'শেখ মুজিবের মতো মানুষ দেখিনি'
>কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বিশেষ বিমানে লন্ডন থেকে ঢাকার পথে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন ভারতীয় কর্মকর্তা ভেদ মারওয়া।পেশাজীবনে তিনি ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ও কূটনীতিক। অবসরের পর মণিপুর, মিজোরাম ও ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজ্যপালের দায়িত্বও পালন করেছেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে বিমানের পাশের আসনে বসে কিংবদন্তিসম ব্যক্তিটির কথা শুনেছেন তিনি। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ দিল্লির বাসভবনে তাঁর কাছ থেকে বিশদ শুনেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো মতিউর রহমানের ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি (২০১৭) বই থেকে।
মতিউর রহমান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার দেখা হলো কীভাবে?
ভেদ মারওয়া: ১৯৭২ সালে আমি তখন লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত। একদিন সকালে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের কাছ থেকে আমি একটি বার্তা পেলাম। বার্তায় আমাকে দ্রুত দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হলো। এমন কী জরুরি ঘটনা ঘটল এবং কেন আমাকেই দিল্লিতে যেতে হবে, এটা ভেবে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম।
শেখ মুজিব ছিলেন ওই সময়ের ‘হিরো’। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে তখন শেখ মুজিব ছাড়া কোনো কথা নেই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডনে আসছেন। তো, আমাকে বলা হলো, ভারত সরকার চাচ্ছে শেখ মুজিব ঢাকা যাওয়ার পথে আপনি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া বিশেষ বিমানে তাঁকে সঙ্গ দেবেন। এখানে আমাকে একটি কথা অবশ্যই বলতে হবে। তা হলো, একজন কূটনীতিকের মতো আমি এ বিষয়ে কোনো কিছু লিখে রাখিনি। তবে বিষয়টি লিখে রাখা উচিত ছিল। কেননা, আমি একটি দেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম।
যাহোক, অনেক বছর পার হয়ে গেছে। আমার স্মৃতিশক্তি আর আগের মতো প্রখর নেই। সবকিছু হয়তো গুছিয়ে বলতেও পারব না। বরং আপনি আমাকে প্রশ্ন করলে এর উত্তর দেওয়াটাই আমার জন্য সহজ হবে।
মতিউর: আপনাদের যাত্রাটা কেমন ছিল?
মারওয়া: তো, এক সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে আমরা একটি বিশেষ বিমানে চাপলাম। আমাদের যাত্রাপথ ছিল হিথরো থেকে প্রথমে নিকোশিয়া (সাইপ্রাস), সেখান থেকে বাহরাইন, বাহরাইন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা।
পথে নিকোশিয়ায় আমরা যাত্রাবিরতি করি। পরে বাহরাইন হয়ে দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর স্বাধীন বাংলাদেশের নায়ক শেখ মুজিবকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তিনি জনসমাবেশে যোগ দেন। সেখানে মিসেস গান্ধীও (ইন্দিরা) ছিলেন।
বিমানে আমরা চার থেকে পাঁচজন ছিলাম। শেখ মুজিব, ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন ও আমি এবং লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের আরেকজন কর্মকর্তা। যত দূর মনে পড়ে, তাঁর নাম ছিল ব্যানার্জি। তবে আমি তাঁর আসল নামটি ভুলে গেছি।
আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। দীর্ঘদিন কারাবন্দী সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙা দেখাচ্ছিল। সবকিছুতেই তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ কাজ করছিল। তো, তিনি আমাকে তাঁর পাশের আসনে বসার জন্য ডাকলেন। তিনি যখন বুঝলেন আমি বাংলা বুঝতে পারি ও বলতে পারি, তখন আমাদের মধ্যে দ্রুত একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেল। একজন তরুণ হিসেবে শেখ মুজিবের মতো ব্যক্তিত্বের পাশে বসার অভিজ্ঞতা আমাকে সেদিন ভীষণ রোমাঞ্চিত করেছিল। তখন শেখ মুজিবকে কথায় পেয়ে বসেছিল। তিনি কামাল হোসেন ও আমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে টানা কথা বলেছিলেন। তবে এই মুহূর্তে আমার সব কথা ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। এটা সম্ভবও নয়। কেননা, সেটা ৩৬ বছর আগের কথা। তবে কিছু বিষয় এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে, যা ওই সময় আমার মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
মতিউর: কী কী বিষয়, একটু বলবেন?
মারওয়া: প্রথমত, শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক মানুষ। আশপাশের সবার সঙ্গে দ্রুত হৃদ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন তিনি। তিনি আমার সঙ্গে কেবল কথা বলার জন্যই কথা বলেননি। তাঁর বলার ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক, যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা!
দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তাঁর যত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জানতেন না তাঁর ভাগ্যে কী আছে। কী ঘটতে পারে, এটা নিয়েও তাঁর চিন্তা ছিল না। বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। তাঁর কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসছিল সদ্য জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা।
আমাকে বলা কথাগুলো ঢাকায় অবতরণের পররেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া সেই বিখ্যাত ভাষণেও তিনি বলেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, বিমানে ভ্রমণের সময়ই তিনি বক্তৃতায় কী বলবেন, তা মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ওই ভাষণ শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল। তাঁর আরও কয়েকটি বিষয় আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। বিষয়গুলো ঢাকা থেকে ফেরার পর ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর (ইন্দিরা) মুখ্য সচিব পুরুষোত্তম নারায়ণ (পি এন) হাকসারকে জানিয়েছিলাম।
মতিউর: বিষয়গুলো একটু বিস্তারিত বলবেন?
মারওয়া: ওই সময় শেখ মুজিব বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন। ভারতের প্রতি তাঁর বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি ছিল। তিনি মূলত দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমত, বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য। শেখ মুজিব বলেছিলেন, এত মানুষ কোথায় যাবে? এখনো যেসব স্থানে জনসংখ্যার আধিক্য দেখা দেয়নি, কেবল সেসব স্থানই তাদের গন্তব্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের উচিত পরস্পরকে সহযোগিতা করা। স্বাভাবিকভাবেই ওই মুহূর্তে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলাম। আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে মুজিব নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে হবে।
একপর্যায়ে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচয় কী হবে, তা নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। আমার উদ্দেশে শেখ মুজিব বলছিলেন, দেখো, আমরা প্রথমে বাঙালি। এটা বাংলাদেশিদের বহুস্তরবিশিষ্ট পরিচয়ের একটি। আমরা এ পরিচয় নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। এ পরিচয়কে ভিত্তি করেই স্বাধীনতার সব আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা মুসলিম। স্বীকার করতে হবে, তাঁর এ কথায় আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক পরিচয়। তিনি বলছিলেন, এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো খুব বেশি অভিন্ন। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই। আপনি কল্পনা করতে পারেন, একজন মানুষ কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে দায়িত্বভার গ্রহণের আগেই এমন সব কথা বলতে পারেন! তাঁর ব্যক্তিত্বের এই প্রখরতা ওই সময় আমার মধ্যে গভীর দাগ কেটেছিল।
শেখ মুজিবের কথায় মনে হচ্ছিল পুরো বাংলাদেশটাই তাঁর হাতের মুঠোয়। যেন তিনিই ‘বাংলাদেশ’। তাঁর মধ্যে এমন একটা অনুভূতি ছিল। কেউ এটাকে ‘মেগালোমেনিয়া’ (অতি ক্ষমতাশালী ভাবার প্রবণতা) বলতে পারেন। তবে বিষয়টি চোখে লাগত না। এটা ছিল অত্যন্ত সাধারণ বিষয়, তাঁর জন্য। কেননা, তিনি কথাগুলো বলছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। এভাবে তিনি বলছিলেন, ‘আমার মানুষ, আমার এটা, আমার ওটা।’
মতিউর: দিল্লি বিমানবন্দরের সংবর্ধনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মারওয়া: দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাঁকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে আয়োজিত ছোট পরিসরের জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। আমাদের বিমান অবতরণ করে দিল্লি বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এরিয়ায়, যেখানে কেবল রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি তো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন।
মতিউর: ওই সময় ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন?
মারওয়া: ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আমি নিজেও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টানা চার বছর কাজ করেছি। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত অন্তর্মুখী মানুষ। তিনি কোনো বিষয়ে সহসা অস্থির হতেন না। কথাও বলতেন কম। খুব কম সময়েই তাঁকে দেখেছি বিদেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মন্তব্যের উত্তর দিতে। অনেক সময় তাঁরা বুঝতেও পারতেন না ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের কথা শুনছেন কি না। তাঁর কাছ থেকে কোনো কিছু বের করা ছিল অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। তবে শেখ মুজিবের বেলায় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন পুরো উল্টো। এটা ঠিক, মুজিবকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে অত্যুৎসাহ কাজ করেনি। কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল, যেন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কত দিন পর দেখা হলো! মিসেস গান্ধীর এই আন্তরিক ভঙ্গিটি ছিল উল্লেখযোগ্য।
এরপর আমরা ঢাকায় আসি। ওই সময় ঢাকা বিমানবন্দরে কোনো কাস্টমস বা কোনো কিছু ছিল না, কোনো ইমিগ্রেশনও ছিল না। হয়তো আমিই ছিলাম প্রথম অতিথি। আমাকে থাকতে দেওয়া হলো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। এরপর হোটেলে এলেন ফারুক চৌধুরী। আমার যত দূর মনে পড়ে, ফারুক চৌধুরী তখন প্রটোকলপ্রধান ছিলেন।
মতিউর: তখন বিমানবন্দরের অবস্থা কেমন ছিল?
মারওয়া: বিমানবন্দরে কিছুই ছিল না। এ কথাটা রেকর্ডে থাকা দরকার যে আমি বাংলাদেশ সফর করেছিলাম। এটা বাংলাদেশের ইতিহাস বা আমার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়। এখানে আমাকে অবশ্যই একটা কথা বলতে হবে যে আমার সফর ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। বিমানবন্দর থেকে আমি ইমিগ্রেশন অফিসে গেলাম স্ট্যাম্পের জন্য। সেখানে আমি নিজেই নিজের পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগাই। নিজেই স্বাক্ষর করি। ওই পাসপোর্ট এখনো আমার কাছে আছে। এই ছিল বিমানবন্দরের অবস্থা।
এখানে আরও কিছু বিষয় বলা দরকার। ভারতে প্রায়ই আমাকে অনেক জনসভায় যোগ দিতে হয়েছে। বিশেষ করে কংগ্রেস পার্টি যখন ভেঙে গেল, ইন্দিরা গান্ধীকে দল থেকে বাদ দেওয়া হলো। তখন ভারতজুড়েই অনেক জনসভা হয়েছে। তো, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাকেও অনেক সভায় যেতে হয়েছে।
তবে ঢাকায়রেসকোর্স ময়দানে যে জনসভা দেখেছি, তা ছিল এককথায় অবিশ্বাস্য! ওই জনসভায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা ছিল সত্যিকার অর্থেই আবেগপ্রবণ।
মতিউর: আপনি কি ওই সময় রমনার মঞ্চে ছিলেন?
মারওয়া: না, আমি মঞ্চের সামনে বসে ছিলাম। আসলে শেখ মুজিব ছিলেন সত্যিকারের সহজাত বক্তা। যে ভঙ্গিমায় তিনি বলা শুরু করলেন, তাতে উপস্থিত প্রত্যেকে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। এমনকি তাঁর কথা শুনে আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।
মতিউর: শেখ মুজিবের সঙ্গে কি পরে আর আপনার দেখা হয়েছিল?
মারওয়া: না, ঢাকায় আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। কেননা, তিনি স্বাভাবিকভাবেই ওই সময় খুব ব্যস্ত ছিলেন। ঢাকা ছাড়ার সময়ও আমি তাঁকে বিদায় বলে আসিনি। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিন পর মুজিব নিজেই লন্ডনে এসেছিলেন।
মতিউর: ঢাকায় অবতরণের পর আপনারা কীভাবে আলাদা হয়ে গেলেন?
মারওয়া: ঢাকায় নামার পর তাঁকে (মুজিব) আলাদাভাবে নিয়ে যাওয়া হলো, আমাকে আলাদাভাবে নিয়ে যাওয়া হলো। আগেই বলেছি, আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হোটেলে। এরপর আমি জনসভায় আসি। বিমানবন্দরেই তিনি আমাকে জনসভায় আসতে বলেছিলেন। আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে জনসমাবেশের জায়গাটা খুব বেশি দূরেও ছিল না।
আগের কথায় ফিরে আসি। আমি ঢাকা থেকে লন্ডনে ফেরার কয়েক দিন পর শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে লন্ডন সফরে আসেন। ব্রিটিশ সরকারও তাঁকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিআইপির মর্যাদা দেয়। একসঙ্গে বিমানে ভ্রমণের কথা তাঁর ঠিকই খেয়াল ছিল। তো, শেখ মুজিব একদিন আমাকে সস্ত্রীক লন্ডনের বিখ্যাত ক্ল্যারেজিয়াস হোটেলে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। আমার স্ত্রী এতে খুব সম্মানিত বোধ করেছিলেন। কেননা, একজন প্রধানমন্ত্রী আমার মতো একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন! আর শেখ মুজিব তখন কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। সেখানে আমরা ঘণ্টাখানেক ছিলাম।
মতিউর: সেখানে আপনাদের মধ্যে কী কথা হয়?
মারওয়া: শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি আশাবাদী ছিলেন।
মতিউর: তিনি কোনো সমস্যার কথা বলেছিলেন?
মারওয়া: না, তিনি শুধু ভারত নয়, অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারেও খুব আশাবাদী ছিলেন।
মতিউর: বিমানে কিংবা পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছেন? যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কীভাবে হয়েছে, এটা কীভাবে সফল হলো, ভারতের কী ভূমিকা ছিল?
মারওয়া: ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, তিনি কিন্তু এসব ব্যাপারে কিছু জানতে চাননি। লন্ডনে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং শেখ মুজিব এ ব্যাপারে একটি কথাও জিজ্ঞেস করেননি।
মতিউর: শেখ মুজিব কি পাকিস্তানে তাঁর বন্দী দিনগুলোর কথা বলেছিলেন? আপনি কি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?
মারওয়া: না, অতীত সম্পর্কে বলার মতো যথেষ্ট সময় তাঁর হাতে ছিল না। তিনি কেবল ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন। কেননা, বিমানে তিনি প্রায়ই আসন ছেড়ে কামাল হোসেনের কাছে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর কী ধরনের কাজ করতে হবে, সেসব নিয়ে কথা বলছিলেন। আসলে তিনি ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছিলেন।
মতিউর: তিনি কি ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেছিলেন?
মারওয়া: না, তিনি পাকিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেননি।
মতিউর: ইতিবাচক কিছু কি বলেছিলেন?
মারওয়া: না, ইতিবাচক কিছুও বলেননি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে—এমন কিছু তিনি ভাবেননি। তবে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন, যা আমার মনে ছাপ ফেলেছিল।
মতিউর: বিমানে কি শেখ মুজিব তাঁর স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু জানতে চেয়েছিলেন?
মারওয়া: না, কিছুই জানতে চাননি। তাঁর মধ্যে তখন প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা কাজ করছিল। আমার কূটনৈতিক জীবনে ভারতে এবং বাইরে অনেক বিদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একজন মানুষ। তাঁর মতো মানুষ আমি ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
মতিউর: দিল্লিতে অবতরণের আগে তিনি কি দিল্লি বা ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছিলেন?
মারওয়া: তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন। তবে এই মুহূর্তে সবকিছু আমি মনে করতে পারছি না।
মতিউর: দিল্লি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর তিনি কি আপনার কাছে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা বা অন্য কোনো ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করেছিলেন?
মারওয়া: এখানে আমাকে অবশ্যই একটা কথা বলতে হবে তা হলো, আমার প্রাথমিক কাজ ছিল দিল্লি পর্যন্ত তাঁকে সঙ্গ দেওয়া। আমার সরকারের চিন্তাও ছিল তা-ই। কিন্তু দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত ব্যাপারটি নির্ভর করছিল বাংলাদেশের ওপর। এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিব আমাকে দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত তাঁর অতিথি হিসেবে যেতে বলেছিলেন। আমি বিমানবন্দরে উপস্থিত উচ্চপদস্থ ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালাম যে শেখ মুজিব আমাকে ঢাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি কি যাব?
মতিউর: আপনি কার কাছে জানতে চেয়েছিলেন?
মারওয়া: পি এন হাকসারের কাছে। তিনি আমাকে যেতে বললেন।
মতিউর: এরপর কি আপনি দিল্লি ফিরেছিলেন?
মারওয়া: হ্যাঁ। দিল্লি ফিরে আমি পি এন হাকসারকে ব্রিফ করি। তিনি আমাকে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। কেননা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল তাঁর (হাকসার) ওপর। বাংলাদেশ ও মুজিবের প্রতি তাঁর অনুভূতি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।
মতিউর: পি এন হাকসার আপনার কাছে আর কী জানতে চেয়েছিলেন?
মারওয়া: আপনার মতো তিনিও আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, শেখ মুজিব পাকিস্তান সম্পর্কে কিছু বলেছেন কি না। আমি তাঁকে জানালাম, না, কিছু বলেননি। এমনকি পাকিস্তানের কোনো নেতা সম্পর্কেও তিনি কিছু বলেননি।
মতিউর: ঢাকায় যাওয়ার সময় দিল্লির সংবর্ধনা সম্পর্কে শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
মারওয়া: তিনি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল খুব ইতিবাচক। কেননা, আমার মনে হয়, দিল্লি সঠিকভাবেই তাঁকে মূল্যায়ন করেছিল। দিল্লির আচরণে এমন কোনো ভাব ছিল না যে বাংলাদেশ নামের নতুন দেশটি তারাই সৃষ্টি করে দিয়েছে। ভারতে শেখ মুজিবকে একটি বিদেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ভারতের অনেক অবদান ছিল, ভারতীয় নেতাদের আচরণে এমনটা মনে হয়নি।
মতিউর: শেখ মুজিব দাবি করেছিলেন, তিনি দুই দেশের সমস্যা বুঝতে পেরেছেন। বিমানে কি তিনি এ ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন?
মারওয়া: হ্যাঁ। তিনি ইমিগ্রেশনসহ কয়েকটি বিষয়ে কথা বলেছিলেন। পি এন হাকসারকে ব্রিফ করার সময়ও আমি দুটো বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। বাংলাদেশের পরিচয় নিয়ে শেখ মুজিব যে কথাগুলো বলেছিলেন, অর্থাৎ বাংলাদেশের বহুস্তরবিশিষ্ট (বাঙালি, মুসলিম ও আঞ্চলিক) পরিচয়ের কথা আমি পি এন হাকসারকে বলেছিলাম।
মতিউর: পরিচয়ের ক্ষেত্রে তিনি বলেছিলেন, বাঙালি একটি পরিচয়। এ ছাড়া আরেকটি পরিচয় হলো মুসলিম।
মারওয়া: ওটা নিয়ে ভারতে বেশ উদ্বেগ ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়ায় অনেকে ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়ে সমস্যা তৈরি করছেন। কেননা, বাঙালি পরিচয়টি খুব বেশি শক্তিশালী হলে পশ্চিমবঙ্গও এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চিন্তা করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটেই পরিচয়ের প্রশ্নটি তখন সামনে চলে এসেছিল।
মতিউর: আর মুসলিম পরিচয়?
মারওয়া: হ্যাঁ, তিনি মুসলিম পরিচয়ের কথাও বলেছিলেন। তাঁর এ কথার মাধ্যমে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগ দিতে পারে বলে যে আশঙ্কা ছিল, তা শেষ হয়ে যায়।
মতিউর: এখনো আপনার সেই সময়কার সুখস্মৃতি রয়েছে?
মারওয়া: হ্যাঁ, আমার সুখস্মৃতি আছে এবং আগেই যেমনটা বলেছি, আমার সারা কর্মজীবনে আমি শেখ মুজিবের মতো মানুষ দেখিনি।
মতিউর: শেখ মুজিবকে হত্যার খবর পাওয়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? আপনি কি তখন দিল্লিতে ছিলেন?
মারওয়া: ওই দিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আমি দিল্লিতেই ছিলাম এবং এই খবর ছিল খুব বেদনাদায়ক। সেদিন আমরা ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। অবশ্যই গোয়েন্দারা শেখ মুজিবকে আগেই জানিয়েছিলেন যে তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তবে মুজিব ছিলেন খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর ধারণা ছিল, বাংলাদেশের কেউ তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে না। ভারত ও অন্যান্য দেশের গোয়েন্দারাও তাঁকে এই ঝুঁকির কথা বলেছিলেন।
মতিউর: হ্যাঁ, আমাদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি তথ্য আছে। এটা হলো কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সানডেতে কে কে রাওয়ের লেখা একটি প্রতিবাদপত্র। ’৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর তৎকালীন প্রধান কে কে রাও শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শুনে মুজিব বলেছিলেন, ‘না না, ওরা আমার সন্তানের মতো।’ তখন তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, আমরা পরে আপনাকে এ ব্যাপারে অগ্রগতি সম্পর্কে জানাব।’ পরে ’৭৫-এর এপ্রিলে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আরও বিস্তারিত জানানো হয়েছিল।
মারওয়া: মুজিবের মৃত্যুসংবাদে ইন্দিরা গান্ধী বেশ অস্থির হয়েছিলেন। কেননা, বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বিশ্বের অনেক নেতাই ওই সময় ইন্দিরা গান্ধীর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর কথা ছিল, শেখ মুজিবকে হত্যা করায় বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।
মতিউর: পরে পি এন হাকসারের সঙ্গে কি আপনার আর দেখা হয়েছিল?
মারওয়া: হ্যাঁ, আরও অনেকবার আমাদের দেখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি।
মতিউর: ১৯৭২ সালের ঢাকার ব্যাপারে আপনার কী অনুভূতি ছিল? আপনি কত দিন ছিলেন।
মারওয়া: ঢাকা তখন ছিল খুব সাধারণ একটা শহরের মতো। তবে কয়েক বছর আগে আমি একবার ঢাকায় গিয়েছিলাম। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখলাম অনেক হোটেল হয়েছে। আগে তো কেবল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলই ছিল।
মতিউর: ধন্যবাদ আপনাকে।
মারওয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।