দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল পাওয়ার দিন
>২০০০ সালের ২৬ জুন, ২০ বছর আগে ঠিক এই দিনে লর্ডসে অনুষ্ঠিত আইসিসির সভায় টেস্ট মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। অনেক অপেক্ষার ফল ছিল সেটি। আইসিসির সে সভায় বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন সে সময়ের বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। টেস্ট মর্যাদার দুই দশক পূর্তিতে তিনিও ফিরে গেলেন ২০ বছর আগে—
এত বড় একটা দিন, এত বড় একটা সভা। স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল। আমি তো বলি, ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বলেছিলাম, তিন বছরের মধ্যে টেস্ট মর্যাদা পেতে চাই। যদিও ভাবিনি সত্যি সত্যিই এটা হয়ে যাবে। এর পেছনে অনেক পরিকল্পনা ছিল। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা লাভ ছিল অনেক বড় দলীয় প্রচেষ্টার ফসল।
বাংলাদেশের মানুষ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কী হবে; আসলেই আমরা টেস্ট মর্যাদা পাব কি না! আমিও তাই বাড়তি একটা চাপ অনুভব করছিলাম। সভাটা হয়েছিল লর্ডসের লং রুমে। এ ধরনের সভায় আলোচনার জন্য যেসব বিষয় উত্থাপন করা হয়, সেসব নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। নিজেদের দাবির সপক্ষে বক্তব্য রাখতে হয়। বক্তব্যের পর কী প্রশ্ন আসতে পারে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে আমি আর বিসিবির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক সে সম্পর্কে একটা ধারণা দাঁড় করিয়েছিলাম। তিনিও আমার সঙ্গে লর্ডসের সভায় ছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার সমর্থন আমরা আগেই নিশ্চিত করেছিলাম। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—এই তিন দেশের বোর্ডের দিকে তাকিয়েই আমরা টেস্ট মর্যাদার জন্য আবেদন করি। ভোট না থাকলেও সহযোগী সদস্যদেশগুলোর মতামতেরও গুরুত্ব ছিল। কেনিয়া যেমন বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। আমাদের আগে সর্বশেষ টেস্ট মর্যাদা পাওয়া দেশ জিম্বাবুয়ে আমাদের সমর্থন করবে, এটাও প্রত্যাশিতই ছিল।
অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান ডেনিস রজার্স, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী বাখার, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রধান জন অ্যান্ডারসন—সভার আগে সবার সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেছিলাম। কিন্তু সভার আগে তো আর কেউ প্রকাশ্যে বলে না, তোমাদের সমর্থন করব। একটা স্নায়ুচাপ তাই ছিলই।
এর আগে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এক সভায়ও আমাকে এ নিয়ে চার–পাঁচ ঘণ্টার প্রেজেন্টেশন দিতে হয়েছিল। তাঁরা অনেক খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছিলেন। আমার জন্য সেটা একধরনের 'ওয়ার্মআপ'ই হয়েগিয়েছিল। এ ছাড়া লর্ডসের সভা সামনে রেখে আমি নিউজিল্যান্ডের চেয়ারম্যান জন অ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে নিউজিল্যান্ড এত দূরের পথ। মাত্র ৪০ মিনিটের আলোচনার জন্য আমাকে ওখানে গিয়ে দুই দিন থাকতে হয়েছিল।
২০০০ সালের ২৬ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত আইসিসির সভায় আমি আত্মবিশ্বাস নিয়েই প্রস্তাব উপস্থাপন করি। দক্ষিণ এশিয়া সমর্থন দিল। আলী বাখার তো জোরালোভাবেই সমর্থন করলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অস্ট্রেলিয়ার ভাবনাটা। তারা এক–দুটি ছোট ছোট প্রশ্ন করল। যেমন, টেস্টে আমাদের উন্নতি করতে কত সময় লাগতে পারে। আমরা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে আগেই বলেছিলাম, শুধু ভোট দিলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। টেস্ট আঙিনায় আমাদের পথচলায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ারও অংশগ্রহণ থাকতে হবে। আমাদের কৌশল ছিল, সবাইকে বোঝানো যে আবেদনটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের স্বার্থেই। বাংলাদেশ টেস্ট জাতি হলে বিশ্ব ক্রিকেটই লাভবান হবে।
লর্ডসের সভায় হয়তো সে কারণেই কেউ আমাদের বিরোধিতা করেনি। আইসিসির তৎকালীন সভাপতি ম্যালকম গ্রে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ঘোষণা দিলেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দলের তখনকার অধিনায়ক আমিনুল ইসলামও।
আমরা যে সেদিনই টেস্ট মর্যাদা পেয়ে যাব, সেটি কিন্তু নিশ্চিত ছিল না। যখন পেয়ে গেলাম, ফুটবল ম্যাচে লম্বা সময় অপেক্ষার পর গোল হলে যে অনুভূতি হয়, আমার ঠিক সেটাই হয়েছিল। সঙ্গে নতুন একটা চিন্তা—কীভাবে আমরা আগামী দিনগুলোতে এগোবে? আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশ কি টেস্ট ক্রিকেটের জন্য তৈরি? আমি বলেছিলাম, না, পুরোপুরি তৈরি না। তবে সহযোগী দেশ হিসেবে যে প্রস্তুতি থাকতে হয়, সেটা আমাদের আছে। বাকিটা খেলতে খেলতে হয়ে যাবে। আর টেস্ট মর্যাদা না পেলে তো আমরা ওই পর্যায়ে যেতে পারব না!
জিম্বাবুয়ে তিনবার আইসিসি ট্রফি জেতার পর টেস্ট মর্যাদা পেয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, টেস্ট মর্যাদা না পেলে জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট মরে যাবে। আমরা এই নেতিবাচক ভাবনায় আবেদন করিনি। আমাদের কথা ছিল, বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেলে বিশ্ব ক্রিকেট উপকৃত হবে। জগমোহন ডালমিয়া, আলী বাখাররা তখন ক্রিকেটের বিশ্বায়ন ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। আমাদের ভাবনা তাঁদের চিন্তার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল।
টেস্ট মর্যাদা লাভের পথে আমাদের আরেকটি কৌশল ছিল ঢাকাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সেটির অংশ হিসেবেই ১৯৯৮ সালে ইনডিপেনডেন্স কাপ ও মিনি বিশ্বকাপ আয়োজন করা হলো। আমরা বিশ্বকে বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা আছে, পৃষ্ঠপোষক আছে, খেলাটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তুমুল আগ্রহ আছে। এসবই ছিল আমাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার অংশ। ২০০০ সালের ২৬ জুন ছিল সেসবেরই ফল পাওয়ার দিন।
লেখক: সংসদ সদস্য ও বিসিবির সাবেক সভাপতি।