সেই বেনজেমারই এমন পোড়া কপাল!
শনিবার চোটে পড়ে যখন অনুশীলন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কী ভাবছিলেন করিম বেনজেমা? হয়তো ভাবছিলেন, ‘হায়, নিয়তি কতই না নিষ্ঠুর! নিজ হাতে লেখা গল্পটার এমন করুণ পরিণতি দেখতে হলো!’ সব রকম দুঃসময় ও প্রতিকূলতাকে তো ঠিকই জবাব দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন প্রত্যাবর্তনের অনবদ্য এক গল্পও। পারলেন না শুধু ফুটবলার তথা ক্রীড়াবিদদের জীবনে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা চোটকে হারাতে। উল্টো সেই চোটের কাছে হার মেনে নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়লেন।
গল্পের শেষটা এমন করুণ হওয়ার কথা ছিল না। মোটেই এমন হওয়ার কথা ছিল না। ঠিক এক মাস আগে ভিন্ন এক রাতের সাক্ষী হয়েছিলেন বেনজেমা। প্যারিস সেদিন আলোকিত হয়েছিল বেনজেমার আলোয়। একসময় অনেকের কাছেই বাতিলের খাতায় পড়ে যাওয়া সেই বেনজেমা জিতেছেন ফুটবলে ব্যক্তিগত অর্জনের শ্রেষ্ঠ খেতাব ব্যালন ডি’অর। বেনজেমার জয় যেন হার না মানা মানুষেরও জয়।
তবে কে জানত, মুদ্রা তার অন্য পিঠ নিয়ে হাজির হবে বেনজেমার সামনে! মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্তে বেনজেমাকে মাঠ ছাড়তে হলো বেদনা নিয়ে। ঠিক এক মাস আগে যে পৃথিবীকে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল, বেনজেমার জন্য সেটিই এখন কত নিষ্ঠুর! হয়তো ভাবছেন, এটুকু ছাড় প্রকৃতি চাইলে তাঁকে দিতেই পারত!
উত্থান-পতনের ক্যারিয়ারে বেনজেমাকে বরাবরই ছুটতে হয়েছে কঠিন পথে। অভিবাসী পরিবারের ছেলে হিসেবে পথ হারানোর আশঙ্কাকে সঙ্গী করেই শুরু হয়েছিল জীবন। লড়াইয়ের বীজটা তাই ভেতরেই ছিল। অন্তর্মুখী স্বভাব এবং ওজন নিয়ে শুনতে হতো সহপাঠীদের কটূক্তি। তবে সেসব ঠিকই পেছনে ফেলেছিলেন বেনজেমা। দুঃসময়ে ফুটবল নামক গোল বস্তুটায় আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন। ফুটবলই বেনজেমাকে পৌঁছে দিয়েছিল লিঁওতে।
মাঠের কাজটা ঠিকঠাক করে গেলেও বাইরে সতীর্থদের সঙ্গে মিশতে পারতেন না। প্রথমবার যখন লিঁওর মূল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাঁরাও তাঁকে নিয়ে মজা শুরু করেছিলেন।
বেনজেমা তখন বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে হাসাহাসি কোরো না। মনে রেখো, একসময় আমি বল বয় ছিলাম। এখন তোমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছি, ১০ নম্বর জার্সির জন্য এবং জায়গা নেওয়ার জন্য।’ সে কথাও ঠিকই রেখেছিলেন বেনজেমা।
কে জানত, বেনজেমার পরের সময়টাও হবে সেই একই রকম লড়াইয়ের। স্বপ্ন দেখেছিলেন, রিয়াল মাদ্রিদে খেলবেন। সেই স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। তবে সেখানেও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের এক নক্ষত্রের আলোয় আড়ালে থাকতে হয়েছে লম্বা সময়। সতীর্থদের অর্জনে পেছনে দাঁড়িয়ে তালি দেওয়াই যেন ছিল তাঁর নিয়তি। সঙ্গে চোট তো লেগেই ছিল। তবে হাল ছাড়েননি।
কঠিন লড়াইয়ে সেসব প্রতিবন্ধকতাকে ঠিকই হারিয়েছেন। রোনালদোর ছায়াসঙ্গীর তকমা ছুড়ে ফেলে লিখেছেন নতুন এক গল্প। সেই গল্পে রিয়ালের হয়ে নিজেকে বানিয়েছেন বিশ্বসেরা। বেনজেমার এই গল্পটা একেবারে মৌলিকও।
রিয়ালে যখন সংগ্রাম করছিলেন, তখন ফুটবলটা অন্তত খেলতে পারছিলেন। জাতীয় দলে বেনজেমার অবস্থা তো আরও শোচনীয় ছিল। ব্ল্যাকমেলিং বিতর্কে সাড়ে পাঁচ বছর জাতীয় দলে ব্রাত্য ছিলেন বেনজেমা। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়টা তাই উপভোগ করতে হয়েছে টিভির সামনে বসে। তবে কাতারে সেই দুঃস্বপ্নকে কবর দিতে চেয়েছিলেন বেনজেমা।
সম্প্রতি প্রথম আলোর জন্য দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে প্রশ্ন করলে, বেনজেমার উত্তর ছিল, ‘চলুন এই অধ্যায়টা ভুলে যাই।’ সেই অধ্যায় ভুলতে হলে যে নতুন আরেকটি অধ্যায় লিখতে হতো, তা বেনজেমার জানাই ছিল। বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপের মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে উন্মুখ হয়ে আছি।’
তবে বেনজেমার সঙ্গে ফুটবলের রহস্যময়তা যেন শেষ হওয়ার নয়। যখন মনে হচ্ছিল ফুটবল বেনজেমাকে তাঁর সব প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুত, তখন দেখা মিলল এই ইউ-টার্নের। বিশ্বকাপে মাঠে নামার সুযোগই পেলেন না ফরাসি স্ট্রাইকার। কাতারে মহাযজ্ঞ শুরুর এক দিন আগে চোটের মিছিলে জর্জর ফ্রান্সের বেদনার ভার আরও বাড়িয়ে হাঁটতে হলো ‘প্রস্থানের’ পথে।
বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বেনজেমা তাঁর বিবৃতির শুরুতেই বলেছেন, ‘আমার জীবনে আমি কখনো হাল ছাড়িনি।’ হাল হয়তো এবারও ছাড়বেন না, ফিরেও আসবেন সময়মতো।
তবে কখনো কখনো মানুষের লড়াই আর একাগ্রতার চেয়ে নিয়তির মারটাই যেন বড় হয়ে ওঠে। সেই নিয়তিই বলে দিচ্ছে, বেনজেমার বিশ্বকাপ স্বপ্নটার এখানেই সমাপ্তি। ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা এবং তারপরও হয়তো এই অপূর্ণতা নিয়েই কাটাতে হবে তাঁকে।