একটি 'ডট' বলের গল্প...
>একটি ‘ডট’ বল খেলেই ইতিহাস গড়া কিংবদন্তিদের কাতারে জায়গা করে নিয়েছেন তামিম ইকবাল
‘এরপর সে আর কী কী করবে, সেগুলো কোনো ব্যাপার না। ফিরে এসে তামিম এক হাতে যে বলটা খেলল, সেটিই তাঁর পরিচয়।’
টুইটারে এ উপলব্ধিটা এক ক্রিকেটপ্রেমীর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাল থেকেই এমন আবেগের ফোয়ারা ছুটছে। সেটি একটি ‘ডট’ বল ঘিরে। এমনিতে অবশ্য ‘ডট’ বলে সবারই অ্যালার্জি। তামিম-মুশফিকরা একটু বেশি ‘ডট’ দিলেই ফেসবুক-টুইটারে শুরু হয় মুণ্ডুপাত! কিন্তু কাল দুবাইয়ে একটি ‘ডট’ বলের মাঝেই সমর্থকেরা খুঁজে পেয়েছেন তামিমের আসল পরিচয়—দেশপ্রেমিক, দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ।
ঘটনাটা সবারই জানা। তবে বারবার এমন ঘটনার বর্ণনা দিয়েও সুখ। ক্রিকেটের কচি-কাঁচারা হয়তো কাল রাতে স্বপ্নে তামিমের জায়গায় কল্পনা করেছে নিজেকে। তামিম আগে থেকেই অনেকের ‘রোলমডেল’। কিন্তু ওই একটি ‘ডট’ বল কচি-কাঁচাদের মনে নিশ্চিতভাবেই ‘তামিম’ হওয়ার স্বপ্নকে আরও উসকে দিয়েছে। ‘আদর্শ’ খেলোয়াড়েরা বুঝি এভাবেই ক্রিকেটীয় চেতনা ছড়িয়ে দের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। কাল তামিম সেটি করলেন সামান্য একটি ‘ডট’ বল খেলে।
সামান্য বললে ভুল হবে। অসামান্য। তবে অভূতপূর্ব নয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে ‘ডট’ বলের ব্যবচ্ছেদ করতে ফেরা যাক কাল ম্যাচের চিত্রনাট্যে। কিংবা তার একটু আগ থেকে—যখন বাংলাদেশে থাকতেই অনুশীলনে আঙুলে চোট পেয়েছিলেন তামিম। সেই চোট নিয়েই তিনি উড়াল দিলেন এশিয়া কাপ খেলতে আরব আমিরাতে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই চোট পেলেন সেই আঙুলেই। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই তাই ফিরতে হলো ড্রেসিং রুমে। সেখান থেকে হাসপাতালে। পরে জানা গেল, শুধু আঙুল নয় কবজিতে চিড়।
আসল চিড়টা ধরেছিল তামিমের হৃদয়ে। প্লাস্টার করা হাত নিয়ে ড্রেসিংরুমে তাঁর বিষণ্ন মুখখানাই সব বলে দিচ্ছিল। আবার যদি নামতে পারতাম! ইনিংসটা ভালোভাবে শেষ করতে তখন দলেরও কাউকে দরকার। অধিনায়ক মাশরাফি তামিমের সঙ্গে আগেই কথা সেরে রেখেছিলেন। মুশফিক স্ট্রাইকে থাকলে তামিম মাঠে ফিরবেন। তখন শুধু একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকলেই চলবে। বাকিটা সারবেন মুশফিক।
৪৭তম ওভারের এক বল বাকি থাকতে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সে জন্য অবশ্য তামিমকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কারণ মুশফিক তখন নন স্ট্রাইকে। মাঠে ফিরলে তামিমকে শেষ বলটার মুখোমুখি হতে হতো এক হাতে! অন্য হাতটি যে চোটগ্রস্ত, অকেজো। এমন দ্বিধাগ্রস্ত সময়ে তামিম যুক্তি বিসর্জন দিয়ে শুনলেন হৃদয়ে দাবি, হাঁটলেন সেই সব কিংবদন্তিদের পথে। যাঁরা দেখিয়েছেন এক হাত দিয়েও প্রতিপক্ষকে রুখে ‘মহানায়ক’ হওয়া যায়।
তামিম ড্রেসিং রুম থেকে বেরোলেন। দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি সমর্থকদের চোখ ঝাপসা। গর্বের উল্লাসে উন্মাতাল গ্যালারি। সে কী, এ যে তামিম! লঙ্কানরাও তাকিয়ে ছিলেন অবিশ্বাস্য চোখে। তামিম উইকেট এলেন, ধীরে-সুস্থে স্টান্স নিলেন। তখন কেউ কী দেখেছে তাঁর বাঁম হাতের গ্লাভস কেটে প্লাস্টার করা দুটি আঙুল বের করা। কেউ কী বুঝেছে, ওই দুটি আঙুলে ফের বলের আঘাতে শেষ হতে পারত তাঁর ক্যারিয়ারই!
তামিম কিন্তু নিজের সম্ভাব্য পরিণতি জেনেবুঝেই মাঠে ফিরেছিলেন। আর বোলিং প্রান্তে সুরঙ্গা লাকমলও বুঝেছিলেন, বাউন্সারই মারতে হবে। এই ইনিংসেই তাঁর উঠে আসা বলেই চোট পেয়ে সে ফিরেছে। ৪৭তম ওভারের শেষ ডেলিভারিতে লাকমল তাই ছুড়লেন বাউন্সার। যতই বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুক, প্রতিপক্ষকে তো আর ছাড় দেওয়া যায় না।
দ্বিতীয় ওভারে চোট পেয়ে তামিম ফেরার আগে ২ রান করেছিলেন ৩ বলে। কিন্তু বাংলাদেশের ইনিংস শেষে স্কোরবোর্ডে তাঁর নামের পাশে ৪ বলে অপরাজিত ২। তাঁর খেলা শেষ বলটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে সাধারণ আর অসাধারণের মধ্যে। ওই শেষ বলটাই ছিল ‘ডট’—৪৭তম ওভারে শেষ ডেলিভারিতে যেটি বাউন্সার মেরেছিলেন লাকমল। বাঁ হাতটি পেছনে কোনোভাবে সামলে তামিম সেই বাউন্সার সামলেছেন এক হাত দিয়ে। সেটিও আবার চোস্ত ব্যাটসম্যানদের মতো উঠে আসা বলকে এক হাতে নিচে খেলে!
কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাস তাঁকে ওই নিচে খেলা ‘ডট’ বলটির জন্যই তুলে দিয়েছে কিংবদন্তিদের কাতারে। ম্যালকম মার্শাল, সেলিম মালিক, গ্রায়েম স্মিথ কিংবা পল টেরি। এ চারজনের মধ্যে মার্শাল-মালিক-স্মিথ ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের দিক থেকেও কিংবদন্তি। পল টেরি তাঁদের ধারে-কাছে না থাকলেও তাঁদের সঙ্গে নিজেকে একসূত্রে গেঁথেছেন এক হাতে ব্যাট করে।
তামিমের আগে সর্বশেষ এভাবে সাহসের অন্য নাম হয়ে থাকা ক্রিকেটারটি স্মিথ। ২০০৯ সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচাতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন ভাঙা হাতে। পঞ্চম দিনের সেই খেলায় বাকি ছিল ৮ ওভার ২ বল। জনসনদের বেশ কিছু ডেলিভারি এক হাতে সামলাতে পারলেও ১০ বল বাকি থাকতে স্মিথ আর পারেননি। ফিরতে হয়েছিল আউট হয়ে। কিন্তু দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে যান চিরস্থায়ীভাবে।
সেলিম মালিক ‘জুয়াড়ি’ হিসেবে কুখ্যাতি পেলেও ১৯৮৬ সালে ফয়সালাবাদ টেস্টে অনন্য সাহস দেখিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই টেস্টে ওয়াসিম আকরামকে ফিফটি এনে দিতে তামিমের মতোই নেমেছিলেন ১১তম ব্যাটসম্যান হিসেবে। তাঁর ১৪ বলে ৩ রানের অপরাজিত ইনিংসের সুবাদে ওয়াসিম ফিফটি তুলে নেন, পরে পাকিস্তানও জিতেছিল সেই টেস্ট।
জিতেছিলেন ম্যালকম মার্শালও। ১৯৮৪ হেডিংলি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে ল্যারি গোমেজ ৯৬ রানে অপরাজিত থাকতে ৯ উইকেট পরে যায়। বুড়ো আঙুলে দুটি চিড় নিয়েও ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই পেসার। শুধু সতীর্থের সেঞ্চুরি এনে দিতে। মার্শালের ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল। পরে এক হাতে প্লাস্টার নিয়ে বোলিং করেও ৭ উইকেট নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই টেস্টে তাঁর এক হাতে ৮ বলে ৪ রানের ইনিংসটাই বেশি মনে রেখেছে সবাই।
পল টেরিকে সেভাবে কেউ মনে রাখেনি। সেই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওল্ডট্র্যাফোর্ড টেস্টে সেঞ্চুরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন অ্যালান ল্যাম্ব। তার আগেই চোট পাওয়া টেরি তাঁর ভাঙা হাত স্লিংয়ে ঝুলিয়ে নেমেছিলেন ব্যাটিং করতে। ল্যাম্বও সতীর্থের সাহায্য পেয়ে তুলে নেন সেঞ্চুরি। টেরির ৩৩ বলের সেই ইনিংসটি স্মরণীয় করে রেখেছে তাঁর মাত্র দুই টেস্টের ক্যারিয়ারকে।
বলুন তো, এক হাতে ইতিহাস গড়া এই চার ক্রিকেটারদের মধ্যে তামিম কোথায় আলাদা?
চোট নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামার পর বাকি তিনজনকেই একের অধিক ডেলিভারি খেলতে হয়েছে। কিন্তু তামিম মাত্র এক বল খেলার সুযোগ পেয়েছেন। মুশফিক তাঁকে আর ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ দেননি। কিন্তু সেই একটি ‘ডট’ বলেই তামিম পেয়ে গেলেন অমরত্ব আর বাংলাদেশের ক্রিকেটও পেল বুক ফুলিয়ে বলার মতো এক গল্প!