্রিকেট-বিশ্বকেই নয়, নিজেদেরও চমকে দিয়েছিল কপিল দেবের ভারত। ক্রিকেটে নাম-রেকর্ড এসবের কোনো মূল্য নেই, নির্দিষ্ট দিনে যে দল ভালো খেলে, সেই দলই জেতে—এসব আপ্তবাক্য মনে করিয়ে দেওয়ার পর গর্ডন গ্রিনিজ কপট বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘এ বড় অন্যায়। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ নিয়ে কেন প্রশ্ন করছ? ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ বিশ্বকাপ নিয়ে কেন নয়?’
১৯৭৫ ও ১৯৭৯ বিশ্বকাপ নিয়ে গ্রিনিজের কথা বলার আগ্রহের কারণ সম্ভবত আপনারও জানা। ওই দুটি বিশ্বকাপই জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তখন তো আর টি-টোয়েন্টির নামও কেউ শোনেনি। খেলা হতো শুধুই টেস্ট আর ওয়ানডে। দুটিতেই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের একচ্ছত্র আধিপত্য। শুধু সে কারণেই নয়, সব মিলিয়েই সেই সময়টাকে ‘ক্রিকেটের সেরা সময়’ বলে দাবি করলেন গর্ডন গ্রিনিজ। ছুড়ে দিলেন একটা চ্যালেঞ্জও, ‘সত্তর আর আশির দশকে ক্রিকেট তার সেরা সময় দেখেছে—এ নিয়ে আমি যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত।’ ক্রিকেট ইতিহাসের একটু মনোযোগী ছাত্রমাত্রই মানবেন, গ্রিনিজের এই দাবিকে নিজের সময়ই সেরা মনে করার চিরন্তন রোগ বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
আধুনিক ক্রিকেট নিয়ে গ্রিনিজের পর্যবেক্ষণও তা-ই। ক্রিকেটে যত আইন পরিবর্তন হয়েছে, সবই ব্যাটসম্যানদের পক্ষে। তারপরও ব্যাটসম্যানশিপের মান বেড়েছে কি না, এ নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ গ্রিনিজের। এত রকম সুরক্ষা সরঞ্জামে বলতে গেলে যুদ্ধসাজে সজ্জিত ব্যাটসম্যানদের শর্ট বল দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াতেই যার প্রমাণ দেখছেন তিনি। হেলমেট আসার পর ব্যাটসম্যানদের বলে আঘাত পাওয়া আরও বেড়েছে বলেই তাঁর ধারণা। বললেন, এ নিয়ে কেউ গবেষণা করে দেখলে মন্দ হয় না!
বিতর্কের ভয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন নিষিদ্ধই করে দিয়েছিলেন সঞ্চালক। তারপরও একটা প্রশ্ন হলো। যে প্রশ্নের মর্মার্থ—গ্রিনিজের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হাতে এখন অনেক টাকা। বাংলাদেশের ক্রিকেট কি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পেরেছে? সঞ্চালকের বাধা উপেক্ষা করে যেটির উত্তর দিলেন গ্রিনিজ, ‘ক্রিকেটের উন্নয়নে ঠিকমতো বিনিয়োগ করতে না পারলে টাকা দিয়ে কী হবে? সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো এসব ঠিক করে ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারলেই না টাকার সার্থকতা।’
বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এটাই তো আসল কথা।