রাজশাহীর পবার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) উদ্ভাবিত ‘মাটির মায়া’ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। আর যেখান থেকে এই মাটির মায়ার উদ্ভাবন হয়েছিল, সেই পবা উপজেলার গ্রাহকেরা এখন মুঠোফোনে একটি ‘অ্যাপস’ নামিয়ে ঘরে বসেই ভূমিসংক্রান্ত সব সেবা পাচ্ছেন।
তিন বছর আগের কথা। ভূমি অফিস মানেই দালালের আখড়া। সেবাগ্রহীতারা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পর্যন্ত যেতেই পারেন না। তার আগেই দালালের খপ্পরে পড়ে টাকাপয়সা খুইয়ে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকেন। কোনো কোনো অফিসে একটি রেকর্ড খুঁজে বের করতেই দেড়-দুই বছর লেগে যায়। রাজশাহীর পবা উপজেলার ভূমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহাদত হোসেন এক অনন্য উদ্যোগ নেন। তিনি অফিসের নিচে একটি চালাঘর তৈরি করেন। সকালে এসেই সেখানে বসেন। দালালদের জায়গাটি দখল করে নেন তিনি। সেবাগ্রহীতাদের হাতে টোকেন ধরিয়ে দেন। এরপর নাম ধরে ডাকেন। ছোটখাটো বিষয় হলে হাতেনাতে সমাধান করে দেন। না হলে অফিসের নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পাঠান। অথবা তারিখ দিয়ে দেন। এই কাজে নামার আগে তিনি দেড় বছর ধরে নথির সারণি তৈরি করেন, যাতে এক মিনিটের মধ্যে যেকোনো খতিয়ান খুঁজে পাওয়া যায়।
একটি কাজের জন্য এই ভূমি অফিসে এক বছর ঘুরে যে মুক্তিযোদ্ধা সেবা পাননি, বিনা পয়সায় তাৎক্ষণিক সেই সেবা পেয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। অনেক জটিল বিষয়ের তাৎক্ষণিক সেবা পেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাঁর অনুভূতির কথা লিখে গেছেন মন্তব্য খাতায়।
এই ভূমি অফিসের সেবার দৃষ্টান্ত নিয়ে এসি ল্যান্ডের ‘মাটির মায়া’ শিরোনামে ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোতে শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর যেন প্রশাসনের চোখ খুলে যায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সারা দেশের সহকারী কমিশনার (ভূমি), জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কপিসহ চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, পবা উপজেলা ভূমি অফিসের আদলে সব ভূমি অফিসে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যোগ বাস্তবায়নের সময়কালও বেঁধে দেওয়া হয়।
মাটির মায়ার উদ্ভাবক শাহাদত হোসেন বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত। তিনি জানান, সারা দেশে শতাধিক সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে এখন মাটির মায়ার আদলে সেবা কার্যক্রম চলছে।
পবা উপজেলা ভূমি অফিসে শাহাদত হোসেনের উত্তরসূরিরাও বসে নেই। পবার বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ
জানান, সম্প্রতি তাঁরা নতুন একটি ‘অ্যাপ’ যুক্ত করেছেন, যার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা বাড়িতে বসেই আট ধরনের ভূমিসেবা পাচ্ছেন। তাঁদের স্লোগান হচ্ছে ‘এসি-ল্যান্ড ইন পিপল’স পকেট’ (জনতার পকেটে এসি ল্যান্ড)। এই অ্যাপের মাধ্যমে এই অফিসে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সেবাগ্রহীতারা বাড়িতে বসেই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারছেন।
শাহাদত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ওই সময় পবাতে সেবা সহজ করার একটা মডেল দাঁড়িয়ে যায়। তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদ সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আজ আমাদের নতুন প্রজন্মের সহকারী কমিশনাররা ‘মাটির মায়া’র উদ্দীপনায় ভূমিসেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে যেতে একের পর এক অসাধারণ সব কাজ করে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখি এই নবীনদের হাত ধরে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা আরও জনমুখী হবে।’