সৌদি নারী: স্প্যানিশ সাংবাদিকের চোখে
স্প্যানিশ সুপার কাপ এবার বেশ কিছু চমক উপহার দিচ্ছে। ঘরোয়া দুটি টুর্নামেন্টের বিজয়ীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া এক টুর্নামেন্টে বিস্ময়করভাবে এবার চার দল অংশ নিচ্ছে। আগের নিয়মে যে ফাইনাল হওয়ার কথা বার্সেলোনা ও ভ্যালেন্সিয়ার মধ্যে, সে ম্যাচে রবিবার খেলবে রিয়াল মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। অথচ মাদ্রিদের দুই দলই আগের বছরের নিয়মে এবার দর্শক হয়ে থাকত। আগে মৌসুম শুরু হতো সুপার কোপা দিয়ে। আর এবার মৌসুমের মাঝে এসে হচ্ছে আগের মৌসুমের সুপার কাপ। তবে সবচেয়ে বড় চমক খেলার ভেন্যুতে। স্পেনের ঘরোয়া সুপার কোপা হচ্ছে সৌদি আরবের জেদ্দাতে!
বার্সেলোনার ও রিয়াল মাদ্রিদের বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চাইছে সৌদি আরব। এ কারণে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করেছে তারা। তিন বছর নতুন সংস্করণের সুপার কাপ জেদ্দার কিং আবদুল্লাহ স্টেডিয়ামে আয়োজন করবে। এর বিনিময়ে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন ১২০ মিলিয়ন ইউরো পাবে! পৃথিবীর কোনো ফেডারেশনের পক্ষেই এত লোভনীয় প্রস্তাব ফেরানো সম্ভব নয়। আর এ সুবাদেই স্পেনের সাংবাদিকদের সুযোগ হয়েছে সৌদি আরবকে নতুন করে দেখার। দেশটির ধর্মীয় আইন কানুনের কথা চিন্তা করে রিয়াল বা বার্সেলোনার খুব কম সমর্থকই স্পেন থেকে এলেও সাংবাদিকেরা কিন্তু নতুন পটভূমিতে সুপার কোপা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
এমন একজন হলে কারমেন তোরেস। স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কার এই নারী ক্রীড়া সাংবাদিক সৌদি আরবকে দেখেছেন নিখুঁত পর্যটকের চোখ দিয়ে। ৯ জানুয়ারিতে মার্কায় প্রকাশিত তাঁর কলামটি এখানে তুলে দেওয়া হলো—
‘সৌদি আরব অনেক বদলেছে। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। প্রায় এক বছর ধরে এখানে একটি বিপ্লব ঘটছে। আপনি এখানে এসেছেন, এটাই একটি উদাহরণ। এবং এখন নারীরা পড়াশোনা করতে পারবে, কাজ করতে পারবে ...’ সৌদি আরবের অনেকেই আমাকে এটা বলেছেন। শুধু এদের সবাই পুরুষ; নারীরা কথা বলতে থামেন না। তারা কথা বলতে রাজি হননি। শুধু একজন মার্কার ভিডিও দলের মার্তা গার্সিয়া ও আমার সঙ্গে ছবি তুলতে রাজি হয়েছেন। তবে এটা সত্য, দেশটি আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে, বেশ ধীর গতিতে, কিন্তু আধুনিকীকরণের পথে যে হাঁটছে, এতে সন্দেহ নেই।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশকে পশ্চিমা বিশ্বের স্বাদ দিতে চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে আসা যুবরাজ সৌদি আরবে মুক্ত মানসিকতা ছড়াতে চাইছেন। এই তো গত এক বছরে এখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে। এশিয়ান এ দেশে আমার প্রথম ৩০ ঘণ্টায় হাজার হাজার গাড়ি দেখেছি। এর মাঝে মাত্র একটিতে চালকের আসনে নারী ছিল। কিন্তু আমি একজন তো অন্তত দেখেছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন, যদিও নারী ও পুরুষ আলাদা ক্লাস করেন। অনেকে আমাকে বলেছেন, ‘এমনকি মহিলা চিকিৎসকও রয়েছেন’, তবে আমি জানতে পেরেছি অনেক পুরুষ তাদের চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তারা (চিকিৎসক) আছেন।
এখন তারা (নারী) তাদের নামে সম্পত্তি রাখতে পারে। তবে তারা ভোট দিতে পারে না। তাদের এই অধিকার নেই বা কখনো তারা পাবে কি না সেটাও জানে না। আপাতত এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই। অনেকেই একা চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না বা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। গতকালই, আমি বিভিন্ন নারীকে ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, এবং যাদের সঙ্গে পুরুষ ছিল তাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন সবাই। এবং কাউকেই ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর মাঝে একজন এমন এক ছেলের কাছ থেকে অনুমতি চেয়েছিল যার বয়স ১০ বছরও না, সে ছেলেও মানা করে দিয়েছে। ছেলেটা নিশ্চয় তার ভাই ছিল । আমাকে বলা হয়েছে, ‘পরিবারের পুরুষ সিদ্ধান্ত নেবে; সে পিতা, স্বামী বা ভাই হতে পারে ...' এমনকি মেয়েরা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়ও পুরুষেরা সঙ্গে যায়।
স্প্যানিশ সুপার কাপ জেদ্দায় হচ্ছে। এটাই এ দেশের সবচেয়ে উন্মুক্ত শহর। এখানে প্রচুর বিদেশি আছে। সিরিয়া, পাকিস্তান ও জর্ডানের মানুষ আছে যারা আরও উন্মুক্ত মানসিকতার। মাঝে মাঝে আপনি পাশ্চাত্যের পোশাক পরিহিত মহিলা দেখবেন, বা কারও মুখ দেখবেন। দেশটির বাকি অংশ এর তুলনায় অনেক রক্ষণশীল। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে নিয়ম অনেক কড়া। জেদ্দাতেই আমি অনেক রেস্তোরাঁ দেখেছি, যেখানে পুরুষদের জন্য একটি সারি এবং মহিলাদের জন্য আরেকটি সারি। ব্যাংকগুলোতেও তাই। তারা যতটা পারে দুই লিঙ্গকে আলাদা রাখার চেষ্টা করে। যোগাযোগ যত, প্রলোভনও তত কম।
বিয়ে
সৌদি আরবে নারীরা তাদের স্বামী নির্বাচন করতে পারবেন না—এ সিদ্ধান্ত পরিবারের। এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই। অনেক পুরুষ চারটি পর্যন্ত স্ত্রী রাখতে পারে, তবে তাদের নিয়ম মেনে চলতে হয়। ধরুন, আপনার স্ত্রী যদি গর্ভবতী না হন তবে আপনি আরেকটি বিয়ে এবং পরিবার শুরু করার অনুমতি পাবেন না। তবে বিবাহিত হোক বা না হোক পর্যটকদের এখন সঙ্গীর সঙ্গে হোটেলগুলিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আগে এমন কিছুর শাস্তি ছিল কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া। দেশটি পর্যটনকে তাদের অর্থনীতির একটি বড় খাত বানাতে চাইছে।
ফুটবল
নারীরা এখন পুরুষদের পাশাপাশি স্টেডিয়ামে ম্যাচ দেখার অনুমতি পেয়েছেন। বুধবার রাতে অনেকেই রিয়াল মাদ্রিদ-ভ্যালেন্সিয়া ম্যাচে গ্যালারিতে ছিলেন। কয়েক মাস আগেও স্টেডিয়ামের একটি নির্দিষ্ট অংশে বসতে হতো তাদের। , তাদের কেবল একটি পৃথক বিভাগে বসতে দেওয়া হয়েছিল। নারী ক্রীড়া সাংবাদিকের সংখ্যা শূন্যের কোটায়।
বিদেশি
আমাকে এখন পর্যন্ত যে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে, সেটা ভালোই। আমি নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করি, কিন্তু মাঝে মাঝে ছোট ভুল এড়ানো যায় না। যেমন একটি ফোনের দোকানে যখন স্বাক্ষরের জন্য কলম নিচ্ছিলাম তখন দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে হাত স্পর্শ হয়েছে। এতে তার অস্বস্তি এবং লজ্জা টের পেয়েছি আমি। রাস্তায় এক চালক আমাকে থামিয়ে ছবি তুলতে চাওয়ায় তাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমাকে থামিয়ে নিচু হয়ে আমার কাছে ছবি তোলার অনুমতি চেয়েছিল সে। আমি হ্যাঁ বলার পর ছবি তুলে হাসি মুখে নিজের পথে চলে গেছেন। তবে এটা ঠিক, সৌদি আরব উন্মুক্ত হওয়ার পথে আছে। কিন্তু অনেক সময় লাগবে।