সাকিবের দুঃখে ৯৬, সুখে ৯৬
শেষ ওভারে যখন আর ৩ রান দরকার বাংলাদেশের, তখনো সাকিব আল হাসানের সেঞ্চুরির সম্ভাবনা অন্তত অঙ্কের হিসাবে ছিল। ব্লেসিং মুজারাবানির ওই ওভার শুরুর আগে সাকিব অপরাজিত ছিলেন ৯২ রানে, তিনিই ছিলেন স্ট্রাইকে। ওই ওভারে প্রথমে দুই রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রেখে পরে একটা ছক্কা মেরে দিলেই তো হতো!
কিন্তু সাকিব নিজেই অত হিসাবে গেলেন না। দলের জয় নিশ্চিত করতে চাইলেন আগে। প্রথম বলেই চার মেরে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সমীকরণ মিলিয়ে দিলেন। মিলল না শুধু তাঁর সেঞ্চুরির সমীকরণ। হলো না সাকিবের দশম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। বাঁহাতি অলরাউন্ডার অপরাজিত থেকে গেলেন ৯৬ রানে।
৯৬ - সংখ্যাটা সাকিবের ক্যারিয়ারে বিশেষ গুরুত্বই দাবি করবে। এ নিয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে চারবার ৯৬ রানে থেমেছে সাকিবের ইনিংস। হয় আউট হয়ে গেছেন, নতুবা ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুবার দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন, দুবার দলকে হারতে দেখেছেন সাকিব।
ঠিক ৯৬ রানে ইনিংস শেষ হয়েছে, এমন হিসাবে বিশ্বে সাকিবের চেয়ে এগিয়ে আর কেউ নেই। তাঁর সমান চারবার ৯৬ রানে থেমেছে জিম্বাবুয়েরই কিংবদন্তি গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের ইনিংস। ৩ বার ৯৬ রানে থেমেছেন পাঁচজন।
এই চারটি ইনিংসেই আরও চারটি করে রান হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের সেঞ্চুরি সংখ্যা ১৮টি হতো ঠিকই (এখন পর্যন্ত টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে সাকিবের সেঞ্চুরি ১৪টি)। অবশ্য সেভাবে হিসাব করলে তো সাকিব ক্যারিয়ারে নার্ভাস নাইন্টিজে থেমেছেন ৭ বার। কিন্তু নব্বইয়ের ঘরে থামা-না থামা কিংবা সেঞ্চুরির হিসাব নয়, সাকিবের ক্যারিয়ারে ৯৬ সংখ্যাটা আলাদা গুরুত্ব নিয়ে থাকবে ইনিংসগুলোর বিশেষত্বের কারণে।
আজকের ইনিংসটাই দেখুন। দশম ওভারের তৃতীয় বলে তামিম ইকবাল আউট হতে যখন ক্রিজে এসেছেন, ২৪১ রানের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশের রান ১ উইকেটে ৩৯। এরপর ১১ রানের মধ্যে লিটন দাস আর মোহাম্মদ মিঠুন ফিরলেন, ১৯তম ওভারের প্রথম বলে দলের রান ৭৫-এ থাকার সময় আউট মোসাদ্দেকও। সাকিবের রান তখন ২৯ বলে ১৯।
পঞ্চম উইকেটে মাহমুদউল্লাহ এসে ইনিংস মেরামতে সাকিবের সঙ্গী হওয়ার আশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ ২৬ রানে আউট হতে সে জুটি ভাঙল দলকে ১৩০ রানে রেখে, সাকিবের রান তখন ৪৭। বাংলাদেশের তবু তাড়াহুড়ো করার কিছু ছিল না। উইকেট কিংবা কন্ডিশনে ভয় ধরানো কিছু ছিল না। শুধু উইকেটে পড়ে থেকে ব্যাট করে যাওয়ার দরকার ছিল। সাকিবের দরকার ছিল একজন সঙ্গী। মেহেদি হাসান মিরাজ কিংবা (৬), আফিফ হোসেন (১৫) তা হতে পারলেন না।
বাংলাদেশ সপ্তম উইকেট হারায় ১৭৩ রানে। তখন জয় ৬৮ রান দূরে। ওভার হাতে তখনো ১১টি, কিন্তু উইকেট মাত্র তিনটি। সাকিব তখনো ৬২ রানে অপরাজিত, কিন্তু বাংলাদেশের এ বেলায় শঙ্কার মতো কিছু ছিল। জুটি যে হচ্ছিল না!
কিন্তু এতক্ষণ ধরে যেটির অপেক্ষায় ছিলেন সাকিব, অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ, তা হলো অষ্টম উইকেটে। সাকিবের ভরসা করার মতো সঙ্গীর অপেক্ষা মেটালেন সাইফউদ্দিন, বাংলাদেশের বড় জুটির অপেক্ষা মিটল তাতে। সাইফউদ্দিন দারুণ ব্যাটিংয়ে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকলেন ৩৪ বলে ২৮ রান করে, অষ্টম উইকেটে ৬৯ রানের জুটিতে ম্যাচ জিতে গেল বাংলাদেশ। সাকিব অপরাজিত থেকে গেলেন ৯৬ রানে, কিন্তু দল জেতায় সাকিবের সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ হয়তো খুব একটা হয়নি।
সাকিবের আরেক অপরাজিত ৯৬ তো বাংলাদেশের ইতিহাসই রাঙিয়েছে। ২০০৯, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংস। ২১৫ রানের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশ ৬৭ রানেই ৪ উইকেট হারায়। সেখান থেকে সাকিবের সঙ্গে রাকিবুল হাসানের (৬৫) জুটিতে ঘুরে দাঁড়ানো। সাকিব ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সে দলটা ভাঙাচোরা ছিল, কিন্তু সেই ম্যাচ জিতে সিরিজও জেতা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যরকম গুরুত্ব নিয়ে আছে। সেটি যে ছিল বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম কোনো টেস্ট সিরিজ জয়!
এ তো গেল দুবার ৯৬ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়া, সাকিব ৯৬ রানে দুবার আউটও হয়েছেন। সেখানে সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ম্যাচ হেরে যাওয়ার হতাশা! দুটিই ছিল টেস্টে, দুটি টেস্টই হয়েছে ঢাকায়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাকিব ৯৬ রানে আউট হয়েছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে। জয়ের জন্য ৫২১ রানের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশ মোহাম্মদ আশরাফুলের সেঞ্চুরি (১০১), সাকিব আর মুশফিকুর রহিমের (৬১) ফিফটিতে শেষ পর্যন্ত ৪১৩ রানে অলআউট হয়েছে।
পরের ঘটনাটা দেড় বছর পর। ২০১০ সালের মার্চে, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। এবারও দ্বিতীয় ইনিংসে সাকিব ৯৬ রানে আউট। এবার তামিম ইকবাল (৫২) আর সাকিবের ফিফটিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে করে ২৮৫ রান, ইংল্যান্ডের জন্য তাতে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২০৯ রানের। ৯ উইকেটে সেবার ম্যাচ জেতে ইংল্যান্ড!
সাকিব তাহলে একটা পণ করতে পারেন। ৯৬ রানেই যদি ইনিংস শেষ করতে হয়, নিশ্চিত করতে হবে যেন তিনি আউট না হন!