বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেরা দশ

>আর মাত্র কটা দিন। এরপরই শেষ হয়ে যাচ্ছে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক। ২০১০ থেকে সর্বশেষ এক দশকে কত কিছুই না ঘটেছে ক্রীড়াবিশ্বে। কত উত্থান-পতন, কত অঘটন, কত রূপকথার গল্প লেখা হয়েছে খেলার মাঠে, ট্র্যাকে কিংবা পুলে। গত এক দশকের সেই সব আলোচিত ঘটনা নিয়েই প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজন। আজ মোহাম্মদ সোলায়মান তুলে এনেছেন গত এক দশকের বাংলাদেশের ক্রিকেটের আলোচিত দশ ঘটনাকে।
২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ফাইল ছবি
২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইয়ের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ফাইল ছবি

বাংলাওয়াশ
২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটা শুরু হয়েছিল দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করে। অ্যাঙ্কেলের চোটে প্রথম ম্যাচে মাত্র এক ওভার বোলিং করেই বেরিয়ে গেলেন নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। এরপর সিরিজের পুরো গল্পটাই নিউজিল্যান্ডের হেনস্তা হওয়ার। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে বাংলাদেশ সিরিজটা জিতল ৪-০ তে। বড় কোনো ক্রিকেট শক্তিকে সেই প্রথম ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ। তাতেই জন্ম হলো ‘বাংলাওয়াশ’ নামের মধুর শব্দটির। তিন বছর পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসে আবারও ওয়ানডে সিরিজে বাংলাওয়াশ নিউজিল্যান্ড।

২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফাইল ছবি।
২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফাইল ছবি।

বিশ্বকাপে স্বাগতিক বাংলাদেশ
ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজন করে বাংলাদেশ। আলো ঝলমলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা হয়েছিল বাংলাদেশেই, ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। উদ্বোধনী ম্যাচটি হয় বাংলাদেশেই, মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল অন্যতম স্বাগতিক ভারত। গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডসহ তিনটি দলকে হারালেও কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। সব ছাপিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৮ ও ৭৮ রানের লজ্জা দুটিই মনে রেখেছে সবাই। এরপর ২০১৪ সালে পুরুষ ও নারী, দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই এককভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ।

কাঁদছেন সাকিব, ২০১২ এশিয়া কাপে হারের পর। ফাইল ছবি
কাঁদছেন সাকিব, ২০১২ এশিয়া কাপে হারের পর। ফাইল ছবি

এশিয়া কাপে ২ রানের আক্ষেপ
মুশফিকুর রহিমের কাঁধে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অমর হয়ে গেছে ছবিটা। সাকিবরা তো কাঁদবেনই। মিরপুরে এশিয়া কাপের ফাইনালে তীরে এসে তরী ডুবেছিল বাংলাদেশের। পাকিস্তানের দেওয়া ২৩৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২ রানে হারে বাংলাদেশ। শেষ ওভারে ৯ রান দরকার ছিল, মাহমুদউল্লাহ-রাজ্জাকরা আইজাজ চিমার প্রথম চার বলে নিতে পারলেন ৫ রান। পঞ্চম বলে আউট রাজ্জাক। শেষ বলে ৪ রানের সমীকরণে দাঁড়িয়ে পড়িমরি দৌড়ে শাহাদাত নিতে পারলেন ১ রান। ওই আক্ষেপ এখনো ঘোচেনি বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিম। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিম। ফাইল ছবি

টেস্টে প্রথম ‘২০০’
২০১৩ সালের ১১ মার্চ। বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের দিনটা শুরু হয়েছিল টেলিভিশনের সামনে বসে। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হতে ‘মাত্র’ ১১ রানই যে দরকার ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের। ভক্তদের অপেক্ষার প্রহর ঘুচেছিল সেদিন। তবে আশরাফুলে ব্যাট থেকে নয়, বাংলাদেশকে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা আসে ১৫২ রান নিয়ে দিন শুরু করা মুশফিকুর রহিমের ব্যাট থেকে। আশরাফুল আউট হয়ে গিয়েছিলেন ১৯০ রানে। মুশফিক করেন ঠিক ২০০। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা পরে আরও তিনবার ডাবল সেঞ্চুরি পেয়েছেন টেস্টে।

স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনা স্বীকারের পর আশরাফুল। ফাইল ছবি
স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনা স্বীকারের পর আশরাফুল। ফাইল ছবি

কলঙ্কিত আশরাফুল
মাস দু-এক আগে ডাবলে সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের ‘প্রথম’ হতে পারতেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সেটি হয়নি। তবে ২০১৩ সালের মে মাসেই আবার ‘প্রথম’ হয়ে গেলেন টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি পাওয়া ব্যাটসম্যান। ওই মাসেই যে ২০১৩ বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে খেলা আশরাফুল। ফল, তিন বছরে স্থগিতসহ মোট আট বছরের নিষেধাজ্ঞা। পরে শাস্তিটা কমে হয় দুই বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ পাঁচ বছর।

বিশ্ব কাঁপিয়ে আবির্ভাব মোস্তাফিজুর রহমানের। ফাইল ছবি
বিশ্ব কাঁপিয়ে আবির্ভাব মোস্তাফিজুর রহমানের। ফাইল ছবি

২০১৫—বাংলাদেশের বছর, মোস্তাফিজেরও
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে বড় দল হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ আটে ভারতের কাছে ‘বিতর্কিত’ ম্যাচে হেরে যায় মাশরাফিরা। এপ্রিলে দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই। এরপর জুনে এল ভারত। দুনিয়া কাঁপিয়ে দৃশ্যপটে এলেন মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথম ম্যাচে ৫ উইকেটের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট। ফল, প্রথম দুই ম্যাচ শেষেই নিশ্চিত ওয়ানডে সিরিজ জয়। জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাও বাংলাদেশে এসে সিরিজ হারল ২-১ ব্যবধানে। ওই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালেও ওঠে বাংলাদেশ।

তিন সংস্করণেই একমাত্র এক নম্বর সাকিব আল হাসান। ফাইল ছবি
তিন সংস্করণেই একমাত্র এক নম্বর সাকিব আল হাসান। ফাইল ছবি

নাম্বার ওয়ান সাকিব
কোন সংস্করণের এক নম্বর অলরাউন্ডার? ২০১৫ সালে এই প্রশ্নটা করতে দেননি সাকিব আল হাসান। ২০১৪ সালের নভেম্বরে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক টেস্টেই সেঞ্চুরির পর ১০ উইকেট নেওয়ান বিরল কীর্তিতে নাম লেখানো সাকিব বছর ঘুরতেই টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—এই তিন সংস্করণের অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হয়ে যান। প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়ার কীর্তি সাকিবেরই।

মেয়েদের এশিয়া কাপ জিতল বাংলাদেশ নারী দল। ফাইল ছবি
মেয়েদের এশিয়া কাপ জিতল বাংলাদেশ নারী দল। ফাইল ছবি

লেডিস ফার্স্ট—মেয়েদের এশিয়া কাপ জয়
‘লেডিস ফার্স্ট’ এই ইংরেজি শব্দযুগল ব্যবহার না করে উপায় নেই। বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেট দল তখনো হাতে ওঠাতে পারেনি কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক ট্রফি, সেখানে ২০১৮ সালে সালমারা জিতে গেলেন কিনা এশিয়া কাপ। জুনে মালয়েশিয়ায় এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে সবাইকে অবাক করেই চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েদের দল। ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে ১১২ রানে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার ফাইনালটা বাংলাদেশ জেতে শেষ বলে ৩ উইকেট হাতে রেখে। শেষ ওভারে ২ উইকেট হারালেও ৯ রানের সমীকরণটা মেলাতে পারে সালমারা।

হ্যাগলি ওভালে ফিরছেন আতঙ্কিত ক্রিকেটাররা। ফাইল ছবি
হ্যাগলি ওভালে ফিরছেন আতঙ্কিত ক্রিকেটাররা। ফাইল ছবি

ক্রাইস্টচার্চ দুঃস্বপ্ন
ভাগ্যিস অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনটা একটু লম্বা হয়েছিল। নইলে কী হতে পারত ভাবলেই গাঁ শিউরে ওঠে। হ্যাগলি ওভালে অনুশীলন ও সংবাদ সম্মেলন শেষে পাশের মসজিদ আল নূরে জুমার নামাজ আদায় করতে যান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কিন্তু বাস মসজিদের সামনে যাওয়ার আগেই আটকে দেওয়া হয়। একটু আগেই যে সেখানে ঘটে গেছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। হতবিহ্বল বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ফিরে আসেন মাঠে। বাতিল হয়ে যায় ক্রাইস্টচার্চের তৃতীয় টেস্টটাও।

বিমর্ষ নিষিদ্ধ সাকিব। ফাইল ছবি
বিমর্ষ নিষিদ্ধ সাকিব। ফাইল ছবি

নিষিদ্ধ সাকিব
২০১৯ বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক বিশ্বকাপে ৫০০ এর বেশি রান ও ১০ উইকেট পেয়েছিলেন বাংলাদেশের অলরাউন্ডার। বছর শেষে সেই সাকিবই কিনা নিষিদ্ধ হলেন ক্রিকেট থেকে। অক্টোবরে দাবি-দাওয়া নিয়ে ক্রিকেটারদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাকিব বাজিকরদের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাকে না জানানোর শাস্তি পেলেন। এক বছরের স্থগিতসহ মোট দুই বছর নিষিদ্ধ হয়েছেন অভিযোগ মেনে নেওয়া সাকিব।