চাইলে সবকিছুরই একটা ভালো দিক খুঁজে নেওয়া যায়। হ্যামিল্টন টেস্ট চার দিনেই শেষ হয়ে যাওয়াতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটা বাড়তি দিন পাওয়া যেমন। তা না হয় পাওয়া গেল, কিন্তু যাব কোথায়?
হ্যামিল্টন শহরটা তো মোটামুটি দেখাই। কাছাকাছি শহরগুলোর মধ্যে রটোরোয়ার খুব নাম শুনেছি। যেখানে লেকের পানি টগবগ করে ফোটে। প্রাকৃতিক স্টিম বাথ নেওয়া যায়। তাওরাঙ্গাও নাকি খুব সুন্দর। এতবার নিউজিল্যান্ড এসেছি, অনেকবার প্ল্যান করেও কখনো যাওয়া হয়নি। যাব নাকি? চিন্তাটা দ্রুতই মাথা থেকে বের করে দিলাম। দুটি শহরের দূরত্বই ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। এত দূরে যাওয়া-আসার ধকল নেওয়া সম্ভব নয়। কালই আবার ওয়েলিংটনে দৌড়াতে হবে। একটু বিশ্রামও তো চাই। হঠাৎই মনে হলো, কেমব্রিজ ঘুরে এলে কেমন হয়! নিউজিল্যান্ডে কেমব্রিজ কোত্থেকে আসবে? আছে ভাই, এখানেও কেমব্রিজ আছে। একদা ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল বলে ইংল্যান্ডের অনেক শহরেরই ‘মিতা’ আছে এই দেশে।
এই কেমব্রিজকে হ্যামিল্টনের শহরতলিই বলা যায়। দূরত্ব মাত্র ২৪ কিলোমিটার। এটাকে আবার ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরের কোনো জায়গার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলবেন না যেন। ঢাকার ১ কিলোমিটার সমান এখানকার ১০ কিলোমিটার, হয়তো তারও বেশি। বোঝেননি কথাটা? ট্রাফিক জ্যাম বলতে যে কিছু নেই এখানে। হ্যামিল্টন থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরত্ব মানে গাড়িতে মিনিট পনেরোর ব্যাপার। ঘুরে বেড়ানোর শখ তো একটু ছিলই, সঙ্গে ডায়েরির রসদ খোঁজার তাড়নাও। এই দুটির যোগফল আজ বিকেলে কেমব্রিজ ঘুরে আসা। রথ দেখতে গিয়ে কলা বেচার মতো দেখা হয়ে গেল আরও অনেক কিছুই। এর মধ্যে কারাপিরো লেকটা দেখে মনে হলো, এটা না দেখলে বড় একটা আফসোসই থেকে যেত।
রাস্তা এত সুন্দর, দুপাশের দৃশ্যও—ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি করে ফুসফুসের সঙ্গে মনেও যেন খানিকটা তাজা অক্সিজেনের পরশ নিয়ে এলাম। ট্যাক্সিতে গেলে নিশ্চয়ই এমন যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হতো না। যেটি সম্ভব হলো তেরো বছর ধরে হ্যামিল্টন প্রবাসী মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের কল্যাণে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে এখন মাদক নিরোধক একটি সংস্থায় কাজ করেন। এ জন্য অবশ্য এখানে আসার পর স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে পড়াশোনা করতে হয়েছে। সেই জাহিদুলের গাড়িতেই আজ বিকেলের আনন্দ ভ্রমণ। ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া শিশিরবিন্দু’ না দেখার প্রবাদটা অবশ্য জাহিদুলের ক্ষেত্রে খেটে যাচ্ছে। এত কাছের কেমব্রিজে কখনো যাওয়াই হয়নি তাঁর! আমার কেমব্রিজে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী আছে ওখানে?’ আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, ‘অনেক গাছ আছে। এত গাছ যে, কেমব্রিজকে বলা হয় “সিটি অব ট্রিজ”।’
এটা আমি কীভাবে জানলাম, এর পেছনে একটা গল্প আছে। হ্যামিল্টনের সেডন পার্কের পেছনেই খোলা একটা মাঠ। বসার জন্য দুটি বেঞ্চও। তারই একটিতে লাগানো ফলক থেকে জেনেছি, এই খোলা প্রান্তরের নাম ‘ক্যাসিস গার্ডেন’। সাইমন ক্যাসি নামে কেউ এটি বানাতে সাহায্য করেছেন বলে তাঁর নামে নামকরণ। টেস্টের দ্বিতীয় দিন ছোট্ট খোপের মতো প্রেসবক্সে দমবন্ধ লাগছিল বলে চা বিরতির সময় হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসেছি। পাশে আগে থেকেই বসে আছেন এক তরুণ। পরিচয় হলো। কিছুক্ষণ গল্পও। টমি অ্যান্ডারসন নামের ওই তরুণ পেশায় ট্রেন ড্রাইভার। আমি আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। ট্রেন ড্রাইভারদের নিয়ে কেন যেন আমার সব সময়ই বাড়তি একটা কৌতূহল কাজ করে। এরা যেন অদৃশ্য কোনো মানব (মানবীও হতে পারেন)। একবার ভেবে দেখুন তো, জীবনে কজন ট্রেন ড্রাইভারের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না। কজনকে ‘আপনার/তোমার বাবা কী করেন’ প্রশ্ন করে ‘ট্রেন ড্রাইভার’ জবাব পেয়েছেন।
টমি অ্যান্ডারসন অবশ্য নিশ্চিত নন, আর কত দিন ট্রেন চালাবেন। বয়স এখনো ত্রিশও হয়নি, এরই মধ্যে নয়বার পেশা বদল করা হয়ে গেছে তাঁর। সব এখন মনে পড়ছে না। যেগুলো পড়ছে, সেগুলো বলি—অ্যান্ডারসন কৃষি খামারে কাজ করেছেন, ডেইরি ফার্মেও, লরি চালিয়েছেন, ট্রাক্টর চালিয়েছেন, রাস্তা তৈরির কাজ করেছেন, এমনকি জীবিকার জন্য কয়লার খনিতে নামার অভিজ্ঞতাও হয়ে আছে তাঁর। একটাই জীবন, একই কাজ করে সেটি একঘেয়ে করে তোলার কোনো অর্থ হয় না—এই হলো অ্যান্ডারসনের জীবন দর্শন। আমি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিকতাই করে যাচ্ছি শুনে তাঁর তাই বিস্মিত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। একটু করুণার চোখেও তাকালেন বলে মনে হলো। সাংবাদিকতা আমি এখনো সেই প্রথম দিনের মতোই উপভোগ করি। তারপরও অ্যান্ডারসনের ওই দৃষ্টিতে একটু ‘অপরাধী’ বোধ করলাম, এত দিন ধরে একই কাজ করাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি!
এই টমি অ্যান্ডারসনই আমাকে কেমব্রিজের খোঁজ দিয়েছিলেন। হ্যামিল্টনের আশপাশে কোথায় যাওয়া যায় জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন, ‘কেমব্রিজ ঘুরে আসতে পারেন। মাত্র ১০–১৫ মিনিটের ড্রাইভ। ভালো লাগবে।’
ভালো তো লাগলই। ছোট্ট ছিমছাম একটা শহর। নামের সার্থকতা প্রমাণ করে গাছও প্রচুর। শহরের ঠিক মাঝখানের গোলচক্করটা রংবেরঙের ফুলে অপূর্ব এক ছবি হয়ে আছে। আশপাশে আর কী দেখার আছে, ইন্টারনেটে তা খুঁজতে গিয়ে ট্রি চার্চ আর স্কাল্পচার পার্ক নামে দুটি জায়গা পছন্দ হলো। ট্রি চার্চ নামটাই বলে দিচ্ছে এর পরিচয়। সুন্দর একটা বিশাল বাগানে গাছ আর গাছ। গাছ দিয়ে চার্চ মানে গির্জা বানানো হয়েছে সেখানে। স্কাল্পচার পার্কও বাগান, বাড়তি বলতে কিছু ভাস্কর্য। এভাবে বর্ণনা দিচ্ছি ঠিকই, এর কিছুই কিন্তু স্বচক্ষে দেখিনি। তাহলে জানলাম কীভাবে? জয় ইন্টারনেট!
দুই জায়গাতেই গিয়ে দেখি, মোটামুটি অভিন্ন সাইনবোর্ড টানানো। ‘এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি’—কথাটা দুটিতেই কমন। ট্রি চার্চে শুধু রোববারই ঢোকা যায়। স্কাল্পচার পার্কের নিয়ম আরও কঠোর। ই-মেইলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এলে তবেই ভেতরে প্রবেশের সুযোগ মেলে। টি চার্চে বদ্ধ ফটকের ওপাশে এক ভদ্রলোককে পেয়ে ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছি’ বলে অনুনয়-বিনয় করেও কোনো লাভ হলো না। প্রত্যাখ্যানে অবশ্য কোনো রূঢ়তা নেই, অমায়িক ভঙ্গিতেই বললেন, ‘এটির মালিক যখন-তখন লোকজনের প্রবেশ নিয়ে খুব স্পর্শকাতর। এই সন্ধ্যাবেলা আপনাদের ঢুকতে দিলে আমাকে মেরে ফেলবে। আপনারা কাল সকাল ১০টার দিকে আসুন, দেখি কী করা যায়।’
ট্রি চার্চ আর স্কাল্পচার পার্ক থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ফেরার আগেই জাহিদুল কারাপিরো লেকটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে হয়। আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। লেক অনেক দেখেছি, নতুন কী আর হবে! গিয়ে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেলাম। টলটল করছে শান্ত নীলাভ জল, পাশে সবুজ গাছের সারি, কোথাও বা ছোট্ট পাহাড়মতোও। বাংলাদেশের কাপ্তাই লেকের মতো এই কারাপিরো লেকও মনুষ্যসৃষ্ট। জন্মের ইতিহাসও একই। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ দেওয়া।
কারাপিরো লেকে রোয়িংয়ের মেলা বসেছে দেখে বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল, আরে, এটা তো রোয়িংয়ের জন্য সেই বিখ্যাত লেক। ১৯৭৮ ও ২০১০ সালে দুবার বিশ্ব রোয়িং চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে এখানে। দ্বিতীয়বার সেই ঘোষণা দেওয়ার সময় আন্তর্জাতিক রোয়িং ফেডারেশন ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর লেকের একটি’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল এটিকে। রোয়িংয়ে নিউজিল্যান্ড খুব ভালো। অলিম্পিকে সোনার পদক বাঁধাই থাকে। নিউজিল্যান্ড রোয়িং ফেডারেশনের হাই পারফরম্যান্স সেন্টারও এই লেকের ধারেই। সাইক্লিং, ক্যানোয়িং, ট্রায়াথলন এসব খেলার জাতীয় ফেডারেশনও এই কেমব্রিজেই। কেমব্রিজের আরেক নাম ‘সিটি অব ট্রিজ ’ বলেছিলাম। সেটি অসম্পূর্ণ ছিল। পুরো নামটা আসলে ‘সিটি অব ট্রিজ অ্যান্ড চ্যাম্পিয়নস।’ এই শহর থেকে যে চ্যাম্পিয়ন উৎপন্ন হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে আট বর্গ কিলোমিটারের এই কারাপিরো লেক থেকে।
রোয়িংয়ের ঢেউয়ে মৃদু দুলতে থাকা লেকের নীলাভ জলের দিকে তাকিয়ে আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘হে চ্যাম্পিয়নপ্রসবা লেক, অলিম্পিক পদক কী, তুমি কি তা জানো?’
জাহিদুল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একা একা কী বলছেন?’
আমি হেসে বললাম, ‘কিছু না’।