চলুন ঘুরে আসি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সেই 'স্টিভ ওয়াহর ম্যাচ'
আচ্ছা, আপনাদের কি কখনো এমন হয়, কোনো স্মৃতি এমনভাবে মনে গেঁথে যায় যে, মনে হয়, 'এই তো সেদিন, এখনো সব চোখে ভাসছে।' তারপর হিসাব করতে বসে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেন, ওই দৃশ্য বা ঘটনা অনেক অনেক দিন আগের কথা। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, তাই নাকি, এত বছর চলে গেছে মাঝখানে!
১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের কথা ভেবে আমার কিন্তু এমনই মনে হচ্ছে। এ-কু-শ বছর! এতদিন আগের কথা! বছর না ঘুরতেই যেখানে কত স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে যায়, সেখানে এই ম্যাচের আগে-পরের এত সব দৃশ্য কীভাবে চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে? তা না নয় হলো, কিন্তু হঠাৎ করে এই ম্যাচের কথা কেন মনে পড়ল, সেটা তো বলা দরকার। উপলক্ষ একটা আছে। ক্রিকইনফোর 'অন দিস ডে'-তে গিয়ে দেখি, ২১ বছর আগে আজকের এই দিনেই হয়েছিল এই ম্যাচটা। সঙ্গে সঙ্গেই মনে ওই স্মৃতির মিছিল!
আগে একটা ভুল ভাঙিয়ে নিই। অনুমান করি, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ আর অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা শুনেই আপনি ভাবতে শুরু করেছেন এজবাস্টনের সেই সেমিফাইনালের কথা। 'টাই'য়ে শেষ হওয়া সেই মহাকাব্যিক সেমিফাইনাল সর্বকালের সেরা ওয়ানডে হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রবল দাবিদার। তবে আমি সেটির কথা বলছি না। বলছি এজবাস্টনের ওই সেমিফাইনালের চার দিন আগে লিডসের হেডিংলিতে এই দুই দলের সুপার সিক্সের ম্যাচটির কথা। এজবাস্টনের আলোকচ্ছটায় যে ম্যাচ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। স্টিভ ওয়াহর ম্যাচ!
স্টিভ ওয়াহরই! টেলিভিশনে দেখার কথা বাদই দিলাম, বিশ্বকাপের প্রেসবক্সে বসে দেখা স্মরণীয় ইনিংসের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। মনে মনে সেসব সাজাতে গিয়ে দেখি, বেশির ভাগই দেখি খেলা হয়েছে ফাইনালে। লাহোরে অরবিন্দ ডি সিলভা, জোহানেসবার্গে রিকি পন্টিং. ব্রিজটাউনে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ওয়াংখেড়েতে মহেন্দ্র সিং ধোনি....। কিন্তু যখনই মাঠে বসে দেখা বিশ্বকাপের সেরা ইনিংস বেছে নিতে যাই, শিরোপার মীমাংসা করে দেওয়া এ সব ইনিংস ছাপিয়েও সামনে এসে দাঁড়ায় হেডিংলির ওই ম্যাচে স্টিভ ওয়াহর অপরাজিত ১২০।
সর্বোচ্চ ইনিংস সবার চোখেই সর্বোচ্চ। 'সেরা'র ঘটনা তা নয়। একেকজনের বিচারে তা একেক রকম। স্টিভ ওয়াহর ওই ইনিংসটিকে সেরার স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ তাই ব্যাখ্যা দাবি করে। চার-ছয়ের ফুলঝুরি, স্ট্রোক প্লের ছটাতেও একটা ইনিংস স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। সেটি আপাত গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেই বা কি! তবে কোনো ইনিংসের সর্বোতভাবে গ্রেট ইনিংসের মর্যাদা পেতে আরও কিছু জিনিস বিবেচনায় নিতে হয়। ম্যাচের গুরুত্ব, সেটির প্রেক্ষাপট, কোন পরিস্থিতিতে সেটি খেলা হয়েছে, সেটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব...। স্টিভ ওয়াহর ওই অপরাজিত ১২০-কে দেখতে হবে এসবের আলোকেই।
দক্ষিণ আফ্রিকা আগেই উঠে গেছে সেমিফাইনাল। আর অস্ট্রেলিয়ার জন্য এই ম্যাচ কার্যত কোয়ার্টার ফাইনাল। সেমিফাইনালে উঠতে হলে এই ম্যাচে জিততেই হবে---এটা দলীয় সমীকরণ। ২৭২ রান তাড়া করতে নেমে ৪৮ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর স্টিভ ওয়াহ যখন ব্যাটিং করতে নেমেছেন, তখন শুধু অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ-ভাগ্য নয়, তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ওপরও ঝুলছে ডেমোক্লিসের খড়গ। লিডসে এসেই প্রধান নির্বাচক ট্রেভর হনসের সঙ্গে অধিনায়কের জরুরি মিটিং হয়েছে। যেটিতে হনস মোটামুটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ জিততে না পারলে শুধু অধিনায়কত্বই যাবে না, স্টিভ ওয়াহকে বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দলও নামবে নতুন পথের সন্ধানে। ম্যাচ জেতানো ওই ১২০ রানই শুধু স্কোরকার্ডে লেখা আছে। এই বিষম চাপ সেখানে লেখা নেই। এই দুটো যোগ করে নিলে কিছুটা বুঝতে পারবেন ওই ইনিংসের মাহাত্ম্য।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা ভাবলে যা আরও বেড়ে যাবে। দুই বল বাকি থাকতে ওই জয়ে নেট রান রেটের সুক্ষ্ম ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপরে থাকায় সেমিফাইনালে ওই 'টাই'য়ের পরও ফাইনালে উঠে গেছে অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়া যে ফাইনালের মাধ্যমে শুরু বিশ্বকাপে অস্ট্রেলীয় রাজত্বের। প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র দল হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের হ্যাটট্রিকের ভিত্তিও গড়ে দিয়েছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। একটু স্বাধীনতা নিয়ে বললে, স্টিভ ওয়াহর ওই ইনিংস।
স্টিভ ওয়াহর দলের বিশ্বকাপ জয়ের পুরো মহিমা বুঝতে আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে। দুর্দান্ত কামব্যাকের গল্পটা না হলে আড়ালে থেকে যাবে। ফেবারিট হিসাবে শুরু করে প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র একটি জয়, সেটিও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার সুপার সিক্সে ওঠাই তখন অনিশ্চিত। পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটাও হয়ে দাঁড়িয়েছে মহা গুরুত্বপূর্ণ। ডারহামের চেস্টার লি স্ট্রিটে সেই ম্যাচের আগের দিনের ্একটা ছবি এখনো চোখে ভাসে। কানে বাজে ওই কথাটা। মাথায় তেরচা করে বসানো ব্যাগি গ্রিন, ঠোঁটের কোনায় দেখা যায় কি যায় না এমন একটা হাসির রেখা। এক্স রে দৃষ্টির ওই চোখ আমার চোখে রেখে স্টিভ ওয়াহ বলছেন, 'খুব বেশি দেরি নেই, আপনিই আমাকে অন্য প্রশ্ন করবেন।'
তা সেদিনের প্রশ্নটা কী ছিল? প্র্যাকটিস শেষে স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ করে নিয়েছি আমরা বাংলাদেশের দুই সাংবাদিক। প্রথম প্রশ্নটাই করেছি অস্ট্রেলিয়ার দুর্দশা নিয়ে। নিজেদের দেশে ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফেবারিট হিসাবে শুরু করেও সেমিফাইনালের আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া। এবারও কি তাহলে প্রত্যাশার চাপই অস্ট্রেলিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল?
প্রশ্নটিতে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, উত্তরে এমন কোনো ঝাঁজ ছিল না। বরং স্টিভ ওয়াহর বলার ভঙ্গিটা এমন, যেন সাধারণ কোনো তথ্য জানাচ্ছেন। তথ্যটা যে ভবিষ্যদ্বাণীর রূপ নিচ্ছে, সেটি তাঁর ভালোই জানা এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্যি হবে, এ নিয়েও ভবিষ্যদ্বক্তার মনে যেন বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। এরপর বিশ্বকাপ যত এগিয়েছে, বারবারই মনে হয়েছে স্টিভ ওয়াহর ওই কথা। 'খুব বেশি দেরি নেই, আপনিই আমাকে অন্য প্রশ্ন করবেন।' সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে ১৩ জুনের হেডিংলিতে।
আগের দিনের কথাটা আগে বলে নেওয়া ভালো। কখনো কখনো অবাস্তব মনে হওয়া স্টিভ ওয়াহর প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আরেকটু পরিচয় হবে। প্র্যাকটিস শেষে মাঠে দাঁড়িয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। অনেক কথাই বললেন, তবে শুরুতেই বলে নিলেন--'আমরা সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছি।' ঘোষণার সুরে বলা ওই কথাটা এখনো মনে আছে, আর মনে আছে আরেকটি ঘটনা।
পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে স্টিভ ওয়াহর দিকে চোখ নাচিয়ে রসিকতা করলেন শেন ওয়ার্ন, 'কী বলছ ওদের, কাল আমাকে নাম্বার থ্রিতে ব্যাটিং করতে পাঠাবে?'
স্টিভ ওয়াহ শুধু মৃদু হাসলেন। তারপর অপসৃয়মান শেন ওয়ার্নের দিকে তাকিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, 'কাল ও-ই হবে আমার মূল অস্ত্র।'
এক সাংবাদিক নোট নেননি দেখে তাঁকে বললেন, 'কী ব্যাপার, আপনি এটা লিখলেন না যে! ক্যাপিটাল লেটারে লিখবেন, কালকের ম্যাচে শেন ওয়ার্ন-ই হবে আমার ট্রাম্প কার্ড।'
তখন পর্যন্ত সেই বিশ্বকাপে ওয়ার্ন শুধু নামেই ওয়ার্ন। কাঁধে অস্ত্রোপচারের রেশ তখনো যায়নি, কিছুদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথমবারের মতো বাদ পড়েছেন টেস্ট দল থেকে, আর ক্যারিয়ার জুড়ে ছায়ার মতো নিত্যসঙ্গী নানা বিতর্ক তো আছেই। 'শুধুই অতীতের সুনাম সম্বল করে খেলে যাওয়ায়' অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে তাঁকে। স্টিভ ওয়াহর ওই কথাটা তাই শুধুই কথার কথা ছিল না, সেটি ছিল ওয়ার্নের পিঠে হাত রেখে তাঁকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা। কয়েক বছর ধরেই শেন ওয়ার্ন যখন কারণে-অকারণে স্টিভ ওয়াহ সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেন, তখন এটি খুব মনে পড়ে। পরদিন শেন ওয়ার্ন চার বলের মধ্যে ড্যারিল কালিনান ও হানসি ক্রনিয়ে নামক দক্ষিণ আফ্রিকান মিডল অর্ডারের দুই স্তম্ভকে ভেঙে দেওয়ার সময়ও মনে পড়েছিল। মনে পড়েছে সেমিফাইনাল ও ফাইনালে তাঁকে স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করতে দেখেও।
তবে হেডিংলির এই ম্যাচে স্টিভ ওয়াহ ছাড়া বাকি সবাই তো পার্শ্ব চরিত্র। এমনকি দারুণ এক সেঞ্চুরি করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২৭১ রানের 'পাহাড়ে' তুলে দেওয়া হার্শেল গিবসও। গিবসকে ছাড়া অবশ্য এই ম্যাচের গল্প সম্পূর্ণ হয় না। তবে সেটির কারণ তাঁর সেঞ্চুরি নয়। গ্যালারি শো করতে গিয়ে তাঁর ওই ক্যাচ ফেলে দেওয়াটাই বরং তাঁকে অমর করে রেখেছে বিশ্বকাপ ইতিহাসে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের অবশ্যই যাতে বড় অবদান। অবদান আছে ৫৬ রানে নতুন জীবন পেয়ে স্টিভ ওয়াহর সেই বিখ্যাত উক্তিরও, 'তুমি তো বিশ্বকাপটাই ফেলে দিয়েছ হে!' শুনতে খুব ভালো শোনালেও স্টিভ ওয়াহ আসলে এটা বলেননি। তিনি বলেছিলেন, 'হেই হার্শেল, তুমি যে তোমার দলকে ম্যাচটা হারিয়ে দিলে, এটা বুঝতে পেরেছ তো?'
গিবসের সঙ্গে শুরু থেকেই কথার লড়াই না চললে হয়তো এটাও বলতেন না। স্টিভ ওয়াহ ব্যাটিং করতে নামতেই গিবস তাঁকে বলেছেন, 'এবার তোমার পালা। এবার দেখব, তুমি কেমন চাপ সামলাতে পারো।' 'তোমার পালা' বলার কারণ আছে। গিবস ব্যাটিং করার সময় তাঁর কান ঝালাপালা করে ফেলেছে অস্ট্রেলীয়রা। আর স্টিভ ওয়াহ যে এসবেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, এটা কে না জানে!
হার্শেল গিবসের যে ভুলে ওই বিশ্বকাপের গল্পটাই বদলে গেল, সেটির ফায়দা নেওয়ায় কিন্তু শেন ওয়ার্নের অবদান আছে। আগের রাতের টিম মিটিং যখন শেষ হতে যাচ্ছে, তখন ওয়ার্ন বলেছেন, গিবসের কাছে কোনো ক্যাচ গেলে ব্যাটসম্যানরা যেন অপেক্ষা করে। কারণ দেখনদারি করতে গিয়ে ক্যাচ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বল ফেলে দেওয়ার অভ্যাস আছে তাঁর। একটু হাসাহাসিও হয়েছিল ওয়ার্নের ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে। কিন্তু স্টিভ ওয়াহ কথাটা ঠিকই মনে রেখেছিলেন।
স্টিভ ওয়াহর ওই ইনিংসের বিস্তারিত বর্ণনায় আর না-ই যাই। তবে দুটি শটের কথা না বলে পারছি না। একটা অ্যালান ডোনাল্ডের বলে স্কয়ার ড্রাইভ। রবি শাস্ত্রীর ভাষায় বল ট্রেসার বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে অ্যাডভার্টাইজিং বোর্ডে লেগে যখন আবার মাঠে ফিরে এসেছে, ডোনাল্ড ফলো থ্রুও শেষ করতে পারেননি। এর চেয়েও বেশি মনে পড়ে অন্য একটি শট। নতুন বলের আরেক বোলার স্টিভ এলওর্দিকে মারা স্লগ সুইপটি মিড উইকেটের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল গ্যালারির দর্শকারণ্যে। এতদিন পরও শটটি মনে থাকার আসল কারণ অন্য। এটি মারতে গিয়ে ক্রিজে শুয়ে পড়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ। যা দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল রোহান কানহাইয়ের বিখ্যাত সেই 'ফলিং সুইপ'-এর কথা। সুইপ করতে গিয়ে ক্রিজে পড়ে যাওয়ার অভ্যাস ছিল কানহাইয়ের। ১৯৭১ সালে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাওয়ার সময় যা দেখতে উন্মুখ হয়ে ছিলেন তরুণ সুনীল গাভাস্কার।
মাঠের দর্শকেরা তো বটেই, স্টিভ ওয়াহর ওই ইনিংস টেলিভিশনে লাইভ দেখেছেন আরও কত লক্ষ লক্ষ দর্শক। কপালগুণে বাড়তি কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। ওই ম্যাচের পর আর হেডিংলিতে যাওয়া হয়নি। প্রেসবক্স আর ড্রেসিংরুমের ওই সহাবস্থান এখন আর আছে কি না, সেটি তাই জানি না। তখন দুই দলের জন্য ব্যালকনি ছিল একটিই। প্রেসবক্সটা সেই ব্যালকনির গায়ে লাগানো। প্রেসবক্সের যে প্রান্তটা ওই ব্যালকনিতে গিয়ে মিশেছে, আমার আসন বরাদ্দ হয়েছিল সেখানে। মাত্র পাঁচ/ছয় হাত দূরে বসেছেন ক্রিকেটাররা, মাঝখানে শুধু একটা কাচের দেয়াল। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরু থেকেই বলের ফাঁকে ফাঁকে আমি শুধু স্টিভ ওয়াহকেই দেখছিলাম। মার্ক ওয়াহ ও অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ইনিংস ওপেন করতে নামার সময়ই বাকি সতীর্থদের সঙ্গে ব্যালকনিতে এসে বসেছেন। মুখে টেনশনের লেশ মাত্র নেই। কথাবার্তা কানে আসছে না, তবে ভাবভঙ্গি আর হাসি দেখে মনে হচ্ছিল, মহা আনন্দে আছেন তিনি। কখনো কারও কথা শুনে হাসছেন, কখনো বা নিজেই কোনো রসিকতা করছেন। নেমেছেন পাঁচ নম্বরে, তারপরও প্রথম উইকেট পড়ার পরই উঠে ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন ফিরে এলেন, প্যাড-ট্যাড পরা হয়ে গেছে। এক হাতে ব্যাট, আরেকহাতে হেলমেট, বসলেন আগের চেয়ারেই। কিন্তু আগের সেই স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে এই স্টিভ ওয়াহর কোনো মিল নেই। মুখে আর হাসি নেই। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে, কখনো শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য তা ঘুরে আসছে স্কোরবোর্ড থেকে। ষষ্ঠ ওভারে দলকে ২০ রানে রেখে ফিরে এলেন ফর্ম থাকা মার্ক ওয়াহ। স্টিভ ওয়াহর চোয়ালটা যেন আরও শক্ত দেখাল। পাশে বসে থাকা ব্রেন্ডন জুলিয়ান, টম মুডি, ড্যারেন লেম্যানরা হয়তো পরিস্থিতি হালকা করতেই ইয়ার্কি-ফাজলামো করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু স্টিভ ওয়াহ সে সব আদৌ শুনলেন কি না সন্দেহ হলো। স্টিভ ওয়াহ ততক্ষণে 'জোন'-এ ঢুকে গেছেন। মনে মনে হয়তো আওড়াচ্ছেন আগের দিন ওয়ার্ম আপের পর কোত্থেকে জোগাড় করে সতীর্থদের শোনানো অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সেই কবিতাটা:
বিলিভ ইন ইয়োরসেলভ অ্যান্ড ইন ইয়োর প্ল্যান
সে 'আই ক্যান নট', নাট 'আই ক্যান'
দ্য প্রাইজেস অব লাইফ উই ফেইল টু উইন
অনলি ইফ উই ডাউট দ্য পাওয়ার উইথইন।