ইউনাইটেড তাঁকে চেয়েছিল, বুলেট সব শেষ করে দিল
>২০১০ বিশ্বকাপে প্যারাগুয়ের হয়ে খেলার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ঘাতকের এক বুলেট থামিয়ে দিয়েছে তাঁর ক্যারিয়ার।
এক সেকেন্ডেই যে সব শেষ হয়ে যেতে পারে, ফুটবলাররা তা খুব ভালোই জানেন। অনেক আশার ঝলক দেখানো ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে দিতে পারে প্রতিপক্ষের কোনো কড়া ট্যাকল। দেখা গেল, হয়তো বা লিগামেন্ট ছিড়ে গেল, বা অ্যাঙ্কেলের একটা চোট ক্যারিয়ারের গ্রাফটাতে এঁকে দিল নিম্নগামী রেখা।
কিন্তু প্যারাগুয়ের সাবেক ফরোয়ার্ড সালভাদর কাবানিয়াসের ক্ষেত্রে এসব কিছু নয়, ক্যারিয়ারের শেষ টেনে দিয়েছে একটা বুলেটই। মেক্সিকো সিটির এক বারে তাঁর মাথায় বিঁধে যাওয়া আততায়ীর সেই গুলি যে জীবনের শেষই যে টেনে দেয়নি, যমে-মানুষে টানাটানির পর যে বেঁচে ফিরেছেন, সে-ই হয়তো অনেক।
২০১০ সালের কথা। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলে তখন কাবানিয়াস বড় নাম। অন্য অনেক দক্ষিণ আমেরিকান তারকার মতো অবশ্য অল্প বয়সেই দ্যুতি ছড়িয়ে ইউরোপের কোনো ক্লাবে আসা হয়নি তাঁর। কাবানিয়াস বরং ছিলেন ফুটবলের ভাষায় যাঁদের বলা হয় ‘লেইট ব্লুমার’, তেমন একজন—একটু বেশি বয়সে এসে আলো ছড়ানো শুরু হয় তাঁর। নিজ শহর ইতাউগাতে ‘টুয়েলভ দে অক্তোবর’ ক্লাবের হয়ে ১৯৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে শুরু পেশাদার ক্যারিয়ারে কাবানিয়াস দ্যুতি ছড়াতে শুরু করেন তিন বছর পর, চিলির ক্লাব অদাক্স ইতালিয়ানোতে এসে। সেখানে ৫৩ ম্যাচে ২৯ গোল তাঁকে দুবছর পর নিয়ে যায় মেক্সিকোর হুগারেস দে শিয়াপাসে। সেখানে ১০৬ ম্যাচে কাবানিয়াসের গোল ৬১টি।
এমন পারফরম্যান্সের ফল? ২০০৩ সালেই প্যারাগুয়ে দলে ডাক পান কাবানিয়াস। যদিও শুরুর দিকে রকে সান্তা ক্রুস, নেলসন কেভাসদের দাপটে জাতীয় দলে তেমন খেলার সুযোগ পাননি। ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়া প্যারাগুয়ের প্রতিটি ম্যাচে কাবানিয়াস বসে ছিলেন বেঞ্চেই।
কিন্তু জার্মানি থেকে আসার পর কিছু একটা যেন পেয়ে বসে কাবানিয়াসকে। ২৫ বছর বয়সে এসে আরও জ্বলে ওঠা তাঁর, যেন গতিতে চলতে থাকা কোনো গাড়ির একটা গিয়ার বাড়িয়ে দেওয়ার মতো। হুগারেস ছেড়ে সেই গ্রীষ্মেই মেক্সিকোর দুঁদে ক্লাব আমেরিকায় যান কাবানিয়াস, প্রথম মৌসুমেই করেন ২৯ গোল। সব মিলিয়ে সেখানে চার বছরে ১১৫ ম্যাচে কাবানিয়াসের গোল ছিল ৯৬টি! ২০০৭ ও ২০০৮—দুই মৌসুমেই দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্ট কোপা লিবার্তাদোরেসের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন কাবানিয়াস। ২০০৭ সালে জেতেন দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারও। যে পুরস্কার এক সময় উঠেছিল পেলে, জিকো, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, মারিও কেম্পেস, সক্রেটিসের মতো কিংবদন্তিদের হাতে!
শুধু ক্লাব আমেরিকাই কেন, জাতীয় দলেও কাবানিয়াস কম যাননি! ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে যেখানে ১৪ ম্যাচে প্যারাগুয়ের জার্সিতে করেছিলেন ১ গোল, শুধু ২০০৭ কোপা আমেরিকায় সেই কাবানিয়াস করলেন ৩ গোল। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে তাঁর ৬ গোলে জেরার্দো মার্তিনোর অধীন প্যারাগুয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দশ দলের মধ্যে তৃতীয় হয়ে যায় বিশ্বকাপে। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও কলম্বিয়া সেবার বাছাইপর্বে ছিল প্যারাগুয়ের পেছনে!
পেটানো শরীর আর মাঠে দাপুটে চলাফেরার কারণে ‘এল মারিসকাল’ বা দ্য অ্যাডমিরাল নাম পাওয়া স্ট্রাইকার সে সময় ইউরোপে খেলারও প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু ফিরিয়ে দেন। ‘সে সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা আরেকটি বড় ক্লাবে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে ১৭ লাখ ডলারের সমঝোতাও প্রায় হয়ে গিয়েছিল আমার’—২০১৪ সালে এবিসি কালার চ্যানেলে বলেছিলেন কাবানিয়াস। কিন্তু যাননি কেন? ‘কিন্তু ক্লাব আমেরিকা আমার বেতন দ্বিগুণ করে দেয়। আকাপুলকো ও কানকুনে আমাকে দুটি অ্যাপার্টমেন্টও দিয়েছিল, যাতে আমি ক্লাবে থাকি’—কাবানিয়াসের সরল স্বীকারোক্তি।
কিন্তু ২০১০ সালের জানুয়ারিতে তাঁর মসৃণ গতিতে চলতে থাকা জীবনে এল সেই ভয়াল রাত। ২৫ জানুয়ারি। স্ত্রীকে মেক্সিকো সিটির এক জাঁকজমকপূর্ণ বারে গিয়েছিলেন কাবানিয়াস। সেখানে একজনের সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল তাঁর। কিছুক্ষণ পর কাবানিয়াস বারের টয়লেটে যেতেই ‘ধুম’ আওয়াজ! গুলিটা লাগে কাবানিয়াসের মাথায়।
তাঁর ওপর হামলার খবরে মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলই আঁতকে ওঠে। দশদিন কোমায় ছিলেন কাবানিয়াস। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে চার মাস ধরে যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসা শেষ করে ফেরেন প্যারাগুয়েতে। আজও তাঁর খুলিতে বুলেটের দাগটা আছে।
কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ার সেই যে থমকে গেছে, আর ফিরতে পারেননি কাবানিয়াস। সেরে ওঠার পর প্রথমদিকে আবার ফুটবলে ফেরার ব্যাপারে বেশ জোর গলা ছিল কাবানিয়াসের। ২০১১ সালের শুরুর দিকে আসুনসিওনের দল লিবের্তাদে অনুশীলনও শুরু করেন। কিন্তু দ্রুতই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শীর্ষ স্তরে খেলার দম আর নেই কাবানিয়াসের। বুলেটটা শুধু তাঁর খুলিতে দাগই ফেলে যায়নি, তাঁর ক্যারিয়ারও শেষ করে দিয়েছে।
পরের বছর তাঁর প্রথম ক্লাব টুয়েলভ দে অক্তোবরে নায়কের সম্মান নিয়ে ফেরেন, ক্লাবটা তখন প্যারাগুয়ের ফুটবলের তৃতীয় স্তরে খেলে। ক্লাবটাকে সেই মৌসুমে দ্বিতীয় স্তরে উঠিয়ে আনায় কাবানিয়াসের দারুণ অবদান ছিল বটে, কিন্তু টিকতে পারেননি বেশিদিন। ২০১৪ সালে আরেকবার ব্রাজিলের চতুর্থ স্তরের দল তানাবিতে গিয়ে ক্যারিয়ারটা গোছানোর চেষ্টা করেছিলেন কাবানিয়াস। এক মাসের বেশি টেকেননি। বুঝতে পারেন, সতীর্থদের সঙ্গে আর তাল মেলাতে পারছেন না। কাবানিয়াস ফিরে যান নিজ শহর ইতাগায়, কাজ শুরু করেন নিজেদের পরিবারের বেকারি ব্যবসায়। ‘এই যে, জীবনটা আবার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। সবকিছু হারানোর পরও আমার নিজের ওপর বিশ্বাস এখনো টলে যায়নি’—২০১৪ সালে এএফপিকে বলেছিলেন কাবানিয়াস।
ওই ঘটনার কিছু পর তাঁর সঙ্গিনীও ছেড়ে যান তাঁকে, আর্থিক কিছু ঝামেলায়ও পড়েন কাবানিয়াস। ২০১০ বিশ্বকাপে প্যারাগুয়ের হয়ে খেলাও হয়নি। তাঁর স্বাস্থ্য, তাঁর জীবিকা, তাঁর আর্থিক স্বচ্ছলতা...সবই কেড়ে নিয়েছে ওই বুলেট। এখন আবার কোচিংয়ে নেমেছেন কাবানিয়াস। মেক্সিকোতে কিছুদিন কোচিং করিয়ে এখন প্যারাগুয়েতে ফেরা বর্তমানে ৩৯ বছর বয়সী কাবানিয়াস নাকি তাঁর ঘাতককে ক্ষমাও করে দিয়েছেন। ‘ক্ষমা মন থেকে আসে। যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তাঁকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। এতে অন্তত মানসিক শান্তি পাচ্ছি। আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ায় আমি শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। আর জীবনটাকে উপভোগ করি’—তৃপ্ত দেখায় কাবানিয়াসকে।
যা আছে, তাতেই সুখ খুঁজে নেওয়ার তৃপ্তি।