আমিষের ঘাটতি পূরণে পোলট্রির নাম করতেই হবে : কাজী জাহেদুল হাসান
>
পোলট্রি খাতে দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী কাজী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান। নিজের কার্যালয়ে বসে অকপটে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সাফল্যের কাহিনি। বলেছেন পোলট্রি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা, সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম।
প্রথম আলো: পোলট্রি খাতের ব্যবসায় কোন আগ্রহে এসেছিলেন?
কাজী জাহেদুল হাসান: প্রায় দুই যুগ আগের কথা। ১৯৯৫ সালে দিল্লিতে ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে আমিও যোগ দিই। পোলট্রির সবকিছু নিয়ে সেখানে প্রদর্শনী হয়। পোলট্রির সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত হই সেখানে। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ভারতের বড় কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। দেখি যে আমাদের দেশে শিল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে মুনাফা ভালো। দেশে ফিরে চোখ বুজে জমানো ১৫ লাখ টাকা নিয়ে এই ব্যবসায় নেমে পড়ি।
প্রথম আলো: যদি আরেকটু খুলে বলতেন…
কাজী জাহেদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্থাপত্যবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ফিরে এসে বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছি। মধ্যে সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন অনুষদে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই যে দেশে ফিরলাম, আর বিদেশ করতে মন চাইল না। শুরুতে বন্ধুদের পরামর্শে তৈরি পোশাকের ব্যবসায় হাত দিলেও একপর্যায়ে তা বন্ধ করে দিই। ভারতের দিল্লিতে পোলট্রি নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনই সবকিছু বদলে দিল। সিদ্ধান্ত নিই ব্যবসা করব পোলট্রি খাতেরই। এভাবেই শুরু।
প্রথম আলো: পোলট্রি তো আমাদের দেশে আমিষের চাহিদা বেশ ভালোই পূরণ করেছে।
কাজী জাহেদ: বটেই। চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ আছি। কিন্তু আমিষে আমরা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। আমিষের ঘাটতি পূরণে গরু, ছাগল, ভেড়া বা মাছ যতখানি অবদান রাখছে, তুলনা করলে পোলট্রির নাম উল্লেখ করতেই হবে। এই শিল্প এখন ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের বাজার। মাছ উৎপাদনে আমরা খুব ভালো করেছি। কিন্তু প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে যাচ্ছে। গরু-ছাগলের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও ধীরগতির। সে তুলনায় ভালো জায়গায় আছে পোলট্রি।
প্রথম আলো: সামগ্রিকভাবে পোলট্রি খাতের পরিস্থিতি কেমন?
কাজী জাহেদ: আমি বলব, ভালো। কারণ ব্রিডিং, এগিং, ব্রয়লার, লেয়ারে এ খাতের ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড এখন আমাদের পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ করছে। দেশীয় বড় বড় কোম্পানিও এ খাতে আসছে, যাদের আর্থিক ভিত্তি ভালো। আগে মুনাফা বেশি ছিল, এখন প্রতিযোগিতা বেশি। আবার মাঝেমধ্যে এমন সময়ও আসে, যখন এ খাতে ব্যবসার বেশ মন্দা চলে। কোনো কারণে চাহিদা কমে গেলে বা সরবরাহ বেড়ে গেলে বাজার স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। ব্রয়লারে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে বাজার সংশোধন হলেও লেয়ারে সময় লাগে দুই থেতে তিন বছর। এটা একটা চক্র হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: পোলট্রি খাদ্য নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এর সংকট নিয়ে কিছু বলবেন?
কাজী জাহেদ: ফাঁকে সহজ শর্তে ঋণ চালু করায় পোলট্রি খাদ্যটাও ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। পোলট্রি খাদ্যের উপকরণ হিসেবে বাড়তে থাকল ভুট্টার চাষ। বলা যায়, ভুট্টা চাষে রীতিমতো বিপ্লব হয়ে গেল, যা প্রায় ছিলই না। এতে চাষিরা লাভবান হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। বর্জ্য দিয়ে পোলট্রি খাদ্য তৈরি কেউ কেউ করছে। তারা নামহীন। বিষয়টি রোধে সরকারের উচিত অভিযান চালানো। তাদেরই অনেকে পোলট্রি খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশেই একসময় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এখন সব দেশেই নিষিদ্ধ।
প্রথম আলো: এ খাতে এখন বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী?
কাজী জাহেদ: প্রধান সমস্যা এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস। ছোট ফার্মগুলোতে এটি বেশি দেখা দেয়। ভাইরাস আছে দুই ধরনের। একটাতে অনেক মুরগি মারা যায়। অন্যটাতে মুরগি বেশি মারা যায় না, তবে মুরগির বৃদ্ধি কমে যায়, ডিম দেওয়াও কমে যায়। ব্রিডিং ও এগিং মোটামুটি ভালো কাঠামোতে দাঁড়িয়ে গেলেও ছোট খামারিদের ব্রয়লার এখনো তা পারেনি। কারণও আছে। মুরগির দামের খুব ওঠানামা হয়। আর কোরবানির ঈদের পর অনেক দিন মুরগি বিক্রি হয় না। মানুষের একটা প্রবণতা হচ্ছে দেড় কেজি আকারের জীবন্ত মুরগি কেনা। মুরগির খাদ্যের কাঁচামাল একটা বড় সমস্যা। অগ্রিম আয়করের পাশাপাশি নতুন করে এবার অগ্রিম কর চাপানো হয়েছে। অন্যদিকে খামারিরা লোকসানের মুখে পড়লেও মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই লাভ করে নিচ্ছে।
প্রথম আলো: এসব সমস্যা থেকে বেরোনোর জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
কাজী জাহেদ: ভালো খবর হলো এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস ঠেকাতে গত সপ্তাহেই পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। জমির সমস্যা হচ্ছে এ খাতের বড় সমস্যা। পোলট্রির জন্য জমিও লাগে বেশি। অন্যদিকে ভারতের তুলনায় আমাদের জমির দাম বেশি। অকৃষিজমি খুঁজে বের করতে হয়। কারণ, সরকারের নতুন আদেশ জারি হয়েছে, প্রতিষ্ঠানকে জমি কিনতে হবে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে। খামারের জন্য জমি কেনার শর্তও শিথিল করলে সুবিধা হয়। ছোট খামারিরা তো সামান্য কিছু হলেও সমস্যায় পড়ে যান, তাই তাঁদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। ছোট খামারিদের স্বার্থে এমন বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিতে না পারে। এমন ল্যাব থাকতে হবে, যেখানকার পরীক্ষার ফলাফল অন্য দেশগুলো গ্রহণ করবে। এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস যেহেতু মুরগি থেকে মানুষেও ছড়ায়, তাই জীবন্ত মুরগি কেনার অভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে শহরের বাজারে জীবন্ত মুরগি আসতে দেওয়া হয় না। খামার এলাকায় জবাই করে মাংস নিয়ে আসা হয় শহরে। আমাদের দেশে এটা এখনো হয়নি।
প্রথম আলো: এ খাতে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন দেখছেন আপনি?
কাজী জাহেদ: আশার কথা হলো, পোশাক খাতের অনেক ব্যবসায়ী এ খাতে আসছেন। এতে পোলট্রি খাতে উৎপাদন বাড়বে। আর চাহিদা ও সরবরাহতত্ত্বের কারণে তখন দাম কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রাক্বলন হচ্ছে, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পোলট্রি খাতে অনেক ভালো করবে, এই খাত থেকে মোটা অঙ্কের রপ্তানি হবে।