>
অভিনয়ের অ জানতেন না জয়া আহসান, যখন তিনি অভিনয় শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে সেই জয়া অভিনয়ের নিজস্ব এক মুদ্রা রচনা করেছেন। তাঁর নিচু লয়ের অভিনয়ের সুনাম পেরিয়ে গেছে দেশের সীমানা। স্বীকৃতি মিলেছে দেশে–বিদেশে। অভিনয়ের পর সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন চলচ্চিত্র–প্রযোজনায়। তাঁর প্রযোজিত দেবী ছবিটিও দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। এ অব্দি পৌঁছাতে কঠিন এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে জয়াকে, কিন্তু নিশানা আর সংকল্প হারাননি কখনো। সাজ্জাদ শরিফকে খোলাখুলি বলেছেন তাঁর কল্পনা, সংগ্রাম আর অভিনয়ের রহস্যের কথা।
সাজ্জাদ শরিফ: আপনার অভিনয় বিশেষভাবে চোখে পড়ার দিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের বন্ধু চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আমাকে ফোন করে বললেন, ‘সাজ্জাদ, কামরুজ্জামান কামুর স্ক্রিপ্টরাইটার কি দেখেছেন? কী দারুণ নাটক। জয়ার অভিনয়ের তো তুলনা নেই।’ নাটকটা সংগ্রহ করে দেখলাম। দেখে তো আমি স্তব্ধ। গর্ভবতী একটি মেয়ের চরিত্রে কী অনুচ্চ, কী স্বচ্ছন্দ অভিনয় আপনার! অথচ একটা সিগারেটের বিজ্ঞাপনে কী কাঁচা ছিল আপনার প্রথম অভিনয়!
জয়া আহসান: যখন শুরু করেছিলাম, তখন তো আমি কিছুই বুঝি না। অভিনয় কী, বিজ্ঞাপন কী—এটা সিগারেটের, না লিপস্টিকের বিজ্ঞাপন—ঠিকমতো কিছু বুঝিওনি। ‘ভালো একটা বিজ্ঞাপন হবে, ’ বলে মিমি আপা আমাকে নিয়ে এসেছেন। কাজটা ছিল আফসানা মিমি আপা আর টনি ডায়েসের। আমি বেশ সমালোচিত হলাম। আমার যাত্রা শুরু সেখান থেকে। এরপর টুকটাক কিছু কাজ করেছি। সেভাবে বলতে গেলে আফজাল হোসেনের একটি নাটক করেছি, ছবির মতো মেয়ে।
সাজ্জাদ: আপনি কখন টের পেলেন যে আপনি অভিনয় করতে চান?
জয়া: আমি কিন্তু কখনো অভিনয় করব ভাবিনি, অভিনয় করতে চাইনি। আমি যেটা সব সময় চেয়েছি, সেটা হলো মুক্তি। মানুষ তো তার কাজের মাধ্যমে মুক্তি পায়। নিজেকে খুঁজেও পায়। এটা–সেটা কত কী আমি করেছি। দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকা পিংপং বলের মতো এখানে ঠকেছি, সেখানে ঘা খেয়েছি। কিন্তু নিজেকে খুঁজে পাইনি। অবশেষে অভিনয়ে এসে নিজেকে আমি খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম, এটাই আমার জায়গা। একজন ব্যাটসম্যান যখন পিচে থাকে, চারদিকে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু তার চোখে কিছু ঠেকে না, কানে কিছু ঢোকে না। ওর পুরো মন বলটার ওপর স্থির। তার সব উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু তো ওইটাই।
সাজ্জাদ: অভিনয়ে আপনার শুরুর সময়টা নিয়ে একটু বলুন। অভিনয়টাই কেন আপনি নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন?
জয়া: একটা মেয়ে হিসেবে আমার চলা, সংসারজীবনে ঢুকলাম কিন্তু ছন্দপতন হয়ে গেল—এ রকম নানা সংকটে পড়ে গেলাম। আমি নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা খুঁজছিলাম, মুক্তির একটা জায়গা। মানুষ এ সময় নেশা করে, নানা কিছুর ভেতরে ডুব দেয়, একটা অবলম্বন খোঁজে। উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমি অভিনয়কে আঁকড়ে ধরেছিলাম। অভিনয়টা আমার তখনো তেমন হতো না। তবু একনাগাড়ে আমি কাজ করে গেছি। করতে করতে কখন যে আমার অভিনয়ের ধাত বদলাতে শুরু করেছে, আমি নিজেও সেটা বলতে পারব না। শুরু করেছিলাম খুবই এলেবেলেভাবে। ডানে তাকাতে বললে ডানে তাকাতাম। মুখে একগাদা মেকআপ চাপিয়ে বসে থাকতাম। দিন যত যেতে লাগল আমি বুঝতে আরম্ভ করলাম, কোন বিষয়টা আমি করব, কোনটা করব না। ধীরে ধীরে অভিনয়ের আসল মজাটা পেতে শুরু করলাম। অভিনয়ের আনন্দটা নিতে শুরু করলাম। আমার জীবনের পাশাপাশি এটা যে আলাদা একটা যাত্রা, সেটা বুঝতে পারলাম। অভিনয় তো শুধু কাজ নয় আমার কাছে, আমার মানসিক মুক্তি।
সাজ্জাদ: বাংলাদেশে তো অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে, বিশেষ করে সিনেমায় ভালো কাজের পরিসর খুব ছোট। টেলিভিশনের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ যাঁরা করেছেন, ঘটনাচক্রে তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই আপনি কাজ করেছেন, তাঁদের বহু সেরা প্রযোজনায়। এত ছোট পরিসরের মধ্যেও কীভাবে সেই কাজগুলো আপনার হাতে এল? গ্ল্যামারের চলতি পথ ছেড়ে বিকল্প পথের দিকে যাওয়াটা কীভাবে সম্ভবপর হলো?
জয়া: এটাই আমি আসলে চাইতে শুরু করেছিলাম। জনপ্রিয়তার রাস্তায় সত্যিই আমি হাঁটতে চাইনি। আলাদা হতেই চেয়েছিলাম। গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম নিজের একটা পরিচয়। এখন বলতে পারি, আমি এটা চেয়েছি, এটাই পেয়েছি। আমার বিকশিত হওয়ার সময়ে কাদের সঙ্গে চলাফেরা করেছি, মেলামেশা করেছি? নূরুল আলম আতিক, মেজবাউর রহমান সুমন, অমিতাভ রেজা—এরাই তো আমার বন্ধু ছিল।
সাজ্জাদ: আপনার শুরুটা ছিল অতি সাধারণ, কিন্তু সে জায়গাটা আপনি দারুণভাবে পার হয়ে এলেন। বাংলাদেশের তো সব সময় অভিনয় করার মতো চরিত্র পাওয়া যায় না। নিজের অভিনয়ের দিকে তাকানো, অভিনয় যে একটা সৃষ্টিশীল বিষয়, একটা শিল্পকর্ম, প্রত্যেকটা চরিত্র যে এখানে আলাদা আলাদাভাবে গড়ে নিতে হয়—এই উপলব্ধিটা কখন প্রথম আপনার মধ্যে এল? তরুণ এই নির্মাতাদের সাহচর্য আপনাকে সাহায্য করল কীভাবে?
জয়া: এরাই আমার বন্ধু ছিল। এদের সঙ্গেই আমি মিশেছি। গ্ল্যামারের প্রতি আমার আগ্রহ তো ছিলই না, বিশ্বাসও ছিল না। ওদের সঙ্গে আড্ডা, আমার বই পড়া, বাইরের ছবি দেখা—এসব হয়তো চলচ্চিত্র মাধ্যমটাকে বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছে। আগে যে অনেক ছবি দেখতাম, তা কিন্তু নয়। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের সংশয় করার পর মজা পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম, অভিনয় মানে শুধু এভাবে তাকানো আর ওভাবে সংলাপ দেওয়া নয়। অভিনয় মানে নিজেকে একটি চরিত্রের মধ্যে বসানো। চরিত্রের দিকে বা অভিনেত্রী হিসেবে নিজের দিকে তাকানোর সূচনাটা হয়েছিল সেখান থেকে। এই যে একটা আনন্দ, এটা আমাকে আরেকটা যাত্রাপথের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় কাজ করলাম। আতিক আমাকে নিল তার পলায়নপর্ব–এ। এভাবে আমি পরিচালকের শিল্পী হয়ে উঠতে লাগলাম। মানে ওরা ঠিক যেভাবে চরিত্রটাকে চায়, সেভাবে সংযোগ গড়ে উঠতে লাগল। চলতি ঘরানার সফল নির্মাতাদের কাছ থেকে আমি দূরে দূরে থাকতাম। আমি দেখলাম, আমার বন্ধুদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছি। ওরাই ছিল আমার সহকর্মী। এভাবেই আমার রুচি, ভাবনা, ভালো লাগা, চোখের দেখা, অভ্যস্ততা নতুন করে গড়ে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি কী চাই, আমার কী হওয়া উচিত।
সাজ্জাদ: অভিনয়ে কোনো আদর্শ ছিল আপনার? এই যে অভিনয় না করে চরিত্রটার মতো আচরণ করতে হবে—অভিনয় থেকে আচরণের দিকে আপনি এলেন কী করে?
চরিত্র করার সময় একটা ভাবনাই আমার মধ্যে কাজ করে, আর সবাই হলে যা করত আমি সেটা করব না। যত বড় অভিনেতাই কেউ হোন না কেন, তার পথ আমি মাড়াব না।জয়া: আমার নিজের ভেতর থেকেই এ উপলব্ধিটা জেগে উঠেছিল যে অভিনয় করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র–বোদ্ধারা বলে, আমারটা নাকি ‘স্বাভাবিক অভিনয়’। এটাই আমার পছন্দ। কোনো চরিত্র পেলে আমি একটু বেশি সময় নিতে চাই। চরিত্রটা আয়ত্তে আনার জন্য প্রথমেই চিত্রনাট্যটা ভালো করে পড়ে ফেলি। শুটিংয়ের সময় যদি শুধু আমার চিত্রনাট্যটা আপনি দেখতেন। ভাঁজ করা, দোমড়ানো–মোচড়ানো, হলুদের দাগ লাগানো। ছবি মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেটা ফেলিই না। না–ও যদি পড়ি, বালিশের পাশে রেখে দিই, কাছে নিয়ে ঘুমাই। অগোচরেই এটার সঙ্গে সংসার করতে শুরু করি। চরিত্র করার সময় একটা ভাবনাই আমার মধ্যে কাজ করে, আর সবাই হলে যা করত, আমি সেটা করব না। যত বড় অভিনেতাই কেউ হোন না কেন, তার পথ এখানে আমি মাড়াব না। মনে হতে পারে আমি নাকউঁচু, কিন্তু এটাই আমার গোপন মন্ত্র। ছবির গল্পটা যে জায়গাটায় ডালপালা মেলবে, সে জায়গার অনুভবটা আমার জন্য জরুরি। আমি চেষ্টা করি শুটিংয়ের আগে কোনোভাবে স্পটে যেতে পারি কি না। এভাবে ধীরে ধীরে বিশ্বাসযোগ্যতাটা গড়ে ওঠে। আরেকটা ব্যাপার কী, অনেক প্রস্তুতি নিয়ে হয়তো ক্যামেরার সামনে গেলাম, তারপর দেখা গেল অন্য একটা জিনিস করে দিয়ে এসেছি। যদি সেটা লেগে যায় সম্পাদনার সময় দেখে ভাবি, সত্যি সত্যিই কি আমি এটা করেছি?
সাজ্জাদ: যে রকম কাজ আপনি করতে চান, সে রকম কাজ যে অনেক হয়, তা তো নয়। পেশার কথা বলুন আর সৃষ্টিশীলতার কথা বলুন, আপনাকে কি হতাশা গ্রাস করেনি?
জয়া: না, খুব বেশি পাই না তো সে রকম চরিত্র। কলকাতার ছবিও যে আমাকে উত্তেজিত করে, তা–ও নয়। কিন্তু এটাই তো আমার জীবিকা। দিন শেষে নিজেকে চালাতে হয়, সংসার চালাতে হয়। তাই মানুষ যেমন বাধ্য হয়ে পোঁটলা–পুঁটলি বেঁধে দুবাই যায়, আমিও সে রকম কলকাতায় যাই। তবে সব সময়ই আমার মনে হয়, বাংলাদেশে কাজ করতে পারলেই অনেক ভালো হতো। আমি যদি ডুবসাঁতার–এর মতো আরও কাজ করতে পারতাম। বাংলাদেশে যদি আরও কয়েকজন ভালো নির্মাতা থাকতেন। সব ভালো নির্মাতাই যে আমাকে নেবেন, তা তো নয়। সবার বা সব চরিত্রের জন্য আমাকে প্রয়োজনও হবে না। কিন্তু আমি চাই সেরা কাজটা নিজের দেশে করতে। এটা তো আমারই দেশ, তাই না?
সাজ্জাদ: পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রথম প্রস্তাবটা কীভাবে পেয়েছিলেন?
জয়া: চৈতা পাগল নামে একটা ধারাবাহিক নাটক করছিলাম। তখন আমার সংসার ভেঙে গেছে। টাকাপয়সার প্রচণ্ড সংকট। বাসা থেকে বসুন্ধরার গেট পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতাম পাঁচ টাকা ভাড়া বাঁচানোর জন্য। এত কষ্ট, তবু আমি ধারাবাহিক নাটক করব না, একক নাটকই করব। যেসব নির্মাতার প্রতি বিশ্বাস আছে, তাদের বাইরে কাজ করবই না। এটা যে নাকউঁচু মানসিকতা থেকে করেছি, তা কিন্তু না। আমার ভেতরেই এটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে আমি পারি না। সেই প্রথম ইচ্ছার বিরুদ্ধে চৈতা পাগল নাটকটা করলাম, স্রেফ টাকার জন্য। তখন তো আমি ‘নাই টাকায়’ কাজ করতাম। স্ট্রাগলিং একেকজন নির্মাতা আসত। ওই বেচারাদেরই ঠিক নেই। কষ্টেসৃষ্টে কাজ করে দিতাম ওদের। দেখেছি, কঠিনভাবে সেটা আমি পারছি। এটা আমার কী যে একটা শক্তি। এখনো আমি এটা পারি। আমি যদি মনে করি, টাকা আমার দরকার, সেটা আমি করব। সে ব্যাপারটা আলাদা। কিন্তু শুধু টাকার জন্য কাজ করা, ওভাবে কখনো আমি কাজ করিনি।
সাজ্জাদ: বাংলাদেশের চৈতা পাগল কলকাতায় আপনাকে সুযোগ করে দিল কী করে?
জয়া: নাটকটা ছিল মাহফুজ আহমেদের, নোয়াখালীর ভাষায় করা। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সে সময় একদিন আমার কাছে অরিন্দম শীলের ফোন এল। ভদ্রলোক বললেন, ‘ভারত থেকে ফোন করছি।’ অরিন্দম শীলকে আমি চিনতাম না। ভাবলাম, কলকাতার ওরা তো আমাদের নাটক দেখে। কেউ হয়তো এমনিতেই বিরক্ত করার জন্য ফোন করছে। বললাম, ‘হ্যাঁ, বলুন, কী ব্যাপার?’ পর পর দুদিন ফোন করলেন। শেষমেশ বললেন, ‘আমার নাম অরিন্দম শীল। এক আকাশের নিচে নামে আমার একটা সিরিয়াল আছে। তুমি একটু গুগল করে দেখো।’ খবর নিয়ে দেখি, আরে, আমার মায়েরা তো খুবই দেখে ওই সিরিয়ালটা। এবার আমি ভদ্রভাবে কথা বললাম। আলাপ হলো তাঁর ডেব্যু ফিল্ম নিয়ে। জানালেন, সত্যজিৎ রায়ের পাঁচটা চরিত্র মিশেল করে তিনি একটা ছবি করছেন। চারুলতা চরিত্রটির জন্য আমার মতো একটা মুখ চাই। জানতে চাইলেন, দেখা করা যাবে কি না। কলকাতা থেকে প্রথম প্রস্তাবটা এল এভাবে।
সাজ্জাদ: অরিন্দম শীলের ছবি আপনি করলেন। তাঁর প্রথম, আপনারও। তারপর ওখানকার প্রভাবশালী প্রায় সব পরিচালকের ছবিই আপনি একে একে করলেন। আপনার প্রতি তাঁরা আগ্রহী হলেন কীভাবে?
জয়া: অরিন্দম শীলের ছবিতে আমার অভিনয় তাঁদের মনের কোথাও লেগেছিল। কৌশিক গাঙ্গুলির সঙ্গে এ ছবিতে আমি পর্দা শেয়ার করেছি। তিনি আমার ভাইয়ের চরিত্র করছেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায় সেটে এসে বসে থাকত। একটা নতুন মেয়ে এসেছে, চেহারাটা অন্য রকম। তারপর আমার কাছে অনেক প্রস্তাব এল। কিন্তু দেখতে পেলাম, একই চরিত্রের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিংবা আমার সেখানে কিছু করার নেই। ছবিগুলো তাই আমি করিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথাগত নায়িকাদের মতো আমি হতে চাইনি। আস্তে আস্তে সবাই বুঝে গেলেন, ঠিকঠাক চরিত্র না দিলে ও করবে না।
সাজ্জাদ: অরিন্দম শীলের আবর্ত–এ তো আপনি পুরস্কার পেয়ে গেলেন।
জয়া: হ্যাঁ, আবর্ত কলকাতায় আমার প্রথম কাজ। এরপর সৃজিতের রাজকাহিনীতে পেলাম ছোট্ট একটা চরিত্র। প্রথমে আমি সেটা করতে চাইনি, বাংলাদেশের দর্শকেরা নিতে পারবে না ভেবে। কারণ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বিরাট তারকা এবং তিনিই মূল চরিত্রে। আমার চরিত্রটা দ্বিতীয়। সৃজিত এসে অনেক করে বলল, তুমি করো। পরে সেটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। ভাবলাম, ছোট্ট এই চরিত্রেই নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করব। এরপর থেকে তেমন আর কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িনি। আমি একবার বলেছিলাম, কলকাতার কোনো কাজই আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। কৌশিক গাঙ্গুলি পড়েছিলেন সেটা পত্রিকায়। একদিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘জয়া, এত বড় কথা তুমি বলতে পারলে আমাদের পরিচালকদের? তোমাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে।’ তিনি আমাকে বিসর্জন–এ অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন।
সাজ্জাদ: আপনি তো সেখানে বাংলাদেশের শুভেচ্ছাদূতই হয়ে উঠলেন প্রায়। দেখলাম একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলছেন, বাংলাদেশের বড় লেখক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ শুধু হাসান আজিজুল হক আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেই চেনে। পরে যে শহীদুল জহির বা শাহাদুজ্জামানরা এসেছেন, তাদের খোঁজ তারা রাখে না।
জয়া: সেটা তো আমাকে করতেই হবে। শ্রীজাত, অনুপম রায়, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীদের সঙ্গে প্রায়ই তো আড্ডা হয়। আমি ওদের বলি, বাংলাদেশের খোঁজ তো তোমরা রাখো না। ওদের উপহার দেওয়ার জন্য এখান থেকে প্রচুর বই নিয়ে যাই।
সাজ্জাদ: আপনি বললেন, নায়িকা না হয়ে আপনি অভিনেত্রীই হতে চেয়েছেন। গ্ল্যামারের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একাত্ম হতে চেয়েছেন চরিত্রের সঙ্গে। এরপরও কিন্তু গ্ল্যামার আপনাকে ছাড়েনি। সুঅভিনেত্রী হিসেবে আপনি যেমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, একইভাবে গ্ল্যামারগার্ল হিসেবেও। পরস্পরবিরোধী এই বিষয় দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রাখলেন কী করে?
জয়া: সব সময় কিন্তু আমি মনন আর সৃষ্টিশীলতাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি। প্রকৃতি হয়তো আমাকে নাকের জায়গায় নাকটা দিয়েছে, চোখের জায়গায় চোখ। এগুলো তো উপরি পাওনা। এসব কাজে দেয় নিশ্চয়ই, কিন্তু এটাকে কখনো আমি বড় করে দেখিনি। তারকারা সাধারণত যা করে থাকে—একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা, মিষ্টি মিষ্টি প্রেম—সে রকম আমি করতে চাইনি কখনো। আমি সব সময় বুঝে কাজ করতে চেয়েছি। এটাই আমার ক্ষেত্র, এটাই আমার স্ট্র্যাটেজি, এটাই আমি করতে চেয়েছি। গ্ল্যামারের মতো অন্য ব্যাপারগুলো তো এমনিতেই আসে। অভিনয়কে আমি খুব স্বাভাবিক একটা কাঠামোর ভেতরে নিয়ে নিয়েছি। এর জন্য আমি আলাদা করে কোনো চাপ নিই না। আমার ভেতরটায় যা আছে, সেটাকেই আমি বের করে দিতে চাই। আমার নিজের ভেতর যে প্রাণশক্তি আছে, সেটাকে ছড়িয়ে দিতে দিতে আমি যাই। অভিনয় আমার কাছে প্রাণশক্তি মুক্ত করে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া।
সাজ্জাদ: সবাই কাজের প্রতি আপনার নিষ্ঠার কথা বলেন। শুনেছি, বিউটি সার্কাস–এ নাকি আপনি প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে সার্কাসশিল্পীর চরিত্রে কাজ করেছেন। আপনার শরীরে নাকি দড়ির কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল। প্রাপ্তি, প্রশংসা, স্বীকৃতি তো আপনার কম হলো না। কোন তাড়না এখনো আপনাকে এ রকম কষ্টকর কাজে যুক্ত করে রাখছে?
জয়া: প্রাপ্তি, স্বীকৃতি—এসব তো কখনো মাথায় থাকে না। কাজের মধ্যে ঢুকলে মনে হয় কাজ করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। কোনো চরিত্র আমাকে চ্যালেঞ্জ করলে সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে আমি আনন্দ পাই।
সাজ্জাদ: এমন কোনো চরিত্র কি আছে যেটা আপনি করতে চেয়েছেন, কিন্তু করা হয়নি?
জয়া: কিছুই আমার করা হয়নি। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছি। মাঝেমধ্যে নিজেকে এমন দুর্ভাগা লাগে। মনে হয়, আমাকে অনেকভাবেই হয়তো কাজে লাগানো যেত। আমি এমন একজনের অপেক্ষায় আছি, যে আমাকে কাজে লাগাবে।
সাজ্জাদ: অবশেষে তো আপনি ছবি প্রযোজনাও করলেন। দেবী এখন চলছে। প্রযোজনায় এলেন কেন? অভিনয়ের বাইরেও চলচ্চিত্রে নিজের জন্য আরেকটা পথ খুলে রাখতে?
জয়া: অভিনয়ে তো একটা পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। মনে হলো, এর পর অভিজ্ঞতার নতুন একটি জায়গায় আমার পা রাখা উচিত। একটা দায়িত্ববোধ থেকেও কাজটা আমি করেছি। আমি কিন্তু ঝকঝকে–তকতকে নাচে–গানে ভরা ফর্মুলা ছবি করতে যাইনি। তা ছাড়া সবার কাছেই হুমায়ূন আহমেদের এ গল্প জানা, চরিত্র চেনা। চেনাজানা গল্প নিয়ে ছবি করা তো আরও কঠিন। খেয়াল করবেন, ছবিটা করার জন্য পরীক্ষিত কারও কাছে না গিয়ে কিন্তু একেবারে নতুন একজন পরিচালককে আমরা কাজটা করতে দিয়েছি। দেবী যে ঘরানার ছবি, সে ধাঁচের ছবিতে আমাদের দর্শকেরা এখনও প্রস্তুত নন। দেখবেন, এ ছবিতে রঙের ব্যবহার অনেক সংযত, পর্দার বড় অংশ বেশির ভাগ সময়ই অন্ধকার। অনেকেই আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এটা আপনি কী করছেন? কিন্তু এ ঝুঁকিটা আমি নিতে চেয়েছি। যে ধরনের ছবিতে বিশ্বাস করি, সেখানে তো আমার নিজের কিছু করার আছে। ছবি এখন থেকে আমি তাই নিয়মিতই করব।
সাজ্জাদ: আপনার তো অনেকটা পথই পাড়ি দেওয়া হলো অভিনয়ে। অভিনয় আপনাকে এমন কী দিয়েছে, যা আপনি অন্য কোথাও পেতেন না?
জয়া: অভিনয় করার সময়টায় নিজের প্রকৃত যে সত্তা, সেটা তো হারিয়ে যায়। যে চরিত্রেই আমি অভিনয় করি—শিউলি বা বিলকিস—এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্বাস করি। এদের ভেতরে আমি নতুন করে জন্ম নিই। আমার একটা জীবনে আমি বহু মানুষের জীবনে বেঁচেছি। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, অভিনয়ে না এলে আর কোথাও সেটা পেতাম না।
উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনবার
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, গেরিলা, বাংলাদেশ (২০১১)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, চোরাবালি, বাংলাদেশ (২০১২)
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, জিরো ডিগ্রি, বাংলাদেশ (২০১৫)
মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ছয়বার
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী), গেরিলা, বাংলাদেশ (২০১১)
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী), চোরাবালি, বাংলাদেশ (২০১২)
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী), পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী, বাংলাদেশ (২০১৩)
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী), হাটকুরা (নাটক) বাংলাদেশ (২০০৬)
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী), তারপরেও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে (নাটক) বাংলাদেশ (২০০৯)
শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী), চৈতা পাগল (নাটক) বাংলাদেশ (২০১১)
ভারতে পাওয়া পুরস্কার
শ্রেষ্ঠ নবীন অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে মনোনয়ন: আবর্ত (২০১৩)
শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে টেলি সিনে পুরস্কার: রাজকাহিনী (২০১৫)
এবিপি সেরা বাঙালি অভিনেত্রী: সার্বিক অবদানের জন্য (২০১৭)
সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জি সিনে অ্যাওয়ার্ড: বিসর্জন (২০১৭)
সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস: বিসর্জন (২০১৭)
সাজ্জাদ শরিফ, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক