মাশরাফির মতো 'সৌভাগ্য' হয়নি অনেক অধিনায়কেরই
>ফুটবলে বাহুবন্ধনী পরে আর হাতে জাতীয় দলের রেপ্লিকা নিয়ে মাঠে নামা—অধিনায়কের কাজ এটিই। কিন্তু ক্রিকেটে ব্যাপারটা আলাদা। দলকে উদ্বুদ্ধ করা তো আছেই, গেমপ্ল্যানের পাশাপাশি সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় একজন অধিনায়ককে। বাংলাদেশের মতো দলে এ দায়িত্বটা বেড়ে যায় অনেকখানি। দলের খেলোয়াড়দের অভিভাবকত্বও তখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাশরাফি বিন মুর্তজা দেশের ক্রিকেটে ইতিহাস গড়েছেন তাঁর অনন্য নেতৃত্ব দিয়ে। আজ সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচটি দিয়েই সমাপ্তি ঘটবে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি-অধ্যায়ের। গতকাল সিলেটে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের অধিনায়কত্বের শেষ বলে দিয়েছেন তিনি। এক দিক দিয়ে তিনি ভাগ্যবানই। মাশরাফির মতো নিজের মুখে অধিনায়কত্বের শেষ টানার সৌভাগ্য বাংলাদেশের খুব কম অধিনায়কেরই হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রেখে আসুন দেখে নিই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়কদের বিদায়ের পূর্বাপর...
গাজী আশরাফ হোসেন
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক তিনি। ১৯৮৬ সালে এশিয়া কাপে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলেছিল বাংলাদেশ। সে দিক দিয়ে ইতিহাসে নাম পাকাপাকিভাবেই লেখা হয়ে গেছে গাজী আশরাফ হোসেনের নাম। ৮৬’র এশিয়া কাপের পর গাজী আশরাফের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘরের মাঠে ১৯৮৮ এশিয়া কাপে তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল। তাঁর অধীনে বাংলাদেশ সর্বশেষ একদিনের ম্যাচ খেলে ১৯৯০ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলেশিয়া কাপে। সেবার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত ফর্ম পড়ে যাওয়া ও ফিটনেসের সমস্যার কারণে ১৯৯০ সালে নেদারল্যান্ডসে আইসিসি ট্রফি খেলে আসার পর নিজে থেকেই জাতীয় দল থেকে অবসরে চলে যান দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম মেধাবী এ অধিনায়ক।
মিনহাজুল আবেদীন
গাজী আশরাফ হোসেন জাতীয় দল থেকে অবসর নিলে অধিনায়ক হিসেবে মিনহাজুল ছিলেন ‘অটোমেটিক চয়েজ।’ এর আগে ছিলেন জাতীয় দলের সহ অধিনায়ক। মিনহাজুল দেশকে প্রথম নেতৃত্ব দেন ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে। চণ্ডীগড়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তাঁর শুরু। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিনহাজুল মাত্র দুটি একদিনের ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শেষবার নেতৃত্ব দেন ১৯৯০ এশিয়া কাপেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলকাতার ম্যাচটিতে।
অধিনায়ক হিসেবে মিনহাজুল আসলেই দুর্ভাগা। ১৯৯২ সালে পরবর্তী এশিয়া কাপ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। ভারতীয় কোচ মহিন্দর অমরনাথের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে মিনহাজুল অধিনায়কত্ব হারান ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে। দলের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার পরেও আর কখনোই অধিনায়কত্ব ফেরত পাননি তিনি।
১৯৯৪ কেনিয়ায় আইসিসি ট্রফিতে দারুণ কিছুর হাতছানি ছিল বাংলাদেশের সামনে। শীর্ষ তিনে থাকতে পারলেই বিশ্বকাপ—এমন একটা সমীকরণ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ পারেনি। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে আইসিসি ট্রফির প্রস্তুতিপর্বে দ্বন্দ্ব শুরু হয় মহিন্দর ও মিনহাজুলের মধ্যে। ভারতের সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারের শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের সামনে টিকতে পারেননি মিনহাজুল। বোর্ডেরও কোনো সহায়তা পাননি। তাঁর জায়গায় অধিনায়ক করা হয় ফারুক আহমেদকে। যদিও অধিনায়ক হিসেবে ফারুকের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থ হয়ে আসার পরপরই।
আকরাম খান
১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থতার পর নতুন করে সবকিছু শুরুর তোড়জোড় চলছিল দেশের ক্রিকেটে। ফারুকের বিদায় হয়ে গেছে, বোর্ড খুঁজছিল নতুন এক অধিনায়ককে। সে বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় সার্ক ক্রিকেটে দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় আকরামে খানের হাতে। তাঁর অধীনেই শুরু হয় দেশের ক্রিকেটের স্বপ্নিল এক পথচলা। ১৯৯৭ সালে আকরামের নেতৃত্বেই মালয়েশিয়ার আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের হায়দরাবাদে কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথম ওয়ানডে জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ১৫ ওয়ানডেতে তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জয় ওই কেনিয়ার বিপক্ষে একটিই।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে গেমসে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হয় ভরাডুবি। আর তাতেই কোপ পড়ে আকরামের নেতৃত্বে। তাঁকে কেবল অধিনায়কত্ব থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়নি, দল থেকেও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
আমিনুল ইসলাম
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বের সময়ই ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমিনুলের, তিনি টেস্টে বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিতে পারেননি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আকরাম খান অধিনায়ক থাকা অবস্থাতেই আমিনুল ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে ভারতের ত্রিদেশীয় ট্রফিতে আকরামের চোটজনিত অনুপস্থিতিতে ভারতের বিপক্ষে দেশকে প্রথম নেতৃত্ব দেন তিনি।
আমিনুলের অধিনায়কত্ব চলে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে বলা হয় তাঁর ফর্মহীনতাকে। ফর্ম হারিয়ে ফেলার কারণেই বোর্ড তাঁর বিকল্প খুঁজছিল। ২০০০ সালের নভেম্বরে অভিষেক টেস্টের আগেই অধিনায়কত্ব হারান আমিনুল।
নাঈমুর রহমান
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক তিনি। আমিনুল ইসলামের বদলে ২০০০ সালের নভেম্বরে অভিষেক টেস্টের কিছুদিন আগেই তাঁকে অধিনায়ক করা হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি অপাঙেক্তয় হয়ে পড়েন। নিজের ফর্মহীনতা একটা বড় কারণ। বোলিং অ্যাকশন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু তাঁর বিদায়টা হয় খুব বাজে। রীতিমতো অপমানজনক। ২০০১ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বাংলাদেশ সফরের শেষ টেস্ট চলার সময় ওয়ানডে সিরিজের যে দল দেওয়া হয়, সেখান থেকে বাদ পড়েন তিনি। বলা বাহুল্য, অধিনায়কত্বও কেড়ে নেওয়া হয়।
খালেদ মাসুদ
অনেকটা হঠাৎ করেই ২০০১ সালের নভেম্বরে নাঈমুর রহমানের জায়গায় জাতীয় দলের অধিনায়ক করা হয় খালেদ মাসুদকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সে সময়টা সংগ্রামের। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দেশের ক্রিকেট তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। দল অনবরত হারছে। ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হলো ভরাডুবি। কানাডা ও কেনিয়ার কাছে হারতে হলো। বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর নিজে থেকেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন খালেদ মাসুদ। পরে অবশ্য নিয়মিত অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে ২০০৬ পর্যন্ত কয়েকটি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে অধিনায়কত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল, তিনি নেননি।
খালেদ মাহমুদ
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর খালেদ মাহমুদকে অধিনায়ক করা হয়। অধিনায়ক হিসেবে ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুলতান টেস্টটা প্রায় জিতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য। টেস্টটা জিততে পারলে মাহমুদের অধিনায়কত্বের গল্পটা অন্যরকম হলেও হতে পারত। তবে তিনি অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কারণেই। হঠাৎ করেই ব্যাটে খরা দেখা দিয়েছিল। বল হাতে কোনো উইকেট পাচ্ছিলেন না। ফলে বোর্ড বিকল্প ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। অধিনায়কত্ব হারিয়ে ২০০৪ সালের শুরুতে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেও অবসরের ঘোষণা দেন।
হাবিবুল বাশার
জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার আগে ক্লাব বা জাতীয় পর্যায়ে অধিনায়কত্বের খুব একটা অভিজ্ঞতা হাবিবুল বাশারের ছিল না। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের নতুন অধ্যায় তাঁর অধীনের রচিত। দেশের প্রথম টেস্ট জয়ী অধিনায়ক তিনি। ৬৯টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে জিতিয়েছেন ২৯টি ম্যাচে। ২০০৭ বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো প্রথম রাউন্ড পেরিয়ে পরের রাউন্ডে ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু তাঁর পারফরম্যান্স মোটেও ভালো হচ্ছিল না। বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন নিষ্প্রভ। অধিনায়কত্ব নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। বিশ্বকাপের পরপর ভারত সিরিজ খেলতে আসে। সেবার ওয়ানডেতে অধিনায়কত্ব করে সেটি ছেড়ে দেন। বোর্ড তাঁকে টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে বাদ দেয়।
মোহাম্মদ আশরাফুল
হাবিবুল বাশারের উত্তরসূরি আশরাফুল দেশকে ৮ ওয়ানডে জিতিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী ছিল। আশরাফুলের সময়ই ২০০৮ সালে দেশের ক্রিকেট সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় আইসিএল-ঝড়ে। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে আয়ারল্যান্ডের কাছে হারে বাংলাদেশ। সমালোচনার ঝড় ওঠে চারদিকে। আশরাফুলের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তো বটেই, শৃঙ্খলা নিয়েও কথা ওঠে। ম্যানেজারের তদন্ত প্রতিবেদন যায় তাঁর বিরুদ্ধে। এরপর আর অধিনায়কত্বে টিকে থাকতে পারেননি তিনি।
মুশফিকুর রহিম
ঘটনাবহুল ছিল মুশফিকুর রহিমের অধিনায়কত্ব। সফল টেস্ট অধিনায়ক তিনি। তাঁর অধীনের ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো শক্তিকে টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর অধীনে ২০১২ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো ফাইনালে খেলেছিল দল। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ রানে হেরে যেতে হয় দলকে। ২০১৩ সালের শেষ দিকে মুশফিকের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইও করেছিল বাংলাদেশ।
ব্যাট হাতে কখনোই অধিনায়কত্বের প্রভাব পড়েনি তাঁর পারফরম্যান্সে। কিন্তু ২০১৪ সালে এশিয়া কাপে দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক জড়িয়ে পড়া আর ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মুশফিকের অধিনায়কত্ব ঘিরে প্রশ্ন তুলে দেয়। এর আগে ২০১৩ সালেও জিম্বাবুয়ের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ হেরে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি হয়নি। ২০১৪ সালের শেষ দিকে তিনি ওয়ানডে অধিনায়কত্ব হারান। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়ক করা হয় মাশরাফি বিন মুর্তজাকে।
টেস্টে মুশফিক অধিনায়কত্ব করেছেন ২০১৭ সালের শেষ পর্যন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্যর্থতার পর তাঁকে টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে অবশ্য কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে রসায়নটা জমিয়ে তুলতে পারছিলেন না তিনি।
দ্রষ্টব্য: এ লেখায় নাম আসেনি কয়েকজন অধিনায়কের। শামীম কবির, শফিকুল হক, রকিবুল হাসান ও ফারুক আহমেদ কোনো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেননি। ২০১১ সালে সাকিব আল হাসান একবার অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে তিনি দেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্বে থাকায় (যদিও তিনি আইসিসির নির্দেশে নিষিদ্ধ আছেন) তাঁকে এ লেখায় আনা হয়নি। অনিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও রাজিন সালেহও আসেননি এ লেখায়।)