একজন জামাল ভূঁইয়ার গল্প
স্ট্রাইকারদের বলের জোগান দিতে হবে? প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে হবে? আক্রমণভাগ ও ডিফেন্সের মধ্যে সমন্বয় দরকার? পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে হবে? দেশের তরে নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে?
চিন্তা কী, জামাল ভুঁইয়া আছেন না!
বাংলাদেশের ফুটবলে যেন এক টুকরো স্বস্তির পরশ হয়ে এসেছেন জামাল। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট দিয়ে নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছেন এই তরুণ। জিতেছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। চারদিকে শুধু ‘জামাল, জামাল’ রব। এই যে আজ চারদিকে জামাল-স্তুতি, তার পেছনের গল্পটা নিশ্চিতভাবেই যেকোনো পরিচালকের জন্য লুফে নেওয়ার মতো দুর্দান্ত এক চিত্রনাট্য! এর প্রতিটি পরতে পরতে হয়তো শিহরণ আর রোমাঞ্চের প্রতিধ্বনি নেই, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে যে বাধা পেরোনোর গল্প রয়েছে—সেটিও নিশ্চিতভাবেই তা দর্শকদের পাতে দেওয়ার জন্য দুর্দান্তই। তো পাঠক, চলুন, চোখ বোলানো যাক জামাল ভুঁইয়ার জীবনের গল্পে।
বাবা-মা ষাটের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে বসত গড়েন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। জামালের জন্ম ও বেড়ে ওঠা—সবই ওখানে। তিনি হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার, বাবা-মা ছেলেকে বানাতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক কিংবা আইনজীবী! ভাগ্যিস, জামাল শেষ পর্যন্ত ফুটবলার হওয়ার পথটি বেছে নিয়েছিলেন। না হলে কী আর বাংলাদেশের ফুটবলে জাগরণের সঞ্জিবনী হিসেবে একজন জামাল ভুঁইয়ার আবির্ভাব হতো!
আর সবার মতো গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাননি জামাল। এখনো তো ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজে নিজেই পড়াশোনা করেছেন আইটিতে! এ তো গেল ছাত্র জামালের কথা। এবার শুনুন ‘শিক্ষক’ জামালের কথা। ডেনমার্কের একটি হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জামাল ভুঁইয়া।
কিন্তু এসব মুদ্রার এপিঠ। ওপিঠে লেখা, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার খেলেছেন ডেনমার্কের শীর্ষস্থানীয় লিগে! পারফরম্যান্সের গ্রাফ ওঠানামা করেছে প্রায়ই, তাই কখনো খেলেছেন কোপেনহেগেনে প্রথম বিভাগের দলে, কখনো বা দ্বিতীয় কিংবা চতুর্থ বিভাগের দলে। মাঝখানে ফিলিপাইনেও খেলেছেন। সেই জামাল এখন অসম্ভব রকম পরিণত, আরও বেশি পেশাদার। কী সেই পালাবদলের মন্ত্র, যাকে ধ্যান-জ্ঞান করেই জামালের এই পরিবর্তন? চোখ বুজেই উত্তরটি দেওয়া যায়, লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চড়ানোর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা!
বাবা-মায়ের মুখে গল্প শুনে শিকড়ের টান ভোলেননি কিশোরগঞ্জের ছেলে। তাই বাংলাদেশ দলের জার্সি পরার স্বপ্ন ছিল বরাবরই। স্বপ্নপূরণের তরে ২০১১ সালে জামাল ভুঁইয়া এলেন জাতীয় দলের ট্রায়ালে অংশ নিতে। কিন্তু বিধি বাম! এ দেশের কন্ডিশন ও ফুটবল মাঠের সঙ্গে কোনোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না জামাল। ভুগছিলেন পানিশূন্যতায়। ফলাফল, জামালকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেন অনেকেই। অভিমানী জামাল ফিরে গেলেন ডেনমার্কে। কিন্তু লাল-সবুজের জার্সি চড়ানোর ইস্পাতদৃঢ় শপথকে কি আর একটু-আধটু অভিমান টলাতে পারে! তা পারেওনি। আরাধ্য বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তোলার ইচ্ছেটা পূরণ হলো অবশেষে ২০১৩ সালে ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের হাত ধরে। জামাল চোখও কেড়েছেন খুব তাড়াতাড়ি। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অনেকের চোখেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়।
আজ ২০১৫-তে এসে জামাল ভুঁইয়া হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ফুটবলের প্রতিবিম্ব। প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে এই মৌসুমে খেলবেন, স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে তাঁর পারিশ্রমিকই সবচেয়ে বেশি! অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত লাল-সবুজের জার্সি গায়ে প্রতিটি ম্যাচেই নামার সৌভাগ্য হয়েছে জামালের। গত বছর যশোরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ম্যাচ বাদ দিলে বাংলাদেশের সব কটি ম্যাচেই ছিলেন প্রথম একাদশে। কোচ ডি ক্রুইফ মুগ্ধ এই জামালে। বাংলাদেশ দলে জামালের গুরুত্ব বোঝাতে ক্রুইফ জামালের সঙ্গে তুলনা করেছেন আয়ারল্যান্ডের রয় কিন, হল্যান্ডের নাইজেল ডি জংদের! শ্রীলঙ্কার কোচ নিকোলা কাভাজোভিচ তো বলেই দিয়েছেন, তাঁর চোখে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আমাদের এই জামাল!
অথচ এই পথচলা কতটাই না বন্ধুর ছিল! এখানকার গরমের সঙ্গে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে জামালকে, অনেক কষ্টে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। এখানকার মসলাদার খাবার তাঁর খাদ্যাভ্যাসেও এনেছে বিশাল পরিবর্তন। এ দেশের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে লেপটে থাকা ‘ভাত’ও খেতে পারেন না অনভ্যস্ততার কারণে। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, ১৭ বছর বয়সেই থেমে যেতে পারত ফুটবলার জামালের গতিপথ। দুর্বৃত্তদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে চার-চারটি গুলি খেয়েছিলেন জামাল! তবু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, সৃষ্টিকর্তাকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ধন্যবাদ জানানো উচিত বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদেরও। এই জামাল যে জাগিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের ফুটবলকে!
জামাল সম্পর্কে সতীর্থ অধিনায়ক মামুনুলের মূল্যায়ন, ‘অসাধারণ একজন ফুটবলার। সতীর্থ হিসেবেও দারুণ। ডেনমার্ক থেকে এসে এভাবে আমাদের কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, তারপর ভালো খেলতে থাকা—সত্যিই বিস্ময়কর। দীর্ঘদিন পর এই পজিশনে এরকম মানের একজন ফুটবলার পেল বাংলাদেশ। এখন তো আমাদের লিগেও খেলবে। কোনো সন্দেহ নেই, ওর সামনে “ব্রাইট ফিউচার” অপেক্ষা করছে।’
জামালের জয়রথ এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের ফুটবলেরও যে ‘ব্রাইট ফিউচার’ অপেক্ষা করছে, তা তো বলেই দেওয়া যায়!