ম্যাচটা আনুষ্ঠানিকভাবে যখন শেষ হলো, তখন দুই দলের মধ্যে ব্যবধান ৩৮ রানের। দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের মাঠে হারানোর অপেক্ষা ২০ বছর ও ২০তম চেষ্টায় শেষ হলো বাংলাদেশের।
ম্যাচ অবশ্য এর আগেই শেষ। ৩৮ তম ওভারে রাসি ফন ডার ডুসেনের যখন হঠাৎ ‘আত্মহত্যা’র ইচ্ছে হলো, তখন পর্দা গোটানোর শুরু। আর মেহেদী হাসান মিরাজ সে পর্দা পুরোপুরিই নামানোর ব্যবস্থা করলেন। ৪৬তম ওভারে মিরাজের বলে তেড়ে এলেন মিলার, কিন্তু বলের ফ্লাইট মিস করে ক্রিজের যেখানে আটকা পড়লেন, সেখান থেকে আর ফেরার উপায় থাকে না। ম্যাচের তখনো ২৭ বল বাকি, দক্ষিণ আফ্রিকাও অলআউট হয়নি। কিন্তু ম্যাচ শেষ তখনই।
রিভিউ নিয়ে কেশব মহারাজকে এলবিডব্লু করে মাহমুদউল্লাহর উল্লাস শুধু ব্যাপারটাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ৭ বল বাকি থাকতে ২৭৬ রানে অলআউট হয়ে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই হেরে বসেছে কদিন আগেই ভারতকে ধবল ধোলাই করা দক্ষিণ আফ্রিকা।
৪৫ ওভার শেষেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে থাকবে এটা দুই ঘণ্টা আগেও অকল্পনীয় ছিল। শরীফুল ইসলামের কাটার আর তাসকিন আহমেদের গতিময় দুটি বলে ৩৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে স্বাগতিক দল। লক্ষ্য যখন ৩১৫ রান, তখন ম্যাচটা তো একদিকে হেলেই পড়েছে, তাই না?
কিন্তু প্রতিপক্ষ দলে যে একজন রাসি ফন ডার ডুসেন আছেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তাঁর গড় ৭৫ এর ওপর। এর পেছনে একটি ছোট্ট বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ঘরের মাঠে তাড়া করতে নেমে ডুসেন কখনো আউট হননি!
একদিকে টেম্বা বাভুমা খুঁটি গাড়লেন, অন্যদিকে ফন ডার ডুসেন তার মতো ইনিংস গড়ে নিয়েছেন। একদিকে যেখানে বাভুমার মতো ব্যাটসম্যানও চাপ টের পাচ্ছিলেন, করছিলেন ছটফট; ওদিকে অবিশ্বাস্য শীতল ডুসেন। ঠান্ডা মাথায় ব্যাট করছেন, কোনো ঝুঁকি ছাড়া বাউন্ডারি আদায় করে নিচ্ছেন। শুধু সাকিব আল হাসানের বলেই একটু অস্বস্তি দেখা গেছে তাঁর মাঝে।
ইনিংসের মাঝপথেও তাই বাংলাদেশের ওপেনারদের দেখানো পথে এগিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। রান রেট বা লক্ষ্যের দিকে না তাকিয়ে আগে ভিত্তি গড়েছে। ৮৫ রানের জুটিটা শরীফুলের বাড়তি বাউন্স ও বাভুমার লাফিয়ে কাট করার সম্মিলনে থামল। এরপরও দক্ষিণ আফ্রিকার আশা শেষ হয়নি। কারণ, তখন উইকেটে এসেছেন ডেভিড মিলার।
মিলার নামতেই ডুসেন একটু রক্ষণাত্মক হয়েছেন। আক্রমণের দায়িত্ব পেয়ে দলকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন মিলার। কিন্তু ডুসেনের যে হঠাৎ চরিত্রবিরোধী কিছু করার ইচ্ছা হলো। ৮১ রানে থাকা অবস্থায় রান আউট হতে পারতেন। টিভি আম্পায়ারের আলসেমি সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু নিজের শেষ ওভার করতে আসা তাসকিনকে দেখে তাঁর কী জানি হলো। অফ সাইডের ওয়াইডের বল টেনে সুইপ করলেন, সেটা স্কয়ার লেগে অনেকটা দৌড়ে ঝাঁপ দিয়ে ধরে নিলেন ইয়াসির আলী। ঘরের মাঠে তাড়া করতে নেমে অবশেষে আউট হওয়ার স্বাদ পাওয়ার আগে ৮৬ রান করেছেন ডুসেন।
ইনিংসের শুরুতে টপ অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যানের পর সেট হওয়া ব্যাটসম্যানকেও বিদায় করেছেন তাসকিন। ৩৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের নায়ক তাই তাসকিন।
এরপরই আন্দিলে ফিকোয়াও নামলেন, এবং দলের বিপদ বাড়ালেন। ২ রানের ইনিংসে ১৩ বল খরচ করে, রানরেটকে প্রায় নাগালের বাইরে নিয়ে গেলেন। ৪২তম ওভারে যখন আউট হলেন ফিকোয়াও, সাড়ে ৯ এর রানরেট ১২-এর ওপরে চলে গেছে। ৮ ওভারে ১০৮ রান দরকার দক্ষিণ আফ্রিকার, এই অবস্থায় বোলিংয়ে এসেছেন শরীফুল। পানিশূন্যতায় পেশিতে টান পাওয়া পেসার তিন বলে ১৪ রান দিলেন। মিলারকে বেশ উল্লাসও করতে দেখা গেল, কিন্তু পরের তিন বলে মাত্র ৩ রান আবার নিয়ন্ত্রণ এনে দিল বাংলাদেশকে।
পরের ওভারেই মার্কো ইয়ানসেন সীমানায় ধরা পড়লেন মিরাজের বলে। রাবাদাও মিরাজের তৃতীয় শিকার বললেন সেই ওভারেই। ৬ ওভারে ৮৪ রানের আপাত-অসম্ভব এক লক্ষ্য তখন দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে। মোস্তাফিজের প্রথম বলটা চার মেরে নড়েচড়ে বসতে বললেন মিরাজ। কিন্তু বাকি পাঁচ বলে মাত্র ২ রান দিয়ে মোস্তাফিজ আবারও নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিলেন। মিরাজের একটি বাড়তি স্পিন ও বাউন্সের বলে ৭৯ রানের ইনিংসটি থামল। ৫৭ বলে ৮ চার ও ৩ ছক্কা মেরেছিলেন মিলার। কিন্তু যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল, বাউন্ডারি সংখ্যা দ্বিগুণ হলেই হয়তো শুধু আজ ম্যাচটা বের করতে পারত দক্ষিণ আফ্রিকা। মিলারের উইকেটসহ ৬১ রানে ৪ উইকেট পেয়েছেন মিরাজ।
২৪২ রান ৯ উইকেট হারানো স্বাগতিক দল এর পর হারের ব্যবধান কমিয়েছে। মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহর বল বেশ কয়েকবার সীমানাছাড়া করে কেশব মহারাজ ও লুঙ্গি এনগিডি শেষের বিনোদন দিয়েছেন।
বল হাতে আজ কোনো উইকেট পাননি সাকিব। তবু ম্যাচসেরার পুরস্কারটা তাঁর হাতেই গেছে। কারণটা বুঝতে হলে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তাকাতে হবে। সেঞ্চুরিয়নে আজ প্রতিপক্ষকে হতাশ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লিটন দাস ও তামিম ইকবাল। এ দুজনের রেকর্ড গড়া জুটি ৯৫ রান এনে দিলেও প্রায় ২২ ওভার শেষ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। তিনে নামা সাকিবের ইতিবাচক ব্যাটিং ম্যাচটা পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ২৯ রানের মধ্যে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার ধাক্কা তাই ওভাবে টের পায়নি বাংলাদেশ। ইয়াসির আলীর সঙ্গে ৮২ বলে ১১৫ রানের জুটিতেই প্রথম তিন শ ছাড়ানোর আশা জাগে।
৪ রানের মধ্যে সাকিব (৭৭) ও ইয়াসির (৫০) ফিরে গেলেও সে শক্ত ভিত্তিকে কাজে লাগাতে ভুল করেনি দল। মাহমুদউল্লাহ, আফিফ ও মিরাজের ছোট কিন্তু কার্যকর ইনিংসে শেষ ১০ ওভারে ৯১ রান তোলে বাংলাদেশ। আর তাতেই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জয়ের ভিত পেয়েছেন সাকিবেরা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ : ৩১৪/৭ (তামিম ৪১, লিটন ৫০, সাকিব ৭৭, ইয়াসির ৫০ ; ইয়ানসেন ২/৫৭, মহারাজ ২/৫৬)
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৪৮.৫ ওভারে ২৭৬ (ফন ডার ডুসেন ৮৬, মিলার ৭৯, বাভুমা ৩১ ; শরীফুল ২/৪৭, তাসকিন ৩/৩৬, মিরাজ ৪/৬১)