উয়েফাকে যেভাবে বোকা বানাচ্ছে বার্সেলোনা-জুভেন্টাস

এই দলবদলে মাঠের খেলায় যে ক্লাবই লাভবান হোক না কেন, হিসাবের খেলায় জয়ী দুই দলই। ফাইল ছবি
এই দলবদলে মাঠের খেলায় যে ক্লাবই লাভবান হোক না কেন, হিসাবের খেলায় জয়ী দুই দলই। ফাইল ছবি

নতুন জাভিকে পেয়ে গেছে বার্সেলোনা - দুই বছর আগে আর্থুর মেলোর বার্সেলোনার যাওয়ার খবরে এভাবে উল্লাস করেছিল বার্সেলোনা সমর্থকেরা। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিপক্ষের জমাট রক্ষণের ছিদ্র খুঁজে বের করার যে অনন্য দক্ষতা ছিল জাভি হার্নান্দেজের, সেটার ছাপ পাওয়া গিয়েছিল আর্থুরের মাঝে। কিন্তু দুই মৌসুমেই মোহ কেটে গেল বার্সেলোনার। জুভেন্টাসের কাছে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডারকে বিক্রি করে দিচ্ছে বার্সেলোনা। কাতালান ও ইউরোপের বিশ্বস্ত সব দলবদলের সূত্রগুলো প্রায় নিশ্চিত করে দিয়েছে এ তথ্য।

ভবিষ্যতের জন্য যাঁকে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে বর্তমানের চাহিদার কাছে হার মেনে ছেড়ে দিচ্ছে বার্সেলোনা বোর্ড। এ কারণেই ২৩ বছরের আর্থুরকে ছেড়ে দিয়ে জুভেন্টাস থেকে ৩০ বছরের মিরালেম পিয়ানিচকে নিয়ে আসছে বার্সেলোনা। দলবদলের অংকটা নিয়ে যদিও বেশ আলোচনা চলছে ফুটবল অঙ্গনে। সত্যিকার অর্থে এই অদলবদলে বার্সেলোনার লাভ হচ্ছে ১০ মিলিয়ন ইউরো। পিয়ানিচের সঙ্গে আর ১০ মিলিয়ন ইউরো দিয়েই সাত বছর কম বয়সী আর্থুরকে নিচ্ছে জুভেন্টাস। তবু কেন দলবদলের বাজারে 'আর্থারের জন্য ৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করছে জুভেন্টাস' - এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে? বলা যায়, দুই ক্লাবই হিসাববিজ্ঞানের নিয়মের সুযোগ নিয়ে উয়েফার আর্থিক সঙ্গতির নীতিকে ফাঁকি দিতেই দলবদলটা করছে।

প্রথমেই ফুটবল ক্লাবের সম্পদের হিসাব কীভাবে হয়, সেটায় একটু আলোকপাত করা যাক। ফুটবলারদের ক্লাবগুলো আর যেকোনো সম্পদের মতোই ব্যবহার করে। অর্থাৎ কেনার সময় একজন ফুটবলারের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তাঁকে সেই দামের সম্পদ ভাবা হয়। এবং চুক্তির মেয়াদকে সে সম্পদে মূল্য বুঝে নেওয়ার ভিত্তি ধরা হয়। অর্থাৎ কোনো খেলোয়ারকে ৫ বছরের চুক্তিতে ১০ মিলিয়ন ইউরোতে কেনা হলে অবচয়ের সূত্র অনুযায়ী ক্লাবের হিসাব রক্ষণের খাতায় প্রতি বছর ওই খেলোয়াড়ের মূল্য ২ মিলিয়ন ইউরো করে কমবে। অর্থাৎ এক বছর পর ওই খেলোয়াড়ের মূল্য লেখা হবে ৮ মিলিয়ন ইউরো। কারণ, চুক্তির এক বছরে তাঁর জন্য অবচয় ধরা হয়েছে (১০/৫) বা ২ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু খেলোয়াড় বিক্রি করার সময়ে যে অর্থে বিক্রি করা হয়, সেটা পুরোটাই লাভের খাতায় দেখানো হয়।

এ নিয়মের সুবিধা সব ক্লাবই নেয়। বার্সেলোনার সর্বশেষ এমন একটি দলবদলের উদাহরণ দেখা যাক। ২০১৮ সালে রোমার কাছ থেকে রীতিমতো ছিনতাই করে আরেক ব্রাজিলিয়ান ম্যালকমকে নিয়ে এসেছিল বার্সেলোনা। ৪১ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনা ম্যালকমকে পরের মৌসুমেই জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে ৪০ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করা হয়েছিল। সাধারণ চোখে এতে বার্সেলোনার ক্ষতি ১ মিলিয়ন ইউরো। কিন্তু হিসাববিজ্ঞানের ভাষা ভিন্ন। যেহেতু ম্যালকমকে ৫ বছরের জন্য নেওয়া হয়েছিল, সেহেতু এক বছরে ম্যালকম নামক সম্পদের পাঁচ ভাগের একভাগ (৪১/৫) ক্লাব এরই মাঝে বুঝে নিয়েছে। এর ফলে ২০১৯ এর জুনে বার্সেলোনার খাতায় ম্যালকমের মূল্য ছিল ৩২.৮ মিলিয়ন ইউরো। তাঁকে জেনিতের কাছে বিক্রি করে বার্সেলোনা তাদের ক্লাবের খাতায় উল্‌টো ৭.২ মিলিয়ন লাভ দেখিয়ে দিয়েছে।

এখন আসা যাক, আর্থুর ও পিয়ানিচের দলবদলের হিসেবে। বার্সেলোনাও ও জুভেন্টাস চাইলেই এই দলবদলকে আর্থুর = পিয়ানিচ + ১০ মিলিয়ন বলতে পারত। কিন্তু তাতে দুই ক্লাবেরই কোনো লাভ নেই। উয়েফার আর্থিক নিয়মের জালে আটকে আছে দুই দলই। দুই ক্লাবই ৩০ জুনের মধ্যে আয় দেখাতে না পারলে আগামী দলবদলে নতুন খেলোয়াড় দলে আনতে পারবে না। এ অবস্থায় দুই দলকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হিসাববিজ্ঞান।


আর্থুরকে ৮০ মিলিয়ন ইউরোতে কিনে নিচ্ছে জুভেন্টাস, ওদিকে বার্সেলোনা পিয়ানিচকে কিনে নিচ্ছে ৭০ মিলিয়নে। ফলে অর্থের হাতবদল ১০ মিলিয়ন ইউরোই হলো, কিন্তু কাগজে-কলমে এর অর্থ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৮ সালে আর্থুরকে ৩০ মিলিয়ন ইউরোতে ৬ বছরের জন্য দলে টেনেছিল বার্সেলোনা। দুই বছর পর অ্যামোরটাইজেশন-এর নিয়ম মেনে বার্সেলোনার খাতায় আর্থুরের নামের পাশে লেখা আছে ২০ মিলিয়ন ইউরো। কারণ প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন ইউরো শোধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় আর্থারকে ৮০ মিলিয়নে বিক্রি করার মানে হলো, এক ধাক্কায় ৬০ মিলিয়ন ইউরো লাভ দেখানো যাবে ক্লাবের হিসাবের খাতায়।


ওদিকে ২০১৬ সালে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে জুভেন্টাসে যোগ দিয়েছিলেন পিয়ানিচ, ৫ বছরের চুক্তি। ফলে ক্লাবের খাতায় তাঁর মূল্য প্রতি বছর ৭ মিলিয়ন করে কমছিল। দুই বছর পর যখন তাঁর মূল্য দাঁড়ায় ২১ মিলিয়ন ইউরো, ঠিক তখন আবার ৫ বছরের নতুন চুক্তি হয়। ফলে বাৎসরিক অবচয় ৭ মিলিয়ন থেকে ৪.২ মিলিয়নে নেমে আসে। এই দুই বছরে পিয়ানিচের মূল্য জুভেন্টাসের খাতায় কমেছে তাই আরও ৮.৪ মিলিয়ন ইউরো। বর্তমানে এই বসনিয়ান মিডফিল্ডারের দাম তাঁর ক্লাবের খাতায় ১২.৬ মিলিয়ন। এখন বার্সেলোনা তাঁকে কাগজে-কলমে ৭০ মিলিয়ন ইউরোতে কেনা মানে, এই দলবদলে জুভেন্টাস লাভের খাতায় ৫৭.৪ মিলিয়ন ইউরো যোগ করে ফেলছে এক লহমায়!
অর্থাৎ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে যে দলবদলে দুই খেলোয়াড়ের অদলবদলের পাশাপাশি বার্সেলোনায় আয় ১০ মিলিয়ন আর জুভেন্টাসে ব্যয় ১০ মিলিয়ন দেখাচ্ছে, সেখানে ক্লাব ও উয়েফার হিসেবে দুই দলই বরং ৬০ মিলিয়ন ইউরোর কাছাকছি লাভ দেখাচ্ছে এক দলবদলেই। এতে দুই ক্লাবেরই রুগ্ন আর্থিক চেহারা ঝকঝকে হয়ে উঠল এক লহমায়, অন্যদিকে আসছে মৌসুমে নতুন খেলোয়াড় কেনায়ও আপাত বাধা দূর হয়ে গেল দুই ক্লাবেরই। এই দলবদলে মাঠের খেলায় যে ক্লাবই লাভবান হোক না কেন, হিসাবের খেলায় জয়ী দুই দলই।

ফলে আর্থুরকে ৮০ মিলিয়ন আর পিয়ানিচকে ৭০ মিলিয়ন ইউরোতে কেনার খবরে যতই অবিশ্বাস নিয়ে তাকান না কেন, মেনে নিতে হবে আপনাকে সেটা। তবে ২৩ বছর বয়সী আর্থুরকে জুভেন্টাসের কাছে বেচে দিয়ে এরই মধ্যে ত্রিশোর্ধ্ব মেসি, সুয়ারেজ, পিকে, রাকিতিচ, আলবা, ভিদালদের দলে ত্রিশোর্ধ্ব আরেক মিডফিল্ডার আনা বার্সার জন্য কতটুকু লাভের, সে হিসেব আপাতত শিকেয় তুলে রাখছে বার্সা বোর্ড।