আরও একবার খোঁড়ানো ব্যাটিংয়ের যন্ত্রণা
ম্যাচের তখন ১২.৪ ওভার। লিয়াম লিভিংস্টোনের লেগ স্পিন লেগে খেলে এক রানের জন্য দৌড় দেন মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ হোসেন।
টাইমাল মিলস প্রথম দফায় বলটা ধরতে না পারায় আরেকটি রান নিতে দৌড় দেবেন কি না—কয়েক সেকেন্ড সে দ্বিধায় ভুগলেন মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ। নন–স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ‘কল’ দিয়েছিলেন।
আফিফ তাতে সাড়া দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বুঝলেন দৌড়টা ‘আত্মঘাতী’ হয়ে গেছে। ততক্ষণে মিলসের থ্রো থেকে স্টাম্প ভাঙার আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন জস বাটলার।
মাঠের বাইরে থেকে সেই দৃশ্য দেখে ইংল্যান্ড কোচ ক্রিস সিলভারউডের সে কী হাসি—যেন চল্লিশ দশকের কমেডি জুটি ‘লরেল অ্যান্ড হার্ডি’র শো দেখছেন! কারও সঙ্গে (পড়ুন দল) প্রথমবারের সাক্ষাতে যে এত মজা, সেটা যেন তাঁর জানা ছিল না!
টি–টোয়েন্টিতে এই প্রথম ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। আবুধাবিতে এ ম্যাচে আগে ব্যাট করা বাংলাদেশ অবশ্য এ ম্যাচে নিজেদের জন্য তেমন হাসির খোরাক জোগাড় করতে পারেনি।
প্রতিপক্ষ আলাদা হলেও দৃশ্যপট সেই একই। সেই একই ভুল, ইনিংসের সেই একই গতিপ্রকৃতি। সংবাদ সম্মেলনে ‘ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া’র কথা নামতা পড়ার মতো বলা হলেও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত সাদামাটা কিংবা আরেকটু ভদ্রভাবে বললে মোটামুটি সংগ্রহেই থামছে দলের ইনিংস। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও যেমন ৮ উইকেটে ১২২ রানে থেমেছে বাংলাদেশের ইনিংস।
সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হলো আউটের ধরন। লিটন দাস এমনিতেই রানের মধ্যে নেই। মঈন আলীর প্রথম ওভারে দুটি দর্শনীয় চারে শুরু করা লিটনের আজও ‘আত্মহত্যা’র সাধ জেগেছে! স্কয়ার লেগ এবং ডিপ মিডউইকেট সীমানায় দুজন ফিল্ডার রেখে একটু ঝুলিয়ে বল ছেড়ে লিটনকে সুইপের লোভ দেখান মঈন।
টোপটা টুপ করে গিলে লিটন (৯) ফিরলেন ক্যাচ দিয়ে। অবশ্য বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। একসঙ্গে নেমে দ্রুত কারও ফিরে যাওয়াই যেন নিয়তি।
লিটনের ‘বদভ্যাস’–এর কারণে আজও সেই নিয়তি মেনে নেওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ নাঈমের মাথায় কী খেলা করছিল কে জানে! লিটন আউট হওয়ার পরের বলেই নাঈমের ইচ্ছা হলো মিড অন দিয়ে মঈনকে উড়িয়ে মারবেন।
তাতে ফলটা দাঁড়াল বাংলাদেশের ইনিংসে ১৫ বলের (২.৩ ওভার) মধ্যে দুই ওপেনার আউট। সেটিও টানা দুই বলে! রোমিও–জুলিয়েটের গল্পের মতো—একজন আত্মহত্যা করলে আরেকজনের ‘বেঁচে’ থেকে কী লাভ!
নাঈম ৫ রানে ফেরার পর ১৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ যখন ধুঁকছে, তখন সাকিব আল হাসানের ওপর দায়িত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অসংখ্য ম্যাচে বাংলাদেশকে প্রায় একা টানতে টানতে সাকিব কি ক্লান্ত?
দুই ওভার পর সাকিবও তাই বুঝি রান বের করতে গিয়ে ভুলটা করে বসলেন! পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে ক্রিস ওকসকে জোর করে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন সাকিব (৪)।
পাওয়ারপ্লেতে বাংলাদেশের রান ছিল ৩ উইকেটে ২৭। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দৃশ্যটা অপরিচিত কিছু না। মুশফিকুর রহিম এখান থেকে অনেকবারই বিপদমুক্ত করেছেন দলকে। মাহমুদউল্লাহকে পেয়েছিলেন সঙ্গী হিসেবে। ৩২ বলে ৩৭ রানের একটি জুটিও হলো।
তাতে টি–টোয়েন্টির মেজাজে রান না উঠলেও অন্তত রানের চাকাটা ঢাকার জ্যামের রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলার মতো চলল। কিন্তু ওই যে বদভ্যাসের কথা বলা হচ্ছিল—মুশফিকের জন্য সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। টি–টোয়েন্টিতে রিভার্স সুইপ ঠিকমতো খেলতে বলের লেংথ বাছাই করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
মুশফিক তা ভুলে গিয়ে লিভিংস্টোনকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে হলেন এলবিডব্লু। ৩০ বলে মুশফিকের ২৯ বলের এই ইনিংসটি আক্ষরিক অর্থেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু।
আফিফ–মাহমুদউল্লাহ জুটিতে ভর করে শেষটা অন্তত ভালো করার আশায় ছিলেন অনেকেই। কিন্তু ১৩তম ওভারে আফিফের ওই রান আউট এবং ১৫তম ওভারে মাহমুদউল্লাহর লেগ স্পিনে চিরকালীন দুর্বলতা সমর্থকদের যন্ত্রণার ক্ষতটা আরও গভীর করে ছাড়ে।
ইংল্যান্ডের ‘পার্ট টাইম’ লেগ স্পিনারকে এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দেন মাহমুদউল্লাহ (২৪ বলে ১৯)। যে মেহেদী হাসান ও নুরুল হাসানের শেষ দিকে দ্রুত রান তোলার সামর্থ্য নিয়ে এত কথা হচ্ছে—তাঁরাও হতাশ করেছেন দ্রুত আউট হয়ে।
শেষ পর্যন্ত টি–টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের সুরটা ধরিয়ে দিয়েছেন স্পিনার নাসুম আহমেদ। ৯–এ নেমে ১৯তম ওভারে দুটো ছক্কা হাঁকান আদিল রশিদকে। বাংলাদেশের ইনিংসে প্রথম ছক্কা। টপ অর্ডার ব্যাটিং যা করতে পারেনি সেটাই সাহস করে করে ফেলেন নাসুম। ওই ওভারে উঠেছে ১৭ রান—বাংলাদেশের এই ইনিংসে এক ওভারে যা সর্বোচ্চ। তবু শেষটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের। শেষ ওভারে ৫ রান নিয়ে শেষ দুই বলে ফিরেছেন নুরুল ও মোস্তাফিজুর রহমান।
২৭ রানে ৩ উইকেট নেওয়া টাইমাল মিলস, ১৫ রানে ২ উইকেট নেওয়া লিভিংস্টোন কিংবা ১৮ রানে ২ উইকেট নেওয়া মঈনের বোলিংয়ের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাটিং চোখে বিঁধেছে বেশি। সে যন্ত্রণা আরও বেড়েছে ‘ডট’ বল খেলার সংখ্যায়—৫২। অর্থাৎ ৮.৪ ওভার!
ওই তো সেই খোঁড়ানো ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাটিং।