বিশ্বকাপ এখন বাংলাদেশের
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! উনিশের যুবাদের হাত ধরে বিশ্ব জয় করল বাংলাদেশ। পচেফস্ট্রুমে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনালে চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা নিজেদের করে নিলেন আকবর আলী-পারভেজ হোসেন, শরিফুল ইসলামরা, তানজীব হাসানরা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ক্রিকেট দুনিয়াকে বার্তা দিয়ে রাখল—আমরা উঠে আসছি।
কী অসাধারণ ধৈর্যের না পরিচয় দিয়েছেন আকবর আলী। ক্যাপ্টেনস নক যাকে বলে সেটিই। রীতিমতো ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আকবর খেলে গেছেন। ৭৭ বলে ৪৩ রান করে তিনি আজ জাতীয় বীর। শেষের দিকে রকিবুলও কম যাননি। ভারতীয় বোলারদের বোলিং-তোপগুলো সামলে তিনি অধিনায়ককে সঙ্গ দিয়ে গেছেন অসাধারণ কৃতিত্বে। দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েই মাঠ ছেড়েছেন এ দুজন।
যশস্বী জয়সোয়ালের বলে সপ্তম উইকেট পড়ে যাওয়ার পর (পারভেজ হোসেন) মনে হচ্ছিল জয়টা দূর দিগন্তেই থেকে যাবে। তখনো জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩৫ রান। কিন্তু এ সময় আকবর নতুন কৌশল হাতে নেন। উইকেটে টিকে থাকতে হবে। হাতে বল অনেক। উইকেটগুলোই কেবল আগলে রাখতে হবে। আকবরের নতুন কৌশলে নিজেকে মিলিয়ে দেন রকিবুল। ভারতের প্রতিটি বল দেখেশুনে খেলেছেন তাঁরা। একপর্যায়ে টানা ২৫ বলে রানশূন্য ছিল বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে নিজেদের খোলস থেকে বের করেন এই দুই ব্যাটসম্যান। ওই মুহূর্তে অবশ্য বৃষ্টি আইন এগিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশকে। পচেফস্ট্রুমের বাংলাদেশি সমর্থকদের তখন কায়মন প্রার্থনা বৃষ্টির। তবে আকবর আর রকিবুল যেভাবে উইকেটে নিজেদের বেঁধে ফেলেছিলেন, তাতে দুর্ভাবনা খুব একটা ছিল না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন প্রয়োজনীয় রানটা খুব সহজেই নিয়ে নিতে পারবেন তাঁরা। কেবল টিকিয়ে রাখতে হবে উইকেট।
বৃষ্টি একপর্যায়ে এল। সে সময় বৃষ্টি আইনে ১৬ রান এগিয়ে বাংলাদেশ। খেলা আর শুরু না হলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন—এমন একটা সমীকরণ মাথায় নিয়েই ড্রেসিংরুমে ফিরল বাংলাদেশ। কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেল দ্রুতই। এবার নতুন লক্ষ্য ৩০ বলে ৭। বৃষ্টি শেষে মাঠে নেমে আকবর আর রকিবুল তেমন সময়ই নিলেন না। বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন বিশ্বজয়ের মঞ্চে।
বোলারদের দারুণ নৈপুণ্যে লক্ষ্যটা খুব বড় ছিল না। কিন্তু ১৭৮ রানের লক্ষ্যটাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের জন্য। কারণ রবি বিষনয় নামের এক লেগ স্পিনার। দারুণ ওপেনিং জুটির পর এই লেগ স্পিনারের ঘূর্ণিতেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। একে একে ফিরে গেলেন সেমিফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান তানজীদ হাসান, মাহমুদুল হাসান, তৌহিদ হৃদয় আর শাহদাত হোসেন—এবারের যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের এ ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবাই ছিলেন দারুণ ফর্মে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছিল সেট হয়ে যাওয়া ওপেনার পারভেজের চোট। পায়ের চোটে ভালো খেলতে খেলতেই মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। মূলত, শুশ্রূষার কারণে যে সময়টুকু পারভেজ মাঠে ছিলেন না, সে সময়টুকুতেই চাপ ভয়বাহভাবে চেপে বসে বাংলাদেশের ওপর।
পারভেজ খোঁড়াতে খোঁড়াতেই মাঠে নামলেন। দেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বারপ্রান্তে। চোট নিয়ে তিনি কীভাবে বসে থাকেন। তিনি মাঠে নামলেন। একাই লড়তে থাকা আকবর তখন সঙ্গী পেয়ে গেছেন। পারভেজ নিজের ইনিংসের দ্বিতীয় অংশটা খুব খারাপ করলেন না। দলের ওপর চেপে বসা ভয়াবহ চাপ তিনি সামলে উঠতে অধিনায়ককে দিলেন যোগ্য সঙ্গ। আকবর যদি বীর হন, তাহলে পারভেজও আজ কম যাননি। ২৩৫ মিনিট ব্যাটিং করে ৭৯ বলে তিনি করেছেন ৪৭। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৭টি বাউন্ডারির মার।
২০১৬ সালে ঘরের মাঠে যুব বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। শিরোপা জয়ের হট ফেবারিট হয়েও সেবার দূর থেকেই দেখতে হয়েছিল অন্যদের জয়োৎসব। এবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠতেই স্বপ্নটা আবার ডানা মেলতে শুরু করে। শেষ চারের লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনাল নিশ্চিত করেই লক্ষ্য ছিল একটাই—শিরোপা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন এক প্রজন্ম লক্ষ্যটাকে নিজেদের করে নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাটা জানিয়ে দিল দারুণভাবেই।