তাসকিনের আইপিএলে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে...
জস বাটলারের খেলার খুঁটিনাটি সম্পর্কে বেন স্টোকসের যথেষ্ট জানাশোনা ছিল। দুজনই বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে একসঙ্গে খেলছেন। একজন আরেকজনের খেলা সম্পর্কে খুব ভালো জানবেন, বুঝবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের হয়ে ২০১৬ আইপিএল খেলে আসার পর চিত্রটা পাল্টে যায়। দুই মাসের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে আসা বাটলার কীভাবে যেন নিজেকে একেবারেই পাল্টে ফেলেছেন!
দীর্ঘদিনের সতীর্থের ক্রিকেটীয় দক্ষতার উন্নতি দেখে স্টোকসের চোখ ছানাবড়া! বাটলারকে দেখে স্টোকসও আইপিএল খেলতে আগ্রহী হলেন। পরের বছর থেকেই আইপিএলে নিয়মিত এই ইংলিশ তারকা, শুধু আর্থিকভাবে লাভবান হতে নয়, ক্রিকেটার হিসেবে নিজের দক্ষতায় উন্নতি আনতে। অথচ ১৫ বছর আগেও ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটকে ক্রিকেট-শিক্ষার শেষ অধ্যায় ধরা হতো। এখন ক্রিকেটাররা তাঁদের ক্রিকেট–শিক্ষা শেষ করে আইপিএল খেলেন।
তাসকিন আহমেদের কথাই ধরুন। দেড় বছর ধরে অবিশ্বাস্য ছন্দে আছেন এই ফাস্ট বোলার। নিজের খেলাটাকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া, ক্রিকেট–শিক্ষায় পরিপূর্ণতা পাওয়ার দারুণ এক সুযোগ ছিল তাসকিনের সামনে। আইপিএল দল লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টের ফাস্ট বোলার দরকার। কারণ, তাদের ইংলিশ ফাস্ট বোলার মার্ক উড কনুইয়ের চোটের কারণে আইপিএল থেকে ছিটকে পড়েছেন। তাঁর জায়গায় লক্ষ্ণৌ তাসকিনকে পুরো আইপিএল মৌসুমের জন্য দলে টানতে চাইল।
জানা গেছে, হুট করে আসা এই প্রস্তাবে তাসকিন ‘হ্যাঁ’ বলতেই চেয়েছিলেন। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আর্থিক নিশ্চয়তার একটা ব্যাপার তো থাকেই, সঙ্গে ক্রিকেটের শিক্ষার মেলায় যোগ দেওয়ার দারুণ এক সুযোগ। যেখানে বিশ্বের তারকা ক্রিকেটাররা প্রত্যেকেই একেকটি স্টল খুলে বসেছেন। তাসকিনের সুযোগ ছিল প্রতিটি স্টলে ঘুরে তাঁদের ক্রিকেটটাকে উল্টেপাল্টে দেখার। এতে পরবর্তী সময় লাভটা বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই হতো; সাকিব আল হাসানের মাধ্যমে যেমন এগিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
কিন্তু সম্ভাবনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাসকিনের পড়তে হয় কঠিন কিছু প্রশ্নের মুখে। দেশ বড় না আইপিএল? ক্রিকেটে টাকাই কি সব? টেস্ট ছেড়ে টি-টোয়েন্টিকে বেছে নিলেন তাসকিন?
প্রশ্নগুলো জোরালো হওয়ার কারণও আছে। বাংলাদেশ দল এখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের পর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও বাংলাদেশ দলের বোলিং আক্রমণের অন্যতম শক্তি তাসকিন। এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজও জিতেছে তাসকিনের সিরিজসেরা পারফরম্যান্সের সৌজন্যে। আর নিউজিল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ ড্র করার পর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও টেস্টে ভালো করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। তাসকিন সেখানেও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সে কারণে ‘দেশ নাকি আইপিএল’—এই দোটানা তাসকিনের জন্য কঠিনই ছিল। শেষ পর্যন্ত তাসকিন দেশকেই বেছে নিয়েছেন। একবার চিন্তা করুন…যদি তাসকিন আইপিএলই খেলতে চাইতেন, তাহলে দেশকে পছন্দের তালিকার দ্বিতীয়তে রাখার কারণে কত শত সমালোচনার তির্যক বাণ সইতে হতো তাঁকে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্রিকেটে অবশ্য এই সংঘাত একদমই নতুন নয়। ভিক্টর ট্রাম্পার পারিশ্রমিক না পাওয়ায় ধর্মঘট করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে না খেলে ল্যারি কনস্ট্যানটাইন ইংল্যান্ডে লিগ খেলতে গিয়েছিলেন। জেফ্রি বয়কটসহ একঝাঁক আন্তর্জাতিক তারকা টাকার জন্যই দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘রেভেল ট্যুর’ করেছেন।
ডব্লিউ জি গ্রেসের কথা নাহয় বাদই দিলাম। আধুনিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের মতো না হলেও গ্রেস ক্রিকেটটাকে ঠিক ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো করেই খেলেছেন। কাউন্টি, বিশ্ববিদ্যালয়, জেন্টেলম্যান বনাম অ্যামেচার্স—ইংল্যান্ডে এমন কোনো পর্যায়ের ক্রিকেট ছিল না, যেখানে গ্রেস খেলেননি। তিনি ছিলেন অ্যামেচার ক্রিকেটার। কিন্তু তিনি পারিশ্রমিক নিতেন পেশাদার ক্রিকেটারদের থেকেও বেশি। খেলার জন্য গ্রেসের টেবিলের নিচ দিয়েও টাকা গ্রহণ করার গল্প প্রচলিত আছে। আর্থিক কারণে সুযোগ থাকার পরও ইংল্যান্ডের হয়ে সব ম্যাচ না খেলে খেলতেন বিভিন্ন প্রীতি ম্যাচে।
অথচ ক্রিকেটের বিশুদ্ধবাদীদের তালিকায় গ্রেস-ট্রাম্পারদের নাম ওপরের দিকেই থাকবে। আরও আধুনিক যুগে এলে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের কথা বলতেই হয়। আর্থিকভাবে লাভবান হতে দেশের ক্রিকেট বাদ দিয়ে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট খেলেছেন আধুনিক ক্রিকেটের অনেক কিংবদন্তিই। কারণ, পেশাদার ক্রিকেটার মানেই টাকা।
ক্রিকেটের এই দ্বন্দ্ব ২০০ বছর পুরোনো। আইপিএলের কারণে সামনেও এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে লড়তে হবে ক্রিকেটার, ক্রিকেট পরিচালকদের। একবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের কথাই ধরুন। এত দিন সাকিব ছিলেন এই দ্বন্দ্বের মধ্যমণি। মোস্তাফিজুর রহমান টেস্ট ক্রিকেটে নিয়মিত নন, তাই তাঁকে নিয়ে এখনো তেমন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। দুই বছর আগে আফিফ হোসেনেরও ডাক পড়েছিল ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলার, কিন্তু জাতীয় দলের খেলা থাকায় আফিফেরও সেবার সিপিএল খেলা হয়নি। নতুন উদাহরণ হিসেবে তাসকিন তো আছেই।
ভবিষ্যতেও এই সমস্যা আরও বড় আকার ধারণ করবে। আইপিএলে দল বেড়েছে। চাহিদা বেড়েছে। টাকা বেড়েছে। দুই মাসের ক্রিকেটের জন্য টিভি সম্প্রচার স্বত্ব থেকে যে টাকা আসে, তা পৃথিবীর কোনো ক্রিকেট বোর্ড এক বছরেও আয় করে না। কেউ যদি ভেবে বসে থাকে যে আইপিএল ১০ দল, ২ মাসের ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
আইপিএল আগামী ১০ বছরে আরও বড় হবে। ক্রিকেটারদের চাহিদাও বাড়বে সমান্তরালে। তাসকিনের মতো অনেকেরই ডাক পড়বে টাকায় ঠাসা এই লিগে। ক্রিকেটাররাও আর্থিক ও ক্রিকেটীয় শিক্ষার জন্য আইপিএলে যেতে চাইবেন। বিসিবি কত দিন তাসকিনদের আটকে রাখবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।