অভাগা যেদিকে যায়, মাথায় বাড়ি খায়
বেচারা উইল পুকোভস্কি! মাথায় কেউ ক্রিকেট বলের আঘাত পেলে লোকে তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। ‘কনকাশন’ তো মোটেও ভালো কিছু নয়। এভাবে মৃত্যুর ঘটনাও আছে।
কিন্তু পুকোভস্কির বেলায় এমন কিছু হলে লোকে জানতে চাইতে পারে, এবার দিয়ে কতবার হলো?
আগে প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া যাক—১১ বার। হ্যাঁ, ২০১৭ সালে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেকের পর মোট ১১ বার ‘কনকাশন’-এ পড়েছেন পুকোভস্কি। ২৪ বছর বয়সী এই তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল ব্যাটসম্যানের জন্য সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য হলেও এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
পুকোভস্কির নিজের কাছেও কি ব্যাখ্যা আছে? কনকাশন (মাথায় আঘাতজনিত সমস্যা) নিয়ে মাঠ ছাড়ার চার মাস পর মাঠে ফিরেই যে আবার মাঠ ছাড়লেন কনকাশনে পড়ে!
আজকের কথাই ধরুন, শেফিল্ড শিল্ডে সাউথ অস্ট্রেলিয়া ও ভিক্টোরিয়া ম্যাচ চলছিল। আজ চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে অনুশীলনে মাথায় বলের আঘাত পান তিনি। তবু সকালে ফিল্ডিংয়ে নেমেছিলেন। দিনের প্রথম দুই বলে মিড অনে ফিল্ডিংও করেন। তৃতীয় বলটি হওয়ার পর হাঁটুতে ভর করে বসে পড়েন পুকোভস্কি। বিপদ টের পেয়ে এরপরই তাঁকে তুলে নেয় ভিক্টোরিয়া।
সাউথ অস্ট্রেলিয়া দ্রুত অলআউট (২১৩) হওয়ার পর জয়ের জন্য ৩১৬ রানের লক্ষ্য পায় ভিক্টোরিয়া। কিন্তু পুকোভস্কিকে মার্কাস হ্যারিসের সঙ্গে ওপেন করতে দেখা যায়নি। ম্যাচ রেফারি সাইমন ফ্রাইয়ের সঙ্গে কথা বলে পুকোভস্কির ‘কনকাশন বদলি’ হিসেবে ট্রাভিস ডিনকে একাদশে অর্ন্তভুক্ত করে ভিক্টোরিয়া।
চতুর্থ দিনে মধ্যাহ্নভোজ চলাকালে ম্যাচ চিকিৎসক জিওফ ভেরালের সঙ্গে কথা বলে ডিনকে কনকাশন বদলির ছাড়পত্র দেন ম্যাচ রেফারি সাইমন ফ্রাই। ততক্ষণে ক্রিকেট ভিক্টোরিয়া কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অ্যাডিলেড ওভাল ছেড়ে যান পুকোভস্কি।
মধ্যাহ্নভোজের পরপরই ক্রিকেট ভিক্টোরিয়ার বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শেফিল্ড শিল্ডে অ্যাডিলেড ওভালে চতুর্থ দিনে কনকাশন বদলি করেছে ভিক্টোরিয়া। একাদশে উইল পুকোভস্কির জায়গায় ঢুকেছেন ট্রাভিস ডিন। আজ সকালে প্রথম সেশনে ফিল্ডিংয়ের সময় মাথায় কনকাশন অনুভব করেন পুকোভস্কি। তিনি ক্রিকেট ভিক্টোরিয়ার চিকিৎসক দলের তত্ত্বাবধানে আছেন।’
অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে ১৬২.৫০ গড়ে ৬৫০ রান তুলে পেশাদার ক্রিকেটে পা রাখা পুকোভস্কিকে অনেকেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ‘ভবিষ্যৎ’ হিসেবে দেখেছেন। সেই দলটা এখনো পাতলা হয়ে আসেনি। পুকোভস্কিকে এখনো সম্ভাবনাময়দের কাতারেই রাখা হয়নি। কিন্তু কী এক ভোজবাজির মতো ব্যাটিংয়ে নামলেই কোনো না কোনোভাবে তিনি মাথায় বলের আঘাত পান, যেন এর কোনো ব্যাখ্যা নেই!
শুধু ব্যাটিংয়ের সময় কেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে—সেদিন আবার তাঁর জন্মদিনও—ফিল্ডিংয়ের সময় মাথায় বলের আঘাত পেয়ে ‘কনকাশন’-এ ভোগেন ‘অভাগা’ এই ক্রিকেটার। সেই যে শুরু হলো, অদ্যাবধি চলছে!
ওই বছরই অক্টোবরে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে মাথায় বলের আঘাত পান পুকোভস্কি। রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়। পরের মাসে ফিউচার ক্রিকেট লিগে মাঠে নেমেও ভাগ্য বদলায়নি। আবারও বলের আঘাত এবং কনকাশন! ২০১৮ সালের মার্চে এই শেফিল্ড শিল্ডেই নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে শন অ্যাবটের বলে মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়ার পর ওই মৌসুমে খেলা হয়নি তাঁর।
অক্টোবরে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত রোগে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন পুকোভস্কি। তখন তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, কোনো কিছু মনে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। ভুলোমনা হয়ে পড়ছেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে ডাক পেয়েও অভিষেক হয়নি পুকোভস্কির। প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো করা কুর্তিস প্যাটারসনকে খেলানো হয় এবং পুকোভস্কি আবারও মানসিক সমস্যার জন্য ক্রিকেটের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জানায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)।
পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে রান নিতে গিয়ে ফিল্ডারের ছোড়া থ্রোয়ে মাথায় বলের আঘাত পেয়ে আবারও কনকাশনে পড়েন পুকোভস্কি। এরপর করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে আর ক্রিকেটে ফেরেননি তিনি।
মাথায় এত সব আঘাত পাওয়ার মধ্যেই পুকোভস্কি কিন্তু রান করেছেন। ২০২০ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা দুটি দ্বিশতক তুলে নেন পুকোভস্কি। বয়স ২৩ হওয়ার আগেই তিনটি দ্বিশতক হয়ে যায় তাঁর, বারবার কনকাশনে পড়লেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও (সিএ) তাই পুকোভস্কিকে আগলে রেখেছে ভবিষ্যতের আশায়। গত বছর ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে তাঁর।
এবারের কথাই ধরুন, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচ দিয়ে এবারের মৌসুমে ক্রিকেট মাঠে ফিরেছিলেন পুকোভস্কি। কিন্তু কী হলো, আবারও সেই কনকাশন!
গত বছরের অক্টোবরে অনুশীলনে মাথায় বলের আঘাত পাওয়ার পর অ্যাশেজ ও ঘরোয়া মৌসুমের প্রথম ভাগে মাঠে নামতে পারেননি পুকোভস্কি। সিএ জানিয়েছিল, অক্টোবরের সেই কনকাশনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত তা কাটিয়ে উঠলেও মাঠে ফেরার ম্যাচে আবারও কনকাশনের শিকার হলেন পুকোভস্কি। পুরোনো সেই প্রবাদকে একটু পাল্টে নিলেই তাঁর বিষয়টি বোঝা যায়—অভাগা যেদিকে যায়, মাথায় বাড়ি খায়!