মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে আমার একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। সেটি যে ব্যাটিং-বোলিংয়ে নয়, তা বোধ হয় বলার দরকার নেই। তাহলে মিলটা কোথায়? মিলটা হলো, দুজনেরই খুব প্রিয় শহর এই হ্যামিল্টন। মাহমুদউল্লাহর তো প্রিয় হবেই। হ্যামিল্টনে খেলা মানেই যে তাঁর সেঞ্চুরি! এই মাঠে দুটি টেস্ট আর একটি ওয়ানডে খেলেছেন। তিন ম্যাচ, তিন সেঞ্চুরি। আর নিউজিল্যান্ডের সব শহরের মধ্যে হ্যামিল্টন কেন আমার পছন্দ, সেটি তো এই ডায়েরিতেই লিখেছি আগে। দেড় যুগ আগে নিউজিল্যান্ডে প্রথম সফরে এই হ্যামিল্টনই ছিল আমার প্রথম ঠিকানা। এরপর আরও চারবার এসেছি বলে এখানে এলেই বিদেশ বিভুঁইয়ে ‘হোম কামিং’য়ের মতো একটা অনুভূতি হয়। আগেই তো বলেছি এটা, তাই না?
শহরটার মতো এটির পাশ দিয়ে, কখনো বা এর বুক চিরে বয়ে যাওয়া ওয়াইকাটো নদীটাকেও খুব আপন মনে হয়। টিম হোটেল নভোটেল তানুইয়ের পাশেই এই নদী। হোটেলে চেক ইন করেই ছুটে গিয়েছিলাম ওয়াইকাটোর সঙ্গে দেখা করতে। এরপর গত কয়েক দিনে আর সময় হয়নি। লেখা শেষ করতে করতে ভোররাত, সকালে উঠে চোখে ঘুম নিয়ে পড়িমরি করে মাঠে দৌড়ানো...নদীর সঙ্গে কথা বলার সময় কোথায়! কাল রাতেই ঠিক করে রেখেছিলাম, সকালে মাঠে যাওয়ার আগে ওয়াইকাটোর সঙ্গে একটু কথা বলে যাব। আগেভাগেই খেলা শেষ হয়ে যাওয়ায় বিকেলেও আরেকবার ঘুরে আসার সুযোগ হলো। এর আগে যতবার এই নদীটা দেখেছি, অবধারিতভাবেই বুড়িগঙ্গার কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে আসলে নদীটার পাশ দিয়ে দারুণ ‘ওয়াকওয়ে’র জন্য। রেলিং দেওয়া মসৃণ পাকা রাস্তা, মানুষ হাঁটছে, সাইকেল চালাচ্ছে। আজ বিকেলে আমিও কিছুক্ষণ সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আহা, আমাদের বুড়িগঙ্গার পাড়েও যদি এমন থাকত!
এই হ্যামিল্টনে ওয়াইকাটো শুধুই একটা নদীর নাম নয়। বলতে পারেন, এই শহরের প্রাণস্পন্দন। এই ওয়াইকাটো নদীকে ঘিরেই একদা এই শহরের পত্তন। এখানে হ্যামিল্টনের চেয়েও সম্ভবত বেশি উচ্চারিত হয় নামটা। স্থানীয় পত্রিকার নাম ওয়াইকাটো টাইমস, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটি, এখানে উৎপাদিত বিয়ারের নাম ওয়াইকাটো ড্রট, স্যুভেনিরের দোকানে টি শার্ট-মগ-চাবির রিং নানা কিছুতে উৎকীর্ণ এই নাম। ওয়াইকাটো স্কুল অব জুৎজুসু নামে মার্শাল আর্টের একটা একাডেমিও দেখলাম এবার। এমন নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই আছে। হ্যামিল্টনকে কেন্দ্র করে নর্থ আইল্যান্ডের এই প্রদেশটার নামই তো ওয়াইকাটো রিজিয়ন।
নামটা নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরি ভাষায়। পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গার মতো শুধুই একটা নাম নয়। এর অর্থও আছে। মাওরি ভাষায় ‘ওয়াই’ মানে পানি আর ‘কাটো’ মানে নদীর সাগরমুখী যাত্রা। এমনিতে বাংলাদেশের মানুষকে নদী দিয়ে মুগ্ধ করা খুব কঠিন। বেশির ভাগ দেশেই বিখ্যাত সব নদী দেখতে গিয়ে হতাশ হয়েছি। স্থানীয় লোকজনকে তখন পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বিশালত্বের বর্ণনা দিয়েছি, যা শুনে অনেক দেশেই লোকে বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ডমিনিকায় ট্যাক্সি ড্রাইভার সেই দেশে ৩৬৫টা নদী আছে বলে গর্ব করে সবচেয়ে বড় নদীটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখি, ছোট্ট নালার মতো একটা জলধারা। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বলে অবশ্য খুবই স্রোতস্বিনী। জলও স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। আদি ও অকৃত্রিম মিনারেল ওয়াটার বলে তা পানও করা যায়। খুব ভালো কথা, তাই বলে এটাকে নদী বলা হবে! আমি তাই ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম, ‘ওহে, তুমি আমাকে এই নদী দেখাচ্ছ! নদী দেখতে হলে বাংলাদেশে চলো। আমাদের বড় নদীগুলোর এপাড়ে দাঁড়ালে ওপাড় দেখা যায় না।’ এর আগেও স্বভাবসুলভ টুকটাক রসিকতা করেছি বলে এটিকেও রসিকতা ভেবে নিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলেছিলেন, ‘এপাড় থেকে ওপাড় দেখা না যায় না! তার মানে তো তুমি সাগরের কথা বলছ। সাগর আমাদের এখানেও আছে।’ বাংলার নদী বর্ষাকালে কেমন হয়, সেটি বিশ্বাস করাতে পারব না বলে আমি আর কথা বাড়াইনি।
ওয়াইকাটো নদী সম্পর্কে প্রায় সব লেখায় ‘মাইটি’ শব্দটা পেয়ে প্রায় একই রকম অনুভূতি হলো। এটা ‘মাইটি’ হলে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা কী? না, ওয়াইকাটো নদীকে নালার সঙ্গে তুলনা করা অন্যায় হবে। এটি মোটামুটি প্রশস্তই। একসময় নাকি আসলেই খুব প্রমত্ত ছিল। বিভিন্ন স্থানে এর স্বাভাবিক জলধারায় আটটি বাঁধ দেওয়ার পর অনেক শান্ত-সুবোধ হয়ে গেছে। বাঁধ দেওয়ার উদ্দেশ্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। নিউজিল্যান্ডের উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৫ শতাংশেরই উৎস এই ওয়াইকাটোর স্রোত।
এই নদীটা ভালো লাগার আসল কারণ আগেই বলেছি। নদীর পাশের ওই ওয়াকওয়েটা। আরেকটা জিনিসও খুব ভালো লাগে। প্রকৃতিকে খুব একটা বিরক্ত করা হয়নি। নদীর পাড়ে গাছপালা মনের আনন্দে বেড়ে উঠেছে। ওয়াকওয়ের দুপাশে ফুটে আছে রং-বেরঙের জংলি ফুল। বুড়িগঙ্গার তুলনায় এই নদী কিছুই নয়। কিন্তু তারপরও ওয়াইকাটো দেখলেই বুড়িগঙ্গার কথা মনে পড়ার একটাই কারণ, প্রয়োজন না পড়লে কোনো ঢাকাবাসী যেখানে বুড়িগঙ্গায় যায় না, এখানে ওয়াইকাটোর তীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে, একটু পরপর বাগানের মতো বানিয়ে বসার জন্য সুন্দর বেঞ্চ, রেস্টুরেন্ট আরও কত কী! ওয়াইকাটো মিউজিয়াম নামে জাদুঘরটাও এই নদী ঘেঁষেই। এর আগে যেখানে গিয়ে মাওরি ঐতিহ্য আর সভ্যতার অনেক নিদর্শন দেখেছিলাম। সেগুলো একটু রিভিশন দিয়ে আসি বলে আজ আবার গেলাম। গিয়ে একটু হতাশই হলাম। আগের অনেক কিছুই দেখছি নেই। একটু বেশিই আধুনিক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি ‘তাইনুই ক্যানো’ নামে পরিচিত যে নৌকার সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে মানববসতির গোড়াপত্তনের ইতিহাস জড়িয়ে, সেই নৌকার রেপ্লিকাটা পর্যন্ত বড় বেশি রংচঙে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ছাপা হওয়া সবচেয়ে বিখ্যাত ৫০টি ছবি দিয়ে আলাদা একটা গ্যালারি করার অর্থও যেমন খুঁজে পেলাম না। ওয়াইকাটো মিউজিয়ামে কি মানুষ এসব দেখতে আসে নাকি!
‘তাইনুই ক্যানো’র কথাটা এই সুযোগ বলে নিই। আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগে হাজার হাজার কিলোমিটারের অভিযান শেষে ‘তাইনুই ক্যানো’ নামে ওই নৌকাটা এসেছিল ওয়াইকাটো নদী দিয়ে। সেই নৌকায় হাওয়াইকি থেকে আসে মাওরিদের একটা দল। হ্যামিল্টন থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরে কহিয়াল ভিড়েছিল সেটি। নতুন বসতি স্থাপনের জন্য জায়গাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ার পর সেই নৌকাটাকে নদী থেকে তুলে পুঁতে ফেলা হয়েছিল মাটির নিচে। কেউ যেন দলছুট হয়ে যেতে না পারে, সে জন্যই কি! হয়তো বা তা-ই। দুপাশে দুটি পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা সেই তাইনুই ক্যানোর সমাধিস্থল এখন মাওরিদের তীর্থস্থান।
এরপর একসময় ইউরোপিয়ানরা এল। প্রথম কিছুদিন শান্তিপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য চলল, তারপর লেগে গেল সংঘাত। মানবসভ্যতার আদি যুগে সব সংঘাতের মতো এখানেও যেটির মূলে ছিল ভূমির অধিকার। যুদ্ধ হলো, মাওরিরা হারল। তারপরও অনেক ঘটনা পেরিয়ে সহাবস্থানের একটা সমঝোতা। এসব গল্প না হয় আরেক দিন বলি। আজ ওয়াইকাটোই যে লেখার সবটা নিয়ে নিল!