নামিবিয়ার রূপকথার নেপথ্যে যে তিনজন
নামিবিয়ান অধিনায়ক গেরহার্ড এরাসমাসের সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিল। ভাঙা আঙুল নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া নয় তো, ১৮ বছর পর প্রত্যাবর্তনের (২০২১) বিশ্বকাপে নতুন ইতিহাস লেখা। চিকিৎসকেরা এরাসমাসকে দ্রুত দেশে ফিরে আঙুলের অস্ত্রোপচার করাতে বলেছিলেন। কিন্তু নতুন ইতিহাস লেখার তাড়নায় সে কথা কানে নেননি এরাসমাস। ভাবতে পারেন, ২০২২ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর ২০২১ বিশ্বকাপের গল্প বলা কেন! রূপকথার শুরুটা যে হয়েছে তখনই।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নামিবিয়া বিশ্বকাপই খেলতে গিয়েছিল ১৮ বছর পর। ফিরে এসেই নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ডকে টপকে খেলেছিল সুপার টুয়েলভে। পরে সুপার টুয়েলভেও হারিয়েছে স্কটল্যান্ডকে। এরাসমাস চোটের কারণে দেশে ফিরে গেলে ২০২১ বিশ্বকাপে তাঁর দল সাফল্য পেত না, এ কথা হয়তো নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। তবে বিশ্বকাপে নামিবিয়ার কিছু করে দেখানোর স্বপ্নে যে বড় একটা ধাক্কা লাগত, সেটা বলাই যায়।
এবার ২০২২ বিশ্বকাপে এসে তো প্রথম দিনই চমক দেখাল সেই নামিবিয়া। জিলংয়ে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচেই তারা হারিয়ে দিয়েছে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছিল শ্রীলঙ্কা, সে স্বপ্নে শুরুতেই বড়সড় ধাক্কা খেল লঙ্কানরা।
বিশ্বকাপে এমন চমকে দেওয়া শুরু করে শুধু শ্রীলঙ্কাকে নয়, নামিবিয়া আসলে ধাক্কা দিয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই। সঙ্গে এটাও প্রমাণ করেছে, গত আসরে তাদের বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে খেলাটা ‘ফ্লুক’ ছিল না।
টানা দুই বিশ্বকাপে এমন চমক! কৌতূহল হতেই পারে এর পেছনের রহস্যটা জানার। নামিবিয়ার মৃতপ্রায় ক্রিকেট–সংস্কৃতিতে প্রাণ ফিরিয়েছেন আসলে তিনজন মানুষ। অধিনায়ক এরাসমাসের কথা তো বলাই হলো, বোর্ড সভাপতি রুডি ফন বুরেন আর কোচ পিয়েরে ডি ব্রুইনার কথাও বলতে হয়।
নামিবিয়া প্রথম বিশ্বকাপ (ওয়ানডে) খেলেছে ২০০৩ সালে। সেবারও এক অর্থে রেকর্ডই গড়েছিল তারা। তবে সেটা তাদের জন্য মোটেই গর্বের ছিল না, ছিল লজ্জার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নামিবিয়ার ২৫৬ রানের বিশাল হারটা ছিল তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় হার।
এ ছাড়া পাকিস্তানের কাছে তারা হেরেছিল ১৭১ রানে, ভারতের কাছে ১৮১ রানে। এত লজ্জার মধ্যেও রুডি ফন বুরেন ছিলেন ব্যতিক্রম, সেই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যিনি নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচে আউট করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকারকেও। অবশ্য রুডি ফন বুরেনের ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্সও নামিবিয়ার ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে পারেনি।
নামিবিয়ার মৃতপ্রায় ক্রিকেটে প্রাণ ফেরে ২০১৯ সালে এবং সেটা সেই ২০০৩ বিশ্বকাপের ‘নায়ক’ ফন বুরেনের হাত ধরেই। ২০০৩ বিশ্বকাপের ১৬ বছর পর ২০১৯ সালে কার্যক্রম শুরু হয় নামিবিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের। বোর্ড সভাপতি হন সেই ২০০৩ বিশ্বকাপ দলের ফন বুরেন। ফন বুরেন যখন দায়িত্ব নেন, তখন কেন্দ্রীয় চুক্তিতে খেলোয়াড় ছিলেন মাত্র চারজন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আইসিসির ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়ার পর যুক্ত হন আরও ১৩ জন। ফন বুরেনই লেস্টারশায়ারের সাবেক কোচ পিয়েরে ডি ব্রুইনাকে নিয়ে আসেন দলের কোচ হিসেবে।
কোচ পিয়েরে ডি ব্রুইনা নামিবিয়ার ক্রিকেট রূপকথাকে সামনে নিয়ে যান আরও এক ধাপ। কোচ হয়ে এসে সবার আগে বন্ধু দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার অ্যালবি মরকেলকে নিয়ে আসেন সহকারী হিসেবে।
ম্যাচ খেলতে না পারার আক্ষেপ করা নামিবিয়াকে ম্যাচ অনুশীলনের সুযোগ করে দেন। তার চেষ্টাতেই জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদীয়মান দলগুলোর সঙ্গে ম্যাচ খেলতে পারে নামিবিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলা ডেভিড ভিসাকে নামিবিয়া দলে আনতেও বড় ভূমিকা ছিল এই কোচের। প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে নামিবিয়ার জায়গা পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই ভিসার।
গতকাল শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর সাফল্যের মূল কৃতিত্বটা হেড কোচ ডি ব্রুইনাকেই দিয়েছেন নামিবিয়ার অধিনায়ক, ‘ডি ব্রুইনা ২০১৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের পুরো দলটাকে বদলে দিয়েছেন। মূল কৃতিত্ব অবশ্যই পিয়েরে ডি ব্রুইনার। অল্প কিছু খেলোয়াড় ও সীমিত সুযোগ নিয়েও তিনি দলকে কোচিং করাচ্ছেন, জয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছেন এবং সবাইকে এক করে রাখছেন। আমার মনে হয় না আর কেউ তাঁর মতো পারতেন। আজকের মতো বিশেষ দিন তাঁর জন্য প্রতিদান পাওয়ার মতোই বিষয়।’
বোর্ড সভাপতি, কোচ, অধিনায়ক—এই তিনের মেলবন্ধনেই এত দূর এসেছে নামিবিয়ার ক্রিকেট। ক্রিকেটট যে ‘টিম গেম’, সেটার বড় উদাহরণ বোধ হয় নামিবিয়াই।