'গৃহবন্দী' ক্রীড়া সাংবাদিকতা
>করোনাভাইরাসের এ সময়টা খেলাহীন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সব ধরনের খেলা বন্ধ। থমকে গেছে সব ধরনের যোগাযোগও। ক্রীড়া সাংবাদিকতা এখন কার্যত ঘরবন্দী। খেলার সাংবাদিকতার জন্য এ এক কঠিন সময়। এখন কী করবেন ক্রীড়া সাংবাদিকেরা?
সেদিন অফিসে বসে ‘ছোট পর্দায় আজ’ কপিটা দেখে খুব হাসি পেল। যে সহকর্মী এটি তৈরি করেছেন, তাঁরও নিশ্চয়ই অদ্ভুত লেগেছে। এই তো সপ্তাহ দুই-এক আগেও ‘ছোট পর্দায় আজ’ বিভাগে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে এমন কোনো খেলা যেন বাদ না পড়ে, সেটি নিয়ে গলদঘর্ম হতেন যে কোনো পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগের কর্মীরা। কিন্তু আজ সেটি ভর্তি করতে হচ্ছে ‘প্রিমিয়ার লিগ ওয়ার্ল্ড হাই লাইটস’, ‘রিভিউ অব দ্য সিজন’, ‘গ্রেট সেঞ্চুরিজ’ ‘ক্ল্যাসিক ম্যাচেস’ ইত্যাদি দিয়ে। করোনার আক্রমণে সারা দুনিয়া যখন থমকে গেছে, লাখো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণহানির পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে, তখন খেলাধুলার আয়োজনকে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। দুনিয়াজুড়ে সেটিই হয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে খেলা-ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিকস সবই। ভাবা যায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ইতালীয় সিরি ‘আ’, স্প্যানিশ লা লিগা বন্ধ, বন্ধ চ্যাম্পিয়নস লিগ, পিছিয়ে গেছে অলিম্পিকের মতো আয়োজন, ইউরোর আয়োজন। বাড়িতে রীতিমতো বন্দী জীবন-যাপন করছেন খেলোয়াড়েরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝেমধ্যে নিজেরা নিজেদের বন্দী জীবনের গল্পগুলো তুলে দিচ্ছেন-ঘরকন্নার কাজও করছেন অনেকে। লিওনেল মেসি কোনো কাজ না পেয়েছে টয়লেট রোল দিয়ে জাগল করছেন! লুঙ্গি পরে বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে মাশরাফি বিন মুর্তজার ছেলের সঙ্গে ক্যারম খেলার দৃশ্যও এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবার দেখা হয়ে গেছে।
দুনিয়াজুড়ে খেলা নেই। এটা খেলোয়াড়দের জন্য কষ্টকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটা সংবাদকর্মী, বিশেষ করে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িতদের যে কত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, সেটা সবাই বুঝতে পারছেন। খেলা নেই মানে ক্রীড়া সাংবাদিকদের অফুরন্ত অবসর-এমনটা ভাবার কিন্তু কোনো কারণ নেই। পেশাদারত্বের জায়গা থেকে, ক্রীড়াপ্রেমীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের এ অবস্থার মধ্যেও হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে খেলা যখন নেই, তখন ক্রীড়া সাংবাদিকেরা কী নিয়ে হাজির হবেন পাঠকদের সামনে। হ্যাঁ, খেলা না থাকলেও করোনার সংবাদ আছে। পৃথিবীময় অনেক খেলোয়াড়ই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেক খেলোয়াড়েরাই নিজেদের উপার্জনের অর্থ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দান করছেন-এসব খবর তো আছেই। কিন্তু এসব তো খুব বেশি নয়। সংবাদপত্রের পাতা তো আর এসব সংবাদ দিয়ে ভরা সম্ভব নয়। মাঠে খেলা নেই। করোনার কারণে খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ, প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয় কার্যত চলছে কর্মীদের বাড়ি থেকে। এমন সময় ক্রীড়া সাংবাদিকেরা কী করতে পারেন!
সময়টা সত্যিই অদ্ভুত। বাংলাদেশে অনেক জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিকেরাও বলতে পারছেন না, তাদের ক্যারিয়ারে এমন সময় অতীতে কখনো এসেছে কিনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাভাবিকভাবেই খেলাধুলা বন্ধ ছিল। এরপর দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে খেলা বন্ধ থেকেছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের মাঠমুখী হওয়ার প্রশ্ন আসেনি, কিন্তু এখনকার মতো পরিস্থিতি কখনোই মোকাবিলা করেননি কেউই। সেদিন দুঃখ করে এক সহকর্মী বলছিলেন, সময়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের না হলে যে কী হতো! দুনিয়াময় বিভিন্ন খেলার তারকারা ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামেই তো ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রেখেছেন। পাঠকেরাও একটা জরিপ করতে পারেন, প্রকাশিত সংবাদগুলোর কত শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে করা, আর কতগুলো এর বাইরের। মোটকথা, এটা এমন একটা সময় যেটির জন্য কোনো পূর্ব প্রস্তুতি কারওরই ছিল না।
ক্রীড়া সাংবাদিকেরা এখন তাহলে কী করবেন! বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করবেন? সেটার পথও তো বন্ধ। ফেডারেশনগুলো তাদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। চলাফেরাও সীমিত হয়ে গেছে এই মারাত্মক রোগের সংক্রমণে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন? করোনা সংক্রমণের এ সময় খেলোয়াড়েরা আপনার সঙ্গে কথা বলবেন কেন! ওয়ান-টু-ওয়ান সাক্ষাৎকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। সেদিন ফিফা আর আইসিসি দারুণ একটা জিনিস করেছে। তাদের আর্কাইভ তারা খুলে দিয়েছে সম্প্রচার সঙ্গী বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য। উদ্দেশ্য একটাই খেলাহীন এ সময়টাতে যেন খেলাপ্রেমীদের সঙ্গে একটু সংযোগ স্থাপন করা যায়। খেলাপ্রেমীরা যেন একটু অতীতে ফিরে যেয়ে স্মৃতিকাতর হতে পারেন। ব্যাপার অনেকটা ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ ধরনের। ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও কি তাহলে এ লাইনই ধরতে হবে? করোনার এই সময়টাতে কি পাঠকদের নিয়ে যেতে হবে অতীতে! খেলাহীন এ সময়টাতে ব্যাপারটা মন্দ নয়, কী বলেন!
অনেকেই বলছেন, এটা ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য বড় একটা সুযোগ। খেলার প্রতিবেদন, খেলার আগে, পরের সংবাদ সম্মেলন, খেলোয়াড়দের পিছু নিয়ে দুই-একটি প্রশ্ন করে, কিছু কথা বলিয়ে, তার ভিত্তিতে লেখা, ওয়ান-টু ওয়ান সাক্ষাৎকারের বাইরেও খেলা নিয়ে যারা সাংবাদিকতা করেন, তাদের অনেক কাজ আছে। করোনার এই সময়টা ওই কাজগুলোকেই মনে করিয়ে দিয়েছে নতুন করে। বর্তমানের যেকোনো কিছুর বিশ্লেষণ তো এর মধ্যে আছেই, খেলার মাঠের কিংবা এর বাইরের অনেক গল্প যেগুলোর খেলার জন্য ঢাকা পড়ে থাকে, সেগুলোকেও তুলে এনে পাঠকদের সামনে হাজির করার সময় এটাই। ক্রীড়া সাংবাদিকদের অতীতচারী হতেই হয়, সেটা করার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর কী হতে পারে! এ প্রজন্মের সামনে অনেকেই বলেন ‘ফুটবলের সোনালি সময়ে’র কথা। সে সময়টা আসলেই ‘সোনালি’ ছিল কিনা, বা থাকলেও কতটা ছিল, কীভাবে ছিল, সেটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সময় এখন নয় তো কখন। আজ মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকরা দেশের ক্রিকেটে রাজত্ব করছেন, তাদের পূর্বসূরিরা এখন কেমন আছেন, কী করছেন; এ দেশের ক্রিকেট এ পর্যায়ে কীভাবে এল, এ প্রজন্মের পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানতে চান, তাদের আগ্রহ উসকে দেওয়ার কাজটাও তো এখনই করা যায়। আচ্ছা, সংবাদপত্রগুলো তো পারে, এই সময় ফিফা, আইসিসির মতো করে নিজেদের আর্কাইভ উন্মুক্ত করে দিতে। একজন জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক যদি তাঁর বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের গল্প নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হন, সেটিও তো কম উপাদেয় হয় না।
ক্রীড়া সাংবাদিকতা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-এতে আক্ষেপ করার কিছুই নেই। যেখানে গোটা পৃথিবীর কঠিন সময়, একটা ছোট্ট ভাইরাস যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, চীন জাপানের মতো দেশগুলোকে কাবু করে দিয়েছে, যেখানে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ক্রীড়া সাংবাদিকতা নিয়ে আফসোস-আক্ষেপ খুবই গৌণ ব্যাপার। সারা দুনিয়ার জন্য করোনা যেমন কঠিন এক পরীক্ষা, ক্রীড়া সাংবাদিকেরাও এটিকে তেমনই একটা পরীক্ষা হিসেবে নিতে পারেন। খারাপ সময়েই তো বড় কিছুর সৃষ্ট হয়, খেলাহীন দুনিয়ার এ অবসরে খেলার সাংবাদিকেরা যদি পেশাদারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন, সেটা ভবিষ্যতের জন্যই ভালো হবে।
আপাতত করোনাবিহীন পৃথিবীর অপেক্ষাটাই আগে করি।