প্রথম আলোর পুরস্কার আমাদের অলংকার
যেবার গলফার সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা হলেন, আমার পাশেই বসেছিলেন তিনি। বর্ষসেরা হিসেবে নিজের নাম শোনার পর ‘ইয়েস’ বলে লাফ দিয়ে উঠেছিলেন সিদ্দিকুর, যেন অস্কার জিতে গেছেন! ২০১০ সালের প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানের ওই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে আমার।
আবার আশা নিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়ে পুরস্কার না পাওয়ার বেদনাও আমি অনেকের মধ্যে দেখেছি। প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার নিয়ে খেলোয়াড়দের এই আনন্দ-বেদনার গল্পগুলোই বলে দেয়, এই স্বীকৃতি তাঁদের জন্য কতটা কাঙ্ক্ষিত, কতটা সম্মানের। তবে কেউ পুরস্কার পাক বা না পাক, দিন শেষে সবাই প্রথম আলোর এই আয়োজনকে ইতিবাচকভাবে দেখে। দেশের ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠকদের কাছে এই অনুষ্ঠান ‘আমার অনুষ্ঠান’।
আমার সময়টা এই অনুষ্ঠানে খুব আনন্দে কাটে। ক্রীড়াঙ্গনের সবাইকেই মোটামুটি পাওয়া যায় এখানে। মফস্সলে যেটা হয় যে সারা বছর কারও সঙ্গে দেখা না হলেও ঈদের দিন দেখা হয়। প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠান আমার কাছে অনেকটা মফস্সলের সেই ঈদের মতো। সব খেলার সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ফুটবলের বন্ধু, অ্যাথলেটিকসের বন্ধু, পুরোনো বন্ধু, সিনিয়ররা। আমরা সবাই, হ্যাঁ...আমি ‘আমরা’ শব্দটাই বলব, আমরা সবাই অনুষ্ঠানটা খুব উপভোগ করি।
পুরস্কার অনুষ্ঠান যেহেতু, পুরস্কার পাওয়ার একটা ব্যাপার তো থাকেই। ২০০৫ সালে আমি বর্ষসেরা হয়েছিলাম। আমি কিন্তু আগে থেকে জানতাম না যে আমিই হতে যাচ্ছি প্রথম আলোর বর্ষসেরা। জানার কথাও নয়। কারণ, বিচারক এবং গুটিকয় মানুষ ছাড়া অনুষ্ঠানের আগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম এখানে কাউকেই জানানো হয় না। যারা পুরস্কার পাচ্ছে, তাদেরও না। তবে প্রথম আলো থেকে যখন বারবার অনুষ্ঠানে আসতে অনুরোধ করা হয়, তখন মনের মধ্যে একটা টেনশন চলে আসে—পুরস্কার পাব কি পাব না!
এ রকম অনুরোধ পেয়ে পুরস্কার অনুষ্ঠানের আগে দু-তিন রাত নিদ্রাহীন কেটেছিল আমার। কারণ, মনেপ্রাণে চাইছিলাম, বর্ষসেরার পুরস্কারটা যেন আমি পাই। মনে হচ্ছিল, এটা পেলে আমি বলার মতো কিছু একটা পাব। যখন খেলা ছেড়ে দেব, তখনো এটা রঙিন স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার বিশ্বাস, আমার কাছে পুরস্কারটা যে রকম ছিল, সব খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই এটা সে রকম। বর্ষসেরাই বলুন বা অন্য কোনো শ্রেণি, প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কারের মর্যাদাই অন্য রকম।
সেদিন আমি যেন আকাশে উড়ছিলাম! আমার পুরস্কার–ভাগ্য বরাবরই খারাপ বলে এর আগে খুব বেশি পুরস্কার পাইনি। এ জন্যই হয়তো প্রথম আলোর পুরস্কার পেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, শোকেসে এমন একটা জিনিস রাখতে পারব, যেটা নিয়ে আমি সারা জীবন গর্ব করতে পারব। যখন সেটা পেয়ে গেলাম, আমার চেয়ে খুশি বোধ হয় সেদিন কেউ ছিল না। অনেক সম্মানিত বোধ করছিলাম। নিজের কাছেও নিজের সম্মানটা বেড়ে গিয়েছিল অনেক।
আমি সম্ভবত প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানের প্রতিটিতেই সশরীর উপস্থিত ছিলাম। কোনোটা মিস করেছি বলে মনে পড়ে না। প্রতিবারই লক্ষ করেছি, ক্রীড়াঙ্গনের সবাই খুব উপভোগ করে সন্ধ্যাটা। কারণ, এই অনুষ্ঠানে সুপারস্টার বলে কিছু থাকে না। কারও সঙ্গে কারও কোনো দূরত্ব থাকে না এখানে। সবাই নিজেকে সবার মধ্যে একজন মনে করে। যেকোনো খেলা, যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছেই এটা যেন নিজের কিছু। এখানে সাকিব আল হাসান যা, অন্য কোনো খেলার একজন ছোট খেলোয়াড়ও তা। সবাইকে সমানভাবে দেখাটাই প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানের বড় সৌন্দর্য।
সামনের সারিতে বসার একটা বিষয় তো থাকেই, তবে আমার ধারণা সেটা জ্যেষ্ঠতা রক্ষার জন্যই কিছুটা করা হয়, যা স্বাভাবিকও। নইলে যে আগে যাবে, সে সামনের দিকে বসতে পারবে, এটাই অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। এ জন্য পেছনের সারিতে বসতে হলেও কেউ কিছু মনে করে না। বরং পেছনের দিকে বসলেই মজা হয় বেশি। আর অনুষ্ঠানটা খুব লম্বা সময় ধরেও হয় না। অল্প সময়ের মধ্যে জমজমাট এক অনুষ্ঠান। পুরস্কারের ফাঁকে ফাঁকে একটু গান-বিনোদনও থাকে। এবার যেমন চঞ্চল চৌধুরী আর রাহুল আনন্দের একটা পর্ব ছিল। সবাই খুব উপভোগ করেছে সেটা। আমি মনেপ্রাণে চাইব, পুরস্কার অনুষ্ঠানটা যেন সব সময় এ রকমই থাকে।
আমার কাছে সব পুরস্কারই মর্যাদার। কোনোটার চেয়ে কোনোটা ছোট নয়। তবে প্রথম আলোর পুরস্কারের একটা বৈশিষ্ট্য, এখানে যাঁরা বিচারক থাকেন, তাঁরা সবাই যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে কিংবদন্তি। তাঁদের মতো বিচারকদের বিচারে সেরা হতে পারাটাও খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ কিছু।
বাংলাদেশের সব খেলার সব খেলোয়াড়ের মধ্যেই প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কারের বিশেষ একটা আবেদন আছে। জেনেই বলছি, এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য একটা অলিখিত স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাও চলে খেলোয়াড়দের মধ্যে। সাকিব আল হাসান যে ছয়বার বর্ষসেরা হলো, আমি নিশ্চিত, সে–ও অপেক্ষায় আছে কবে পুরস্কারটা সপ্তমবারের মতো পাবে। সেটা পেলে সে প্রথমবারের মতোই আনন্দিত হবে আবার। কারণ, প্রথম আলোর এই পুরস্কার শুধুই পুরস্কার নয়, আমাদের খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারে অনেক বড় অলংকারও।
লেখক: জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক