সেই পথ, সেই হ্যামিল্টন, সেই নভোটেল তানুই
উত্তর-দক্ষিণ, উত্তর-দক্ষিণ করলে বলতে সুবিধা হতো। সেটি শোনাতও ভালো। কিন্তু বাংলাদেশ দল তো করছে দক্ষিণ-উত্তর, দক্ষিণ-উত্তর।
কী, হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? নিউজিল্যান্ডের মানচিত্রটা একটু খেয়াল করে দেখুন, আর সেটি মনে হবে না। নর্থ আর সাউথ আইল্যান্ড মিলে এই নিউজিল্যান্ড। দুটিকে আলাদা করে দিয়েছে সাগর। নর্থ আইল্যান্ডের আকৃতির সঙ্গে একটু ডানা ছড়ানো পাখির মিল পাওয়া যায়। সাউথ আইল্যান্ডটা আগাগোড়া প্রস্থে প্রায় সমান লম্বাটে একটা ভূখণ্ড। এই নর্থ আর সাউথকেই ‘উত্তর-দক্ষিণ’ বানিয়ে ওই উত্তর-দক্ষিণ ‘খেলা’র চেষ্টা করছি আরকি!
আজ দুপুরে দক্ষিণ থেকে আবার উত্তরে উড়ে এল বাংলাদেশ দল। সফরের শুরুতেও তা-ই করেছিল। ক্রাইস্টচার্চ থেকে এসেছিল নেপিয়ারে। সেখান থেকে আবার ক্রাইস্টচার্চে ফেরত। ডানেডিনে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ খেলে আবার ক্রাইস্টচার্চ। এবার ক্রাইস্টচার্চ থেকে হ্যামিল্টন। তার মানে শুরু থেকে ধরলে দুবার দক্ষিণ-উত্তর হয়ে গেছে। মাঝখানে অবশ্য একবার উত্তর-দক্ষিণও। শেষটাও সেভাবেই হবে। হ্যামিল্টন আর ওয়েলিংটনে প্রথম দুই টেস্ট খেলে শেষ টেস্ট খেলতে আবার যেতে হবে ক্রাইস্টচার্চে। বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রতিটি দলের একটি বেসক্যাম্প থাকে। ম্যাচ খেলেই ফিরে আসে সেখানে। এই সফরে ক্রাইস্টচার্চের নভোটেল অন ক্যাথেড্রাল স্কয়ার হোটেল যেন বাংলাদেশ দলের ‘বেসক্যাম্প’।
নর্থ আইল্যান্ড আর সাউথ আইল্যান্ডের ব্যাপারটা মনে রাখার কাজ আরেকটু সহজ করে দিই। সেটি ক্রিকেটীয় ফর্মুলা দিয়েই। শুধু ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি আয়োজন করেছে, এমন মাঠের কথা বাদ দিন। শুধু টেস্টের কথা ধরলে নর্থ আইল্যান্ডে নিয়মিত টেস্ট খেলা হয়, এমন শহর চারটি—অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন, হ্যামিল্টন আর নেপিয়ার। সাউথ আইল্যান্ডে টেস্টের আয়োজক শহর বলতে ক্রাইস্টচার্চ আর ডানেডিন। দুটিই অনেক পুরোনো টেস্ট ভেন্যু। একটু বোধ হয় ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন, তাই না? কদিন আগেই পড়েছেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলে টেস্ট অভিষেক হয়েছে ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠের। এখন আবার বলছি, ডানেডিন অনেক পুরোনো টেস্ট ভেন্যু। দুটিই ঠিক আছে। শুধু মাঠের কথা ধরলে টেস্ট ভেন্যু হিসেবে ইউনিভার্সিটি ওভাল একেবারেই নবীন। তবে ডানেডিনে প্রথম টেস্ট খেলা হয়েছে সেই ১৯৫৫ সালে। ১৯৯৮ পর্যন্ত ১২টি টেস্ট হয়েছে ওই শহরে। মাঠের নাম ক্যারিসব্রুক। এই মাঠেই জীবনের দ্বিতীয় টেস্টেই ১০ উইকেট নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর আগমনবার্তা ঘোষণা করেছিলেন ওয়াসিম আকরাম। ১৯৮০ সালে ওই মাঠেই মহা উত্তেজনাময় এক টেস্ট ম্যাচে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদে স্টাম্পে লাথি মেরেছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। এমন আরও অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে বলে সেই মাঠটা দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। স্থানীয় এক সাংবাদিক সেই আগ্রহে জল ঢেলে দিলেন, ‘ওখানে গিয়ে মাঠের কোনো চিহ্নও আর পাবেন না। ওই জায়গাটায় এখন পরিত্যক্ত গাড়ির একটা গ্যারেজ।’ ক্রাইস্টচার্চ আর ডানেডিনের বাইরে বাংলাদেশ খেলেছে বলে সাউথ আইল্যান্ডের দুটি ওয়ানডে ভেন্যুও আপনার ভালোভাবেই চেনার কথা—নেলসন ও কুইন্সটাউন।
কী ব্যাপার, ডায়েরিটা তো দেখছি দিনলিপির বদলে প্রথমে ভূগোলের ক্লাস, তারপর নিউজিল্যান্ডের টেস্ট ভেন্যুর ইতিহাস নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়ে যাচ্ছে! এবার তাহলে সেটিতে ক্ষান্তি দিয়ে আজকের দিনটার গল্প বলি। বেলা ১১টায় ক্রাইস্টচার্চ থেকে ফ্লাইট। বাংলাদেশ দলও সেই একই ফ্লাইটে। সেই ফ্লাইট নামবে অকল্যান্ডে। সেখান থেকে বাসে আসতে হবে হ্যামিল্টন। ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম সফর থেকেই হ্যামিল্টনে এভাবেই আসতে দেখছি বাংলাদেশ দলকে। তবে এবারেরটা নিয়ে একটু প্রশ্ন জাগল মনে। বছর দুয়েক আগে সর্বশেষ সফরটির কথা বাদ দিলে এর আগের সববার বাংলাদেশ দল দেশ থেকে এসে অকল্যান্ডেই নেমেছে। সেখান থেকে তো বাসেই আসতে হবে। কখনো অকল্যান্ডে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে, কখনোবা বিমানবন্দর থেকেই বাসে করে এসেছে হ্যামিল্টনে। বাসে দেড় ঘণ্টার দূরত্বের দুই শহরের মধ্যে তো আর বিমানের যাওয়া-আসা থাকে না। কিন্তু ক্রাইস্টচার্চ থেকে হ্যামিল্টনে সরাসরি ফ্লাইট থাকার পরও এবারও কেন অকল্যান্ড ঘুরে আসতে হলো, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম না। এখান থেকে ওয়েলিংটনে যাওয়ার সময়ও একই ভ্রমণসূচি। অথচ হ্যামিল্টন থেকেই সরাসরি ফ্লাইট আছে ওয়েলিংটনের।
এমনিতে নিউজিল্যান্ডের ডোমেস্টিক ফ্লাইটের মতো নির্ঝঞ্ঝাট যাত্রা আর হয় না। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সিকিউরিটি চেকিংয়ের কারণে বিমানে ওঠার আগেই ঘাম ছুটে যায়। নিউজিল্যান্ডে এসবের বালাই নেই। কেবিন লাগেজ স্ক্যানিং পর্যন্ত হয় না। বোর্ডিং পাস পেয়ে যাওয়ার পরও বিমানবন্দর থেকে ইচ্ছেমতো বাইরে যাওয়া-আসা করা যায়। সেটি আজও করা গেল। তবে এই প্রথম দেখলাম, কেবিন লাগেজের স্ক্যানিং থেকে শুরু করে আর্চগেট দিয়ে পেরোনো—সবকিছুই করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ দলের কে যেন রসিকতা করে বললেন, ‘বাংলাদেশে যে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছে, সে কারণেই মনে হয় এখানেও এত কড়াকড়ি।’
মাত্র ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ফ্লাইট। এমন সংক্ষিপ্ত ফ্লাইটে পাশের সিটের সহযাত্রীর সঙ্গে বেশির ভাগ সময় পরিচয়ই হয় না। আজ শুধু তা হলোই না, গল্পে-আড্ডায় সময়টা যেন নিমেষে ফুরিয়ে গেল। প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পা পড়বে পড়বে, এমন এক দম্পতি আমার পাশের দুই সিটে। জেনি নামের নারী ব্রিটিশ, স্বামী মাইক কিউই। ইংল্যান্ডেই তাঁদের পরিচয়। প্রায় ৩০ বছর ধরে ইংল্যান্ডেই বাস। ব্রিস্টলের পাশে ছোট্ট শহর বাথে। নিউজিল্যান্ড এসেছেন মূলত বেড়াতে, মাইকের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করাও একটা উদ্দেশ্য। খেলাই যোগসূত্র হয়ে আলাপটা জমিয়ে দিল। জেনি স্পোর্টস ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে অনেক বছর কাজ করেছেন। যে ভূমিকায় তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি—গ্রেট ব্রিটেন রোয়িং টিমের ফিজিও হয়ে ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে যাওয়া। সাংবাদিক হিসেবে সেটিই আমার প্রথম অলিম্পিক—এটাই জমিয়ে দিল আড্ডাটা। স্বামী-স্ত্রীর কেউই ক্রিকেটের খোঁজখবর খুব একটা রাখেন না। বাংলাদেশ দলের কোনো ক্রিকেটারের নাম পর্যন্ত বলতে পারলেন না। তবে একটা বিস্ময় প্রকাশ না করে পারলেন না জেনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের উচ্চতার রকমফের দেখে তিনি খুবই বিস্মিত, ‘যেকোনো স্পোর্টস টিমে বলতে গেলে সবাই কাছাকাছি লম্বা হয়। তোমাদের দলে কিছু খেলোয়াড় অনেক লম্বা, কেউ আবার একেবারেই খাটো। এমন আর দেখিনি।’
অকল্যান্ডে নেমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিলাম মাইক-জেনি দম্পতির কাছ থেকে। বাংলাদেশ দলের জন্য বাস দাঁড়িয়েই ছিল। তারা হ্যামিল্টনে রওনাও হয়ে গেল। এবার আমার বাসের জন্য অপেক্ষা। ঘণ্টা দেড়েক অকল্যান্ড বিমানবন্দরে কাটিয়ে সেটিতে ওঠার পর যেন ‘ডাউন মেমোরি লেন’-এ যাত্রা! বিশ্বকাপের ম্যাচটা ধরলে এর আগে চারবার হ্যামিল্টনে এসেছি। প্রতিবারই অকল্যান্ড থেকে। রাস্তাটা আমার তাই খুব চেনা। কানে হেডফোন লাগিয়ে ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ রবীন্দ্রসংগীতটা শুনছি আর মনে পড়ছে সেই প্রথম সফরের কথা। ঈদের আগের দিন এসে অকল্যান্ডে নামলাম। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়কার সহপাঠী আসলাম তখন এখানেই থাকত। তার বাসায় রাত কাটানোর পরদিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল হ্যামিল্টনের নভোটেল তানুই হোটেলে। এবারও সেই একই হোটেল। মাঝখানে আরও তিনবার হ্যামিল্টনে এসে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে এখানেই উঠেছি। হোটেলকে ‘বাড়ি’ মনে হওয়ার কোনোই কারণ নেই। তবে বারবার ফিরে আসার কারণে নভোটেল তানুইকে আমার অনেকটা সে রকমই লাগে। পাশের রাস্তার দুপাশের দোকানপাটগুলোও খুব একটা বদলায়নি বলে শহরটাকেও খুব চেনা আর একটু আপন আপনও মনে হয়।
এই হোটেল, পাশের ওয়াইকাটো নদী, হ্যামিল্টনের মাউরিদের গল্প—এসব নাহয় কাল বা পরশুর জন্য তোলা থাক।