দুই ইনজাগির বৈপরীত্য আর ইন্টার মিলানের দ্বিতীয় তারকা
হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না, তেমনি পরিবারের সব সন্তান জ্ঞানে, মেধায়, সহজাত ক্ষমতায় একই রকম হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জিয়ানকার্লো ইনজাগি সব সময় দাবি করতেন, তাঁর দুই ছেলে সমান প্রতিভাবান।
তবে খেলোয়াড়ি জীবনে জিয়ানকার্লোর ছোট ছেলে ঠিক কী কারণে বড়জনের আড়ালে পড়ে থাকতেন, সেটার যথোপযুক্ত ব্যাখা তাঁর কাছে ছিল না। জিয়ানকার্লোর দুই ছেলে কারা, সেটা তাঁর নামের শেষাংশ পড়েই বুঝে ফেলার কথা—ফিলিপ্পো ইনজাগি ও সিমোন ইনজাগি।
‘সুপারপিপ্পো’ নামে পরিচিত ফিলিপ্পো ইনজাগিকে তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বিবেচনা করা হয়। ইতালিয়ান সিরি ‘আ’, কোপা ইতালিয়া, ইতালিয়ান সুপার কাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা সুপার কাপ, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ—সাবেক এই স্ট্রাইকার জুভেন্টাস ও এসি মিলান মিলিয়ে জিতেছেন সবই। যে সোনালি ট্রফি একজন ফুটবলারকে ‘অমরত্বের স্বাদ’ এনে দেয়, ২০০৬ সালে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জিতে পেয়েছেন সেই স্বাদও।
ফিলিপ্পোর চেয়ে বয়সে ২ বছর ৭ মাসের ছোট সিমোন ইনজাগির খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার সে তুলনায় পরিস্ফুটিত হয়নি। এ মৌসুমে এক ক্লাব তো পরের মৌসুমে আরেক ক্লাব—বলতে গেলে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। জন্মশহরের ক্লাব পিয়াসেনৎসার হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল। সেই পিয়াসেনৎসা সিমোনকে চার মৌসুম চারটি ক্লাবের কাছে (কারপি, নোভারা, লুমেৎসানে ও ব্রেসসেল্লো) ধারে খেলতে পাঠিয়েছিল। যা একটু থিতু হতে পেরেছিলেন লাৎসিওতে। যদিও রোমের ক্লাবটিও সিমোনকে একসময় সাম্পদোরিয়া ও আতালান্তার কাছে ধার দিয়েছিল।
এতগুলো ক্লাবে যাযাবরের মতো জীবন কাটিয়েও সিমোন হয়তো কিছুটা তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারতেন কিংবা নিজেকে ভাইয়ের পর্যায়ের ভাবতে পারতেন, যদি তালিকায় জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান ও এসি মিলানের নাম থাকত। কিন্তু ইতালির শীর্ষ তিন ক্লাবের হয়ে খেলার স্বপ্ন কখনো পূরণ হয়নি তাঁর।
শীর্ষ স্তরের ফুটবলে (ক্লাব ও জাতীয় দল) খেলোয়াড়ের ভূমিকায় যেখানে বড় ভাই ফিলিপ্পোর ট্রফি ১৩টি, সেখানে সিমোনের অর্ধেকেরও কম—৬টি। সব কটিই লাৎসিওর হয়ে। ফিলিপ্পো যেখানে ইতালি জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন, সিমোনের সেখানে দেশের জার্সি পরে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছে মোটে তিনবার। মাঠের পারফরম্যান্সের বৈপরীত্য নিশ্চয় ব্যক্তিজীবনেও ছিল। তারকা ফুটবলার হওয়ায় জনপ্রিয়তা, অর্থবিত্ত, ঐশ্বর্যে সিমোনের চেয়ে ঢের এগিয়ে ছিলেন ফিলিপ্পো। সিমোন খেলা ছেড়েছেন ২০১০ সালে, ফিলিপ্পো আরও ২ বছর পর নিজেকে এসি মিলানের কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করেই কোচিংয়ে ঝুঁকে পড়েন ফিলিপ্পো। ২০১২ সালে এসি মিলান যুব দলের হয়ে তাঁর কোচিংয়ে হাতেখড়ি। বরাবরই ভাইয়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকা সিমোন কোচিংয়ে এসেছেন অনেক পরে। খেলোয়াড় হিসেবে যেখানে নিজের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলেন, ২০১৬ সালে সেই লাৎসিও তাঁকে কোচের গুরুদায়িত্ব দেয়। লাৎসিওর কোচ হওয়ার পরই নিজেকে বদলে ফেলতে শুরু করেন সিমোন। এই বদলটা ছিল নিজেকে ক্রমে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস।
উন্নতি করতে করতে সিমোন নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে, এখন দুই ভাইকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে বেশির ভাগ মানুষ তাঁর নামই জপবেন। সিমোন যে এখন ইতালিয়ান সিরি ‘আ’–জয়ী (স্কুদেত্তো) কোচ! তাঁর বর্তমান দল ইন্টার মিলান মৌসুমের শুরু থেকে একচেটিয়া খেলে স্কুদেত্তো জয়ের পথেই ছিল। পরশু রাতে ঐতিহাসিক সান সিরোয় মিলান ডার্বিতে এসি মিলানকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে ৫ ম্যাচ বাকি থাকতেই শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলেছে ইন্টার মিলান। এ অর্জন ইনজাগি পরিবারের হলে কী হবে, ভাই ফিলিপ্পোর সাবেক ক্লাবকে হারিয়ে পাওয়া শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সিমোনের কাছে মধুর লাগারই কথা।
অবশেষে সবাই সিমোনের প্রতিভাকে স্বীকার করছে। আমি বলেছিলাম না, আমার দুই ছেলেই সমান মেধাবী?জিয়ানকার্লো ইনজাগি, ফিলিপ্পো ও সিমোন ইনজাগির বাবা
খেলোয়াড় হিসেবে ফিলিপ্পোর ধারেকাছে যেতে না পারলেও সিমোন কোচ হিসেবে শুরু থেকেই সফল। তবে পরশু সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হওয়া নতুন পালকটা তাঁকে ইতালিয়ান ফুটবলে আলাদাভাবে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এটাই যে কোচ হিসেবে তাঁর প্রথম লিগ জয়। এর আগে পাঁচ বছর লাৎসিওর ডাগআউটে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন তিনটি শিরোপা—একটি কোপা ইতালিয়া ও দুটি ইতালিয়ান সুপার কাপ। রোমের ক্লাবটিতে পাওয়া সাফল্যই ইন্টার মিলান কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তে যথেষ্ট ছিল।
২০২১ সালে সিমোনকে কোচ করে আনে ইন্টার। তিনি যখন ইন্টারের দায়িত্ব নেন, তখন ক্লাবটি করোনার কষাঘাতে চরম আর্থিক সংকটে ভুগছিল। কিন্তু সিমোনের অধীন দলীয় সাফল্য আর খেলোয়াড় কেনা ও ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার কারণেই ধীরে ধীরে আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠে ইন্টার।
দলটির কোচ হিসেবে প্রথম দুই বছরেই জিতে নেন পাঁচটি ট্রফি—দুটি কোপা ইতালিয়া আর ইতালিয়ান সুপার কাপের হ্যাটট্রিক শিরোপা। ফুটবল–বিশ্বকে চমকে দিয়ে গত মৌসুমে নেরাজ্জুরিদের নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও। ম্যানচেস্টার সিটির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হলেও তাঁর কোচিং–দক্ষতা, ফুটবলীয় দর্শন সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। এবার অবশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগে ইন্টারকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেননি। আতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে টাইব্রেকারে হেরে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ছিটকে পড়তে হয়েছে কোপা ইতালিয়ার শেষ ষোলো থেকেও। তবে স্কুদেত্তো জয় নিশ্চিতভাবেই তাঁর সব বেদনা ভুলিয়ে দিয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পাওয়া কতটা কঠিন, পরশু লিগ জিতে সেটাই জানিয়েছেন সিমোন ইনজাগি, ‘তিন বছরে ছয়টি ট্রফি জিতেছি, (একবার) চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছি। আমার কাছে এটা কল্পনা করা কঠিন। আপনাকে পুরো তিন বছরের দিকে তাকাতে হবে ও বিশ্লেষণ করতে হবে। এই বছরও ভালোই কেটেছে। এটা (লিগ চ্যাম্পিয়ন) এমন এক জয়, যা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে।’
ও হ্যাঁ, খেলোয়াড় ফিলিপ্পো ছোট ভাই সিমোনের থেকে ঢের এগিয়ে থাকলেও কোচ ফিলিপ্পো কতটা পিছিয়ে, সেটাও জেনে নিন। বড় ভাইয়ের চেয়ে চার বছর পর কোচিংয়ে এসেও সিমোন যেখানে শীর্ষ স্তরের ক্লাব ফুটবলে ছয়টি ট্রফি জিতেছেন, সেখানে ফিলিপ্পোর প্রাপ্তি শূন্য! সিমোনকে খেলোয়াড় হিসেবে যাযাবরের মতো একের পর এক মৌসুম কাটাতে হয়েছে। ফিলিপ্পোর এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে কোচ হিসেবে। মিলান যুব দলের পর মূল দলেরও কোচ হয়েছিলেন ফিলিপ্পো। কিন্তু এক মৌসুমের বেশি চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
এরপর ফিলিপ্পো একে একে ভেনেৎসিয়া, বোলোনিয়া, বেনেভেন্তো, ব্রেসিয়া, রেগিনা ও সর্বশেষ সালেরনিতানার কোচ হয়েছেন। কিন্তু কোথাও সাফল্যের মুখ দেখেননি। সালেরনিতানায় তাঁর ‘আয়ু’ ছিল মাত্র চার মাস। এ মৌসুমেই সিরি ‘আ’-তে দুই ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে অনেকটা ‘বেইজ্জতি’ই হতে হয় ফিলিপ্পোকে। পয়েন্ট তালিকার তলানিতে থাকায় সিমোনের ইন্টারের বিপক্ষে ম্যাচের এক সপ্তাহ আগে তাঁকে বরখাস্ত করে সালেরনিতানা। খেলোয়াড় ও কোচের ভূমিকায় দুই ভাইয়ের এই বৈপরীত্য কিছু চিরন্তন সত্যি মনে করিয়ে দেয়—ভালো ছাত্র হলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না কিংবা ভালো খেলোয়াড় হলেই ভালো কোচ হওয়া যায় না। অথবা উল্টো করে বললে, বড় মাপের খেলোয়াড় না হয়েও সফল কোচ হওয়া সম্ভব।
ছোট ভাইয়ের সামর্থ্য নিয়ে মনে কখনোই দ্বিধা ছিল না ফিলিপ্পোর। এমনকি তাঁর আগে সিমোনেরই এসি মিলানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কেন তা হয়নি, একবার এক সাক্ষাৎকারে সে কথা জানিয়েছিলেন ফিলিপ্পো, ‘কৌশলগত দিক থেকে সিমোন আমার চেয়েও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ওকে দীর্ঘ সময় ধরে পিঠের চোটের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এটাই ওর মিলানে নাম লেখানোর পথে বাধা হয়ে ওঠে।’
পরশু নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানকে হারিয়ে স্কুদেত্তো জয়ে তাদের ছাড়িয়ে গেছে ইন্টার মিলান। এসি মিলান লিগ শিরোপা জিতেছে ১৯ বার, ইন্টারের হলো ২০ বার। সবচেয়ে সফল জুভেন্টাস লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৩৬ বার। সিরি ‘আ’র রীতি অনুযায়ী, কোনো ক্লাব ১০ বার লিগ জিতলে তাদের লোগোর ওপর একটি তারকা বসাতে পারে। ইন্টার ২০ বার লিগ জেতায় আগামী মৌসুম থেকে দুই তারকা জার্সি পরে খেলতে নামবে।
ছোট ছেলে সিমোন ইনজাগির ইন্টারই যে এবার স্কুদেত্তো জিততে চলেছে, সেটা গত ডিসেম্বরেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বাবা জিয়ানকার্লো ইনজাগি। ইতালির ক্রীড়াবিষয়ক সংবাদমাধ্যম লা গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্টকে তিনি সে সময়ই বলেছিলেন, ‘অবশেষে সবাই সিমোনের প্রতিভাকে স্বীকার করছে। আমি বলেছিলাম না, আমার দুই ছেলেই সমান মেধাবী? সিমোন আগে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাত, যেকোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করত। কিন্তু সে নিজেকে বদলে ফেলেছে। সে এখন আরও চিন্তাশীল। সে সব সময় ইন্টারকে নিয়ে ভাবে, ক্লাবের লক্ষ্য পূরণে কাজ করে।’
বাবা যখন এমন ‘সার্টিফিকেট’ দেন, তখন কি আর কিছু বলার থাকে?