ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে কেমন ব্যাটিং দরকার তামিম-সাকিবদের?
টন্টনের পেসবান্ধব উইকেটে কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ক্যারিবীয় পেসারদের গতি আর বাউন্সের বিপক্ষে কেমন ব্যাটিং করতে হবে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলকে?
বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে নিজেদের মোট ৯ ম্যাচকে তিন পর্বে ভাগ করেছিল বাংলাদেশ। প্রথমপর্ব খারাপ কাটেনি বাংলাদেশের। তিন ম্যাচে অন্তত একটি জয়ের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় সেমিফাইনালে ওঠার কঠিন সমীকরণে পরেছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। বাকি পাঁচ ম্যাচে অন্তত চারটিতে জিতলে সম্ভবত অন্য কোনো দলের ফলে তাকিয়ে থাকতে হবে না বাংলাদেশকে। সেই পথে কাল প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলটা যেমন হেসেখেলে চার শ তুলতে পারে তেমনি ওই রান তাড়া করার সামর্থ্যও আছে। এমন দলের বিপক্ষে ঠিক কোন মেজাজে ব্যাটিং করতে করতে হবে বাংলাদেশকে?
চুরমার ব্যাটিং—ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ে তাকালে এমনটি মনে হতেই পারে। মানে যত বেশি সম্ভব রান তোলা যায় আরকি। সে জন্য দুর্বার শুরু করে শেষটা হতে হবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু এটা ক্রিকেট, যেখানে ‘মোমেন্টাম’ (ভালো খেলার ছন্দ) ধরে রাখা এমনিতেই কঠিন। আর বাংলাদেশের মতো দলের জন্য তো বটেই। উড়ন্ত শুরুর পর আশ্চর্য পতন যেমন নতুন কিছু না তেমনি মড়ক লাগানো শুরুর পর সাদামাটা সংগ্রহে শেষ করাও পুরোনো অভ্যাস। সেমিফাইনালে ওঠার আশা টিকিয়ে রাখতে হলে কাল থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এমন কিছু করার কোনো সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত মাঠে গড়ানো তিন ম্যাচে তেমন কিছু না ঘটলেও একটা কথা তো সত্যি, বাংলাদেশ প্রত্যাশামতো ব্যাট করতে পারেনি?
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৩০ রান যা একটু সুখস্মৃতির। তবে ওই ম্যাচেও সাড়ে তিন শ-র বেশি করার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। পরের দুটি ম্যাচে ব্যর্থতাই বেশি করে চোখে পড়েছে। বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং খেয়াল করে থাকলে কিছু ব্যাপার নজর কাড়বেই। ওপেনিং জুটি ভালো শুরু করলে দল ভালো সংগ্রহ পায়। কিংবা টপ অর্ডারে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের মধ্যে কেউ অন্তত ৩৫-৪০ ওভার পর্যন্ত খেলে দিয়ে আসলে শেষ ১০ ওভারে উইকেট পুঁজি করে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের চেষ্টা চলে। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলে শেষ ১০ ওভারে তেমন একটা রান ওঠে না। যেহেতু দলে নেই স্বীকৃত কোনো ‘বিগ হিটার’; প্রথাগত ব্যাটসম্যান দিয়েই কাজটা চালাতে হচ্ছে। টন্টনের পেসবান্ধব উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাই ভালো শুরুর বিকল্প নেই।
ওপেনিংয়ে ভালো শুরু বাংলাদেশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ বিশ্বকাপের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজ। প্রতি ম্যাচেই রান তাড়া করে জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সে চার ম্যাচে দলের ওপেনিং জুটিতে সংগ্রহ ছিল—১৪৪, ৫৪, ১১৭ ও ৫৯। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররাও তামিম ইকবাল-সৌম্য সরকারদের কাছে অচেনা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলটার সঙ্গে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলের মিল সামান্যই। তবে শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, শেলডন কটরেল, জেসন হোল্ডাররা কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজে খেলেছেন। তাঁদের গতির হলকায় বাড়তি ফলা ওশানে টমাস। প্রায় সব পেসারই ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের ওপরে বল করতে পারেন। সুইং করানোর প্রতি ক্যারিবীয়দের তেমন একটা ইয়ে না থাকলেও গতি আর বাউন্সই তাঁদের প্রধান অস্ত্র।
গতি আর বাউন্স? বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য চিরকালীন বিভীষিকা। যদিও আগের (২০০৫-০৯ মেয়াদে ২৬.০৩) তুলনায় গত চার বছরে পেসারদের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় বেড়েছে (৩৩.১৪)। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পেস-বাউন্সের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কথা ভাবলে নিউজিল্যান্ডে নিল ওয়াগনারের সেই ভয়ংকর স্পেল মনে পড়বেই। অত পেছনে যাওয়ার কী দরকার, এ বিশ্বকাপে পেস-বাউন্সের বিপক্ষে তামিমকেই ঠিক স্বচ্ছন্দ মনে হচ্ছে না। অথচ, গত চার বছরে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান করা এই ওপেনার পা তুলে ক্যারিবিয়ান পুলের জন্য আলাদা করে পরিচিত ক্রিকেটবিশ্বে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অফ স্টাম্পের বাইরে একটু শর্ট লেংথের বল জোর করে খেলতে গিয়ে পেছনে ক্যাচ দিয়েছিলেন তামিম। পরের ম্যাচে লকি ফার্গুসনের ঘণ্টায় প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার গতির বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন। আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ ম্যাচে জড়তা কাটাতে পেসারকে ডাউন দ্য উইকেট এসে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলেছেন এক্সট্রা কভারে। এ তিন ইনিংসে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, তামিমকে যেমন স্বচ্ছন্দ মনে হয়নি তেমনি স্ট্রাইকরেটও সন্তোষজনক ছিল না। অপর প্রান্তে তাঁর সঙ্গী সৌম্য সরকারকে দেখে মনে হয়েছে, বেশি ইতিবাচক থাকার মাশুল গুনছেন।
প্রতিপক্ষ যেহেতু ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই একটা কথা বলা যায়, ত্রিদেশীয় সিরিজের সুবাদে দলটির পেসাররা ঠিক কোন লেংথে বাউন্সার মারতে পারেন ওপেনারদের তা জানা। আর আয়ারল্যান্ডে বাউন্সার কিন্তু দুর্দান্তভাবে সামলেছেন তারা। পুল-হুক করে একাকার করেছেন দুজন। তাহলে বিশ্বকাপে এসে হচ্ছে না কেন? ক্রিকেটের কৌশলগত দিকগুলো নিয়ে ভাবলে বলা যায়, এটি আসলে মানসিকতা। সাধারণত, যখন হেলমেট ছিল না তখন পেসাররা বাউন্সার মারলে পুল-হুক করা হতো সতর্কবার্তা হিসেবে—আর বাউন্সার মেরো না, মারলে সীমানার বাইরে পাঠাব। হেলমেট আসার পর ব্যাটসম্যানদের নিরাপত্তা বাড়লেও পুল-হুকের ক্ষেত্রে অনেকে ভেবে নেন, হেলমেট তো আছেই ‘ডাক’ করলেই হয়—পুল করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসব কেন?
দুটো ভাবনাই ঠিক। তবে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ভালো শুরু করতে চাইলে আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দিতে হবে। অর্থাৎ পুল-হুক খেলতে হবে। এ নিয়ে তামিমের জড়তার ব্যাখ্যা দিলেন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে স্বনামধন্য কোচ ও সাকিব আল হাসানের ‘গুরু’ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, ‘বিশ্বকাপকে আর দশটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের মতোই দেখা উচিত তামিমের। মাথা ফাঁকা রেখে ব্যাটিংয়ে নামলে ফল হতে পারে। সে একটু চাপ নিয়ে ফেলছে। বেশি রক্ষণাত্মক থাকলে খেলাটা কঠিন হয়ে যায়। আর সেখান থেকে দ্রুত বের হওয়াও কঠিন। পায়ের মুভমেন্ট বাড়িয়ে তামিমকে আরেকটু আক্রমণাত্মক হতে হবে।’
সৌম্যর খেলার ধরন নিয়েও কথা বলেছেন সালাউদ্দিন। সাধারণত পাওয়ার প্লে-তে ফিল্ডার ভেতরে থাকার সুযোগ নিয়ে সৌম্য একটু তুলে খেলেন। যেহেতু তাঁর টাইমিং খুব ভালো শটগুলোয় তেমন একটা বিপদ হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো পাওয়ার প্লে শেষেও সৌম্য এক ধরনের শট খেলার লোভ সামলাতে পারেন না। তখন বল একটু পুরোনো হওয়ায় তা সীমানাছাড়া করতে ভালো টাইমিংয়ের সঙ্গে শক্তিও লাগে। পাওয়ার প্লে শেষে সীমানায় বেশিসংখ্যক ফিল্ডার থাকায় সেটি হচ্ছে না। সালাউদ্দিন মনে করেন, সৌম্যর ব্যাটিংয়ের ধারাটা একটু পাল্টালে ভালো হয়। শুরুর পাওয়ার প্লেতে সে তাঁর নিজস্ব ঢংয়েই খেলুক কিন্তু প্রথম ১০ ওভার শেষ করতে পারলে ‘ইনিংস বড় করুক। ফিল্ডার দেখে ব্যাট করতে হবে।’
ইংলিশ উইকেটে ‘ট্রু বাউন্স’ পাওয়া যায়—মানে সাধারণত বল যতটুকু ওঠার কথা ততটুকু উঠবে। সে ক্ষেত্রে বাউন্সার সামলানোর কিছু ধরন আছে। মাথা ধেয়ে কিংবা তার ওপরের বাউন্সারের তুলনায় বুক সমান উচ্চতার বাউন্সার পুল-হুক করে সীমানার বাইরে পাঠানো তুলনামূলক সহজ। কারণ বুক সমান উচ্চতার বলে শেষ পর্যন্ত চোখ রাখা সহজ কিন্তু মাথা সমান উচ্চতার বাউন্সারে তা অনেক কঠিন। পুল-হুকের ক্ষেত্রে তাই ‘কোনটা মারব কোনটা মারব না’—এ নিয়ে সালাউদ্দিন একটু সাবধানও থাকতে বললেন, ‘ইংল্যান্ডে মাথা ধেয়ে আসা বলে পুল করা বেশ কঠিন। মাথার ওপরের বল মারতে গিয়ে আউট হওয়ার প্রবণতা আছে। তাই বুকের বলগুলো খেলাই ভালো।’
মিডলঅর্ডারে মুশফিকুর রহিম হাতে চোট পেলেও তাঁর ব্যাটিংয়ে কোনো সমস্যা দেখছেন না সালাউদ্দিন। তবে এখানে বাকিদেরও ভূমিকা রাখার সময় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের যেহেতু বিগ হিটার নেই তাই শেষ ১০ ওভারে প্রথাগত কৌশল অবলম্বন করাই ভালো বলে মনে করছেন এ কোচ, ‘উইকেট যতটা সম্ভব হাতে রেখে শেষ ১০ ওভারের ব্যাটিং করতে হবে।’ এ দিকটা মেলাতে হলে টপ অর্ডারে যে কাউকে অন্তত ৪০ ওভার পর্যন্ত ব্যাট করতেই হবে। শুধু এক সাকিব আল হাসানের ওপর ভরসা করলে চলবে না। দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও ‘ল অব অ্যাভারেজ’ বলছে কাল উইকেটে সাদামাটা দিন কাটার কথা সাকিবের। তবে এর উল্টোটা ঘটলে তো পোয়াবারো। কিন্তু ওপেনিং জুটির যে কেউ কিংবা চারে নামা মুশফিক অন্তত ৪০ ওভার পর্যন্ত থাকলে সাকিবের ওপর চাপটা কমবে।
লোয়ার অর্ডার নিয়ে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা মাহমুদউল্লাহর জন্য নতুন কিছু না। হাতে উইকেট থাকলে শেষ ১০ ওভারে রানের গতি বাড়াতে মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যানের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে মাহমুদউল্লাহকে। নিতে হবে বিগ হিটারের ভূমিকা। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের স্কোয়াড দেখলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া দলের বাকি কিন্তু ব্যাট করতে পারেন। তাহলে রানের গতি বাড়াতে শুধু মাহমুদউল্লাহর ওপর চাপ দেওয়া কেন?
মোসাদ্দেক হোসেন ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছেন। মেহেদী হাসান মিরাজ একপ্রান্ত আগলে রাখতে পারলেও সাইফউদ্দিন কিন্তু হাত খুলে খেলতে পারেন। আর মাশরাফি? আগের দিনগুলোয় এই মাশরাফির ‘ক্যামিও’ ইনিংসগুলোয় ভর করেই কিন্তু লড়াকু সংগ্রহ পেয়ে যেত বাংলাদেশ। সেমিতে উঠতে হলে ব্যাট হাতে তাঁদের ভূমিকা রাখার সময়ও কিন্তু এসেছে।