করোনার সময় জুড়েই চলছে এই অবস্থা। হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে বলতে হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে সাকিব আল হাসানের মোবাইল ফোন। কথা চালিয়ে যেতে আবার ফোন করা লাগে। কথা লম্বা হতে লাগলে আরও কয়েকবার। সাকিব আগেই অনুরোধ করে রাখেন, ‘যে কোনো সময় কথা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আবার ফোন দিয়েন।’
অথবা নিজেই ‘কল ব্যাক’ করেন। এবার প্রথম কথাটা হয় রসিকতা, ‘ফোনটার অবস্থা খারাপ। একটু পর পর বন্ধ হয়ে যায়। দিলেন না তো আপনারা একটা ফোন কিনে...!’ এত বেশি অধিকার নিয়ে বলা, যেন এ রকমই কথা ছিল! রসিকতার জবাবে পাল্টা রসিকতা এ প্রান্ত থেকে, ‘সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের ফোন নষ্ট! ঘটনা সত্যি হলে সাকিব আল হাসানকে ফোন কিনে দেওয়ার লোকের অভাব হবে না...।’
ও প্রান্ত, মানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন শহর থেকে ভেসে আসে হাসির শব্দ। ‘সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার’ বিশেষণটাকেও যেন সেই হাসিতে দূরে সরিয়ে দিতে চান সাকিব। আসলে কথাটা তো আর তিনি নতুন শোনেননি। এই আলোচনা সাকিবের কানে আগেও এসেছে যে, অলরাউন্ডার কূলের শিরোমণিদের সারিতে তিনি আছেন ভালোভাবেই। স্যার গারফিল্ড সোবার্স থেকে শুরু করে ইয়ান বোথাম, ইমরান খান, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি, জ্যাক ক্যালিসরা যে সারিটাকে এ যুগ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, সাকিব সেই সারিতে সর্বশেষ ঝান্ডা বাহক।
আর পরিসংখ্যান তো কেউ লুকিয়ে রাখেনি! তাতে সবার সমান অধিকার। পরিসংখ্যানের খোলা বই সামনে থাকলে যে কেউ সোবার্স-বোথামদের পারফরম্যান্সের পাশে সাকিবের পারফরম্যান্স বসিয়ে এও দেখে নিতে পারেন যে, সাকিব কীভাবে কীভাবে তাদের চেয়েও এগিয়ে। তিন সংস্করণের ক্রিকেট মিলে তাকে বলা যায় সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারও।
কাল রাতে ফোনে এ আলোচনা তুলতেই সাকিব শুরুতে বলে নিলেন, ‘আমি কিন্তু এভাবে চিন্তা করি না। এটা নিয়ে আমি ভাবি না।’ তাই কি হয়! এত এত কিংবদন্তির সারিতে নাম এসে যাচ্ছে, আর মাগুরার সাকিবের তাতে কিছুই যাবে আসবে না? এবার তিনি একটু খোলেন, ‘এটা ঠিক যে, তাঁদের নামের সঙ্গে আমার নামটা আলোচনায় আসে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। আমার ভালো লাগে। এটা আমি উপভোগ করি।’
এটা ঠিক যে, সব ক্ষেত্রেই ‘সর্বকালে’র সেরার আলোচনা সদা অমীমাংসিত এক ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা-এক যুগের কীর্তির সঙ্গে আরেক যুগের কীর্তির কোনো তুলনা চলে না। আর ক্রিকেটে দিনে দিনে এত বেশি প্রযুক্তির সমাহার ঘটেছে, সময়ের সঙ্গে খেলাটা এত বেশি পরিবর্তিত হয়েছে যে, এক সময়ের বাস্তবতা আরেক সময়ের বাস্তবতা থেকে পুরোই ভিন্ন। সেরারা আসলে যার যার সময়েরই প্রতিনিধিত্ব করেন। সাকিবও তাই। কিন্তু ওই যে পরিসংখ্যানের খাতা, কিছু অঙ্কের হিসাব, সেটিই সাকিবকে করেছে আর সবার চেয়ে আলাদা। তাকে তাই বলা যাচ্ছে তিন সংস্করণের ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা।
সাকিব নিশ্চয়ই চাইবেন, অক্টোবরে নিষেধাজ্ঞা শেষ করে এসে যত দিন খেলবেন, সেরাদের সেরার ঝান্ডাটা আরও উঁচুতে তুলে ধরতে। পারফরম্যান্সটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে, যেখানে গেলেই কেবল সর্বজন স্বীকৃতভাবে হওয়া যায় সেরাদের সেরা। এমন আলোচনায় সাকিব আরও বিনয়ী, ‘আসলে আমি খেলি আমার দলের জন্য। বাংলাদেশের জন্য। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার জন্য তো আমি খেলি না! আমি শুধু চাই যত দিন খেলব নিজের সেরাটা যেন দিতে পারি। সব ধরনের ক্রিকেটে দলের জন্য অন্যদের চেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারি। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং এবং আর যে যে ভাবে পারা যায়।’
গত অক্টোবর থেকে এই সাকিবের অভাবই অনুভব করছে বাংলাদেশ। দলে বোলার সাকিব নেই, ব্যাটসম্যান সাকিব নেই, নেতা সাকিব নেই। সাকিবের ভুল ছিল ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও জানাননি আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে। সেই ভুলের শাস্তি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা, যেটি শেষ হবে আগামী ২৮ অক্টোবর। মাঠে ফেরার সময় যত এগিয়ে আসছে, সাকিবও যেন রক্তের মধ্যে শুনতে পাচ্ছেন ক্রিকেটের ডাক। ঠিক করেছেন আগস্টেই শুরু করবেন অনুশীলন। কিন্তু সেটা কোথায়? এখনো তো তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন। সাকিব বলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি কোথায় অনুশীলন করব। এটা এখনো ভাবনাচিন্তার পর্যায়েই আছে।’
করোনাকাল সাকিবের জন্য এক দিক দিয়ে ‘আশীর্বাদ।’ অতিমারিতে সব খেলা স্থগিত হয়ে গেল, পিছিয়ে গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও। সাকিব খেলায় নেই বলেই যেন খেলাও মাঠ থেকে ছুটি নিল। বহিষ্কারাদেশের জন্য অন্তত গত চার মাসের খেলাগুলো তো মিস করতে হলো না তাঁকে। কী বিস্ময়, সাকিব যেমন খেলায় ফেরার অপেক্ষায় আছেন, ক্রিকেটও যেন তারই অপেক্ষায়! সাকিবের জন্য একেকটা ম্যাচ মানেই তো আরও কিছু রান, আরও কিছু উইকেট এবং পূর্বসূরি অলরাউন্ডারদের চেয়ে আরও বেশি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ।
বলতে পারেন, করোনাভাইরাস সাকিবকে কি সুযোগটাই না করে দিল! নাকি উল্টো করে বলবেন ‘বীর ভোগ্যা এ বসুধা’...পৃথিবীটা সাহসীদের জন্য। বীরদের বিজয়ীর বেশে দেখতে অপেক্ষায় থাকে জগৎসংসারও!