অবিস্মরণীয়! অবিশ্বাস্য!

দক্ষিণ আফ্রিকায় জেতা হয়ে গেল বাংলাদেশেরছবি: এএফপি

শুধু এক ওয়েস্ট ইন্ডিজই যা ছিল। দুবার তাদের মাটিতেই তাদের হারিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু এর মধ্যে প্রথমবার তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলটাকে তাদের দ্বিতীয় সারির দল বলে নাক সিঁটকানো মানুষই বেশি ছিল। ২০১৮-তে ক্যারিবীয় দ্বীপে জয়টাই যা কিছু ‘করে দেখানো’র স্বীকৃতি পায়। এর বাইরে দেশের বাইরে বাংলাদেশের সিরিজ জয় বলতে তো যা জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ই।

সেই বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জিতে গেল! দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে! যে মাটিতে উপমহাদেশের দলগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা কখনো জিততে পারেনি, ভারত জিতেছে একবার, পাকিস্তান দুবার...সেখানে এখন বাংলাদেশও বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারে। এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে সম্ভবত এই তথ্যও যে, ভারতও কদিন আগে সেখানে গিয়ে ওয়ানডে সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হেরে এসেছে।

তামিমের ব্যাটে আগ্রাসন ছিল দেখার মতো
ছবি: এএফপি

তা-ও কী দাপটেই না সিরিজটা জিতল! সেঞ্চুরিয়নে আজ তৃতীয় ওয়ানডেতে তাসকিন আহমেদের দারুণ বোলিংই বাংলাদেশের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকার ভিটেতে তাদের ১৫৪ রানের লক্ষ্যটা পেরোতে খুব বেশি কসরতের দরকার ছিল না। তামিম অতটুকুও আর বাকি রাখলেন না।

ইতিহাস রচনায় প্রথম অংশটুকু যদি রাঙিয়ে যায় তাসকিনের ৫ উইকেট, দ্বিতীয়াংশ রঙিন তামিমের চোখধাঁধানো ৮৭ রানের ইনিংসে। লিটনের সঙ্গে তামিমের ১২৭ রানের উদ্বোধনী জুটিতেই বাংলাদেশের জয় নিয়ে সব শঙ্কা উবে গেছে। শেষ পর্যন্ত লিটন আউট হলেও সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচটা বাংলাদেশকে ৯ উইকেটে জিতিয়ে, ইতিহাস রাঙিয়ে মাঠ ছাড়লেন তামিম।

হয়তো বাংলাদেশ বলেই, দক্ষিণ আফ্রিকা ১৫৪ রানে অলআউট হওয়ার পরও ইতিহাস নিয়ে নিঃসংশয় হতে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের বাধছিল। এমন জয়ের আশা জাগানো অবস্থানে থেকেও বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ধসে পড়ার গল্প তো আর নতুন নয়। খুব বেশি দূর যেতে হবে না, যে তাসকিন ওয়ানডে অভিষেকের পর আজ ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেলেন, তাঁর প্রথম ৫ উইকেটের ম্যাচটাই তো ভয় ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। মিরপুরে সেদিন ভারতকে ১০৫ রানে অলআউট করেও তো পরে বাংলাদেশ অলআউট হয়ে গেল ৫৮ রানে!

কিন্তু সেঞ্চুরিয়নের আজকের তাসকিন যেমন মিরপুরের সেদিনের তাসকিন নন, বাংলাদেশও তো আর ২০১৪ সালের সেই বাংলাদেশ নয়। ১৫৪ রানের লক্ষ্যটা যেভাবে পার করে ফেলা উচিত, সেভাবেই পার করে ফেলল বাংলাদেশ! ৯ উইকেট তো বটেই, ১৪১ বলও হাতে রেখে—জয়ের সময় বল বাকি থাকার হিসাবে গেলে প্রতিপক্ষের মাটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়!

লিটন দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন তামিমকে
ছবি: এএফপি

বল হাতে সে জয়ের ভিত যদি তাসকিন গড়ে দিয়ে থাকেন, সেটিতে সুন্দর সমাপ্তি এসেছে তামিমের ব্যাটে। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের ১৯৪ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক যেভাবে খেলেছেন, অনেকটা যেন সে ঢংয়েই আজ শুরু থেকেই খেলেছেন তামিম। ডি ককের মতো অত আগ্রাসী তো তামিম নন, তবু ৮২ বলে ৮৭ রানের ইনিংসটিতে যেন পুরোনো আগ্রাসী তামিমের ছোঁয়াও ছিল। কখনো রাবাদাকে এক ওভারে চারটি বাউন্ডারি মারলেন, কখনো শামসিকে হাঁটু গেড়ে সুইপ করছেন, তো কখনো দারুণ পাঞ্চে অফসাইডে চিরচেনা শট।

৮৭ রানের ৫৬-ই এসেছে ১৪টি বাউন্ডারিতে। শেষদিকে তো এসে বুঝি একটু আফসোসই হচ্ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা আরও কিছু রান করলে তো তামিমের শতকের রঙও মিশে যায় ইতিহাসের আনন্দে।

একটু হয়তো আফসোস ঝরেছে বাংলাদেশের জয়টা ১০ উইকেটের নয় বলেও। এত দারুণ খেলতে খেলতে অর্ধশতক থেকে মাত্র দুই রান দূরে আউট হয়ে গেলেন লিটন! মহারাজের বলটা অফস্টাম্পের বাইরে ফুল লেংথের ছিল, কাভারে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন লিটন, কিন্তু ব্যাটে-বলে ঠিকমতো হলো না।

ম্যাচ সেরা, সিরিজ সেরা দুটি পুরস্কারই তাসকিনের
ছবি: এএফপি

তাতে আফসোস জাগতে পারে, তবে মুগ্ধতা কমেনি একটুও। তামিম আগ্রাসী ছিলেন, কিন্তু তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে যাওয়ার কাজটা লিটন যেভাবে করলেন সেটিও কী কম প্রশংসার দাবিদার? বছর দেড়েক ধরে আস্তে আস্তে ব্যাট হাতে ধারাবাহিক হয়ে উঠছেন লিটন, গত এক বছরে টেস্টে নিজের জাত চিনিয়েছেন, প্রতিভার ছাপ এখন রাখছেন সাদা বলের ক্রিকেটেও। তামিমের সঙ্গে তাঁর জুটিতে যখন ১০০ পেরোল, ১২৫-ও হয়ে গেল, তখন তো মনে উঁকি দিচ্ছিল আরেকটি রেকর্ড—দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জুটির রেকর্ডটাও ভেঙে গেলেই তো হতো!

কী রেকর্ড? ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে তামিম আর সৌম্যর ১৫৪ রানের জুটিটাই সব সংস্করণ মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ, আজ তো দক্ষিণ আফ্রিকার রানও ছিল ১৫৪-ই! তামিম-লিটনের ব্যাটে সেটি পেরিয়ে গেলে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতো, কিন্তু না হওয়াতেও ক্ষতিবৃদ্ধি তো হয়নি! যা হয়েছে, তা-ই যে সোনায় মোড়ানো স্মৃতি।

সে পথে ভাগ্যও কি কিছুটা পক্ষে ছিল না বাংলাদেশের? ইনিংসের চতুর্থ বলেই একটা ক্যাচ হাতছাড়া হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার, তবে সেটি তামিমের নয়, লিটনের। তখনো বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে তখনো রান মাত্র ১, পয়েন্টে লিটনের সহজ ক্যাচ ফেলে দিলেন মহারাজ। দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বলে তামিমের প্রথম চার—বাংলাদেশেরও—এল ব্যাটের কানায় লেগে। চতুর্থ ওভারে এনগিডির বল তামিমের ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্পে ঢোকার পথে পায়ে লেগে ফিরে গেল।

তা একটু আহা-উহু না থাকলে আর ইতিহাস গড়ার রোমাঞ্চ কি থাকে! ভাগ্যও কি আর সবাইকে সঙ্গ দেয়। বাংলাদেশ আজ বিজয়ী, ভাগ্য বাংলাদেশ ছাড়া আর কাকে সঙ্গ দেবে!