সবার ওপরে লক্ষ্মণের ২৮১
দিনের খেলা শেষ। রোদ কিন্তু মরে আসেনি। বাংলার ‘বিখ্যাত’ চৈত্র তখনো প্রখর রোদ অকৃপণ বিলিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গী রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন। দ্রাবিড়ের মতো তাঁর গলায়ও রুমাল মতন কিছু একটা পেঁচানো। দ্রাবিড়কে ক্লান্ত দেখাচ্ছে বেশি। অথচ পাঁচ সেশন ধরে ব্যাটিং করেও ভিভিএস লক্ষ্মণের মুখে এতটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই! বরং কী প্রাঞ্জল হাসি!
ঘাম তাঁরও ঝরেছে। তবে ঘাম ঝরিয়ে পানিশূন্য করে দিয়েছেন অস্ট্রেলীয়দেরই! পানির চেয়ে অস্ট্রেলিয়া তখন বেশি ভুগছে আত্মবিশ্বাস-শূন্যতায়। অথচ প্রথম ইনিংসে ২৭৪ রানের লিড পেয়ে ভারতকেই ফলোঅনের লজ্জায়ই ফেলেছিল স্টিভ ওয়াহর দল। কিন্তু শুরুতেই কলকাতা টেস্টের চতুর্থ দিন শেষের যে ছবিটা আঁকা হলো, ততক্ষণে সমীকরণ একেবারে উল্টে গেছে। প্রথম ইনিংসের সেই বিশাল ঘাটতি পুষিয়ে উল্টো ভারতই ২৭৬ রানে এগিয়ে। ভিভিএস লক্ষ্মণ এগিয়ে যাচ্ছেন প্রথম ভারতীয় হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরির দিকে।
আমার এক নম্বরেও লক্ষ্মণই
৬৯ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে ওই টেস্টেই প্রথম ভারতীয় হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছিলেন হরভজন সিং। না, ট্রিপল সেঞ্চুরির শূন্যতাও মুছে দেওয়া হয়নি লক্ষ্মণের। শেষ দিন প্রথম সেশনে আউট হয়েছেন মাত্র ১৯ রান দূরে থাকতে। কিন্তু তাঁর সেই ২৮১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তার চেয়েও বড় কথা, ক্রিকেট রোমান্টিকদের হৃদয়ে। সেটাই স্পষ্ট হয়ে গেল পুরো বিশ্বের ২৫ ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব, ক্রিকেট লেখক ও সাংবাদিকদের নিয়ে গড়া জুরিবোর্ডের বিচারে।
ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েব পোর্টাল ক্রিকইনফোর মাসিক অনলাইন সাময়িকী ‘ক্রিকেট মান্থলি’র বছর শুরুর সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে গত আধা শতাব্দীর সেরা ৫০টি পারফরম্যান্সের তালিকা। জুরিরা তাঁদের চোখে সেরা ১০টি পারফরম্যান্সের তালিকা জমা দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা ৫০। সেই ৫০-এর তালিকায় শচীন টেন্ডুলকারের একটি ইনিংসও জায়গা পায়নি। কিন্তু রেকর্ড বিচারে আরও অনেকের চেয়ে ঢের পিছিয়ে থেকেও সেরা পঞ্চাশের সবার ওপরে লক্ষ্মণের সেই ২৮১, সেটি আর শুধু তিন অঙ্কের একটা সংখ্যা হয়ে থাকেনি। ‘২৮১’ এখন ক্রিকেটীয় এক রূপকথা।
টেন্ডুলকার সেরা পঞ্চাশে জায়গা না পেলেও ব্রায়ান লারার সর্বোচ্চ ৪টি পারফরম্যান্স আছে এখানে। সেরা দশে অবশ্য লারার একটি ইনিংসই আছে। যদি ভেবে থাকেন সেটি তাঁর সেই অপরাজিত ৪০০, ভুল করবেন। এমনকি ৩৭৫-ও নয়; ১৯৯৯ ব্রিজটাউন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা অপরাজিত ১৫৩। সেরা দশে একমাত্র ইয়ান বোথামেরই আছে দুটি পারফরম্যান্স। বোথামের অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তনের গল্প হয়ে থাকা ১৯৮১ সালের হেডিংলি টেস্টে তাঁর ব্যাটে-বলে অস্ট্রেলিয়ার ‘ছাই’ হয়ে যাওয়া আছে দুইয়ে। সেই টেস্টেও ফলো অন করার পর জিতেছিল ইংল্যান্ড। ১৯৮০ মুম্বাই টেস্টের ‘অলরাউন্ডার’ বোথামের পারফরম্যান্স আছে পাঁচে।
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তালিকায় বোথামকে পেছনে ফেললেও পারফরম্যান্সের এই তালিকায় স্যার গ্যারি সোবার্স আছেন ১০ নম্বরে। সেরা দশে সর্বোচ্চ তিনজন আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালি সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে এই তথ্য: সেরা পঞ্চাশে সর্বোচ্চ ১৪টি কীর্তিই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের। এর মধ্যে লারার ৪টি, ভিভ রিচার্ডসের ৩টি, সোবার্স ও কার্টলি অ্যামব্রোসের ২টি করে। দল হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১টি পারফরম্যান্স আছে ভারতের।
এর মধ্যে সেরা দশে কেবল লক্ষ্মণ থাকলেও একটুর জন্য সেরা দশের বাইরে ছিটকে গিয়ে এগারোতে জায়গা করে নিয়েছে কুম্বলের ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি। কুম্বলে জায়গা না পেলেও সেরা দশে এ কালের ক্রিকেটারদের মধ্যে লক্ষ্মণ-লারা ছাড়াও আছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। সেরা পঞ্চাশে অবশ্য রাহুল দ্রাবিড়, কেভিন পিটারসেন, বীরেন্দর শেবাগ, শেন ওয়ার্ন, হরভজন সিংয়েরাও আছেন। তবে গত ১৫ বছরের মাত্র ৯টি পারফরম্যান্স জায়গা পেয়েছে এই তালিকায়। ক্রিকেট যতই আক্রমণাত্মক হোক, সৌন্দর্যপিপাসুদের মন জেতা অত সহজ নয়! এ কারণেই হয়তো ১৯৮০-এর দশকের ১৭টি পারফরম্যান্স জায়গা পেয়েছে সেরা পঞ্চাশে।
এই ক্রিকেট রোমান্টিকদের ২৫ জনের জুরিবোর্ডে ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলের মতো সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক। আরেকটি টেস্ট খেলতে ২২ বছর অপেক্ষার করার জন্য সুখ্যাত জন ট্রাইকস, ক্রিকেট ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যে বিশ্লেষক হিসেবে নজরকাড়া রাসেল আরনল্ড। ছিলেন কোচ জন রাইট। শিল্ড বেরি, টনি কোজিয়ার, গিডিয়ন হেইগ, সঞ্জয় মাঞ্জরেকার, রমিজ রাজাদের মতো ক্রিকেট লেখক, সাবেক ক্রিকেটার ও ভাষ্যকারেরা। ছিলেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক ও উইজডেন অ্যালামনাকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি উৎপল শুভ্র-ও।
গত ৫০ বছরের সেরা দশ টেস্ট পারফরম্যান্স
১
ভিভিএস লক্ষ্মণ
৫৯ ও ২৮১
(ভারত-অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, ২০০১)
২
ইয়ান বোথাম
৫০ ও ১৪৯*; ৬/৯৫ ও ১/১৪
(ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, হেডিংলি, ১৯৮১)
৩
মাইকেল হোল্ডিং
৮/৯২ ও ৬/৫৭
(ওয়েস্ট ইন্ডিজ–ইংল্যান্ড, ওভাল, ১৯৭৬)
৪
ব্রায়ান লারা
১৫৩*
(ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া, ব্রিজটাউন, ১৯৯৯)
৫
ইয়ান বোথাম
১১৪; ৬/৫৮ ও ৭/৪৮
(ইংল্যান্ড–ভারত, মুম্বাই, ১৯৮০)
৬
রিচার্ড হ্যাডলি
৫৪; ৯/৫২ ও ৬/৭১
(নিউজিল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়া, ব্রিসবেন, ১৯৮৫)
৭
বব ম্যাসি
৮/৮৪ ও ৮/৫৩
(অস্ট্রেলিয়া–ইংল্যান্ড, লর্ডস, ১৯৭২)
৮
মুত্তিয়া মুরালিধরন
৭/১৫৫ ও ৯/৬৫
(শ্রীলঙ্কা–ইংল্যান্ড, ওভাল ১৯৯৮)
৯
গ্রাহাম গুচ
৩৪ ও ১৫৪*
(ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, হেডিংলি, ১৯৯১)
১০
গ্যারি সোবার্স
১৭৪; ৫/৪১ ও ৩/৩৯
(ওয়েস্ট ইন্ডিজ–ইংল্যান্ড, হেডিংলি, ১৯৬৬)