স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা
বঙ্গ অতিশয় প্রাচীন ভূমি। রামায়ণ-মহাভারতের আখ্যানে এর উল্লেখ আছে। হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় একপর্যায়ে এই জনপদের নাম হয়েছে বাংলাদেশ। এর অধিবাসীরা হলেন বাঙালি। বাঙালির আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার স্ফুরণ ঘটে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে। ওই সময় এ অঞ্চলে রাজনৈতিক দল তৈরি হয়, সীমিত আকারে চালু হয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া এবং একই সঙ্গে শুরু হয় উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াই। এটি ছিল সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের শুরুর সময়।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশকে নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ হলে এ অঞ্চলে অন্য রকম এক জাতীয়তাবোধ তৈরি হয়েছিল। এটাই হলো ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’। ১৯১১ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ করা হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা তাঁদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে ভাবনায় পড়ে যান। তখন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ পর্যন্ত আঞ্চলিক ও ধর্মীয় পরিচিতির এক মিশেল থেকে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে। এর একটি প্রকাশ দেখা যায় ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে স্যার জাফরউল্লাহ খানের মুসাবিদা করা প্রস্তাবে, যেখানে তিনটি সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়ে ভারতীয় কনফেডারেশনের কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবটি পাঠ করেছিলেন বাংলার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে (আবুল কাশেম) ফজলুল হক। এই কনফেডারেশনের একটি ইউনিট হওয়ার কথা উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটি নিয়ে, অর্থাৎ বাংলা ও আসাম।
কিন্তু বাঙালি মুসলমান তখন সর্বভারতীয় ইসলামি জোশে আচ্ছন্ন। ওই সময় বাংলার সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দিল্লিতে মুসলিম লীগের এক কনভেনশনে ‘এক পাকিস্তানের’ পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করলে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ভন্ডুল হয়ে যায়। বাংলা মুলুকের বড়-ছোট প্রায় সব নেতা তখন পাকিস্তানের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত রাজনীতির অনিবার্য গন্তব্য হলো ভারতভাগ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তৈরি হলো পাকিস্তান। আধুনিক বিশ্বে ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এটিই প্রথম রাষ্ট্র। দ্বিতীয়টি হলো ইসরায়েল, ১৯৪৮ সালের মে মাসের ১৪ তারিখ।
১৯৪৭ সালের জুন মাসেই শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তখনই সংবাদপত্রে খবর বেরোয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে হবুরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। এর বিরোধিতা করে বেশ কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লেখেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হক, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ এনামুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম প্রমুখ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই পরে এ দেশে গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলন, যার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবোধ তৈরির বীজ বোনা হয়েছিল। সুতরাং বলা চলে, পরবর্তী সময় এ দেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে ধারা তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। সেখান থেকেই শুরু স্বাধিকার ভাবনার। এর একটি সংগঠিত রূপ ছিল ১৯৪৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর জন্ম হওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তাঁরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এতে লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ–এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাশেম ভাষা বিষয়ে একটি প্রস্তাব লেখেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
দুই
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এক দিনে তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যদি একটি দালানের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটি তৈরি করতে অনেকগুলো ইটের দরকার হয়েছিল। এর প্রতিটি ইটের পেছনে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। অশ্রু, ঘাম, মেধা ও রক্ত; অনেক অনেক মানুষের। রাষ্ট্রভাষার দাবি যদি এর প্রাথমিক ভিত্তি হয়ে থাকে, তাহলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল এর দেয়াল।
১৯৫০ সালের অক্টোবরে ঢাকায় রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের একটি সভায় তৈরি হয় ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন। এর উদ্যোগে ৪-৫ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ঢাকায় সংবিধান বিষয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য পরিপূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল:
১. রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র (ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান)। এর দুটি অংশ থাকবে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।
২. পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
৩. দেশরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে। দেশরক্ষা বাহিনীর দুটি ইউনিট থাকতে হবে, যার একটি থাকবে পূর্ব পাকিস্তানে এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিটি অঞ্চলের দেশরক্ষা বাহিনী সেই অঞ্চলের লোক দিয়েই গঠিত হবে। পূর্ব পাকিস্তনের একটি আঞ্চলিক বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থাকবে। অন্য সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে। প্রদেশের অনুমতি ছাড়া কেন্দ্র কোনো কর ধার্য করতে পারবে না।
স্বায়ত্তশাসনের ফর্মুলা হিসেবে এ প্রস্তাবগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট, প্রাঞ্জল এবং সোজাসাপটা। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান নিয়ে মাতামাতি তখনো চলছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, পাকিস্তানের পূর্বাংশের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে একীভূত করে পশ্চিম পাকিস্তান নাম রাখা হয় ১৯৫৫ সালে। ওই সময় পূর্বাঞ্চলের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মাধ্যমে এটি কার্যকর করা হয়। কিন্তু বাঙালি তরুণ ও অগ্রগণ্য রাজনীতিবিদেরা পূর্ব পাকিস্তান নামটি চালু করে দেন আরও আগে। ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৈরি হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পূর্ব পাকিস্তান নামটি এখানে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। এটাই ইতিহাসের সত্য। পাকিস্তানবাদের নেশা থেকে বাঙালির মুক্ত হতে আরও সময় লেগেছিল।
১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান কৃষক-শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি মিলে তৈরি করে যুক্তফ্রন্ট নামের একটি রাজনৈতিক জোট। জোটের সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ফ্রন্টের জন্য একটি কর্মসূচি তৈরির দরকার পড়ে। ওই সময় আওয়ামী লীগের একটি ৪২ দফা কর্মসূচি ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর আহমদ অনেকগুলো দফা যোগ-বিয়োগ করে তৈরি করেন ২১ দফা। এর ১৯ নম্বর দফায় বলা হলো:
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ব বাংলার সরকারের হাতে আনা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে। দলীয় সরকারের অধীনে এটাই ছিল এ দেশের প্রথম অবাধ নির্বাচন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা একচেটিয়া জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের হাতে প্রদেশের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জল ঘোলা হয় অনেক। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে ‘সংখ্যাসাম্য’ নীতি বাস্তবায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি হারায়।
তত দিনে পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর চালকের ভূমিকায় দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সম্মেলনে তিনি কার্যসূচিতে তাঁর একটি প্রস্তাব যুক্ত করার দাবি জানান। অন্যরা রাজি না হওয়ায় তিনি সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করে সাংবাদিকদের কাছে তাঁর প্রস্তাব তুলে ধরেন। এটাই ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট ছয়টি ধারাসংবলিত প্রস্তাব। এটিই ছয় দফা হিসেবে পরে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
এ দেশের রাজনীতিতে দফাভিত্তিক দাবিদাওয়ার চল অনেক দিন ধরে। দফার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো অনেক সময় হারিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল শুধু স্বায়ত্তশাসনকেন্দ্রিক। এটি পরে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ভিত তৈরি করে দেয়। এর পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। তিনি গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা। বাইরে থাকলেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আমেনা বেগম এবং ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। আমেনা বেগম আওয়ামী লীগ অফিস পাহারা দেন এবং সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের তরুণদের নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
১৯৬৮ সালের জুন মাসে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় জড়িয়ে তাঁর রাজনীতি শেষ করে দেওয়ার ফন্দি আঁটে। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দিয়ে গণ–আন্দোলনের সূচনা করেন। ৭-৮ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন ঢাকায় হরতাল হয়। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুটি অংশ এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশ নিয়ে তৈরি হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ডাকসু। তারা তৈরি করেন ১১ দফা কর্মসূচি। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা পুরোপুরি ছিল। তিন মাস তুমুল আন্দোলন হয়। ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকেরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ওই সময় নতুন এক স্লোগান তৈরি হয়, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এই স্লোগানে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় ভবিষ্যতের রূপকল্প—রাষ্ট্রচিন্তা। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ নতুন করে জারি হয় সামরিক শাসন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তত দিনে এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছে—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।
তিন
বাঙালির ঠিকানা খোঁজার লড়াই নতুন মাত্রা পায় ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যানটিন চত্বরে ছাত্রলীগের এক কর্মিসভায়। সেখানে হঠাৎ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমদ স্লোগান দিয়ে ওঠেন, ‘জয় বাংলা’। তাৎক্ষণিকভাবে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অন্যরা অতটা না বুঝলেও কয়েক মাসের ব্যবধানে এটি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীকী স্লোগান। যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল একটি জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা। ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভায় দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেন জয় বাংলা। তত দিনে তিনি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়ায় এবং সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ জয় পায়। এই নির্বাচন ছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্ব এবং ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ ও গড়িমসি করায় পূর্ব পাকিস্তান ফুঁসে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুর থেকে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি আর এ দেশে উচ্চারিত হয়নি। তখন থেকেই এটি বাংলাদেশ। ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন ২৩ বছর আগে শুরু হয়েছিল, তা স্বাধীনতার দাবিতে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে। তখন সব ছাপিয়ে একটি স্লোগানই সবার মুখে মুখে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এই পর্বে ছিল অনেক রহস্য, নাটকীয়তা, ষড়যন্ত্র আর কূটনীতি—যার জট এখনো পুরোটা খোলেনি। এটি ছিল এই জনপদের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাঁকবদলের ক্ষণ। ২৫ দিনের অসহযোগ আন্দোলন, ২৬০ দিনের মুক্তিযুদ্ধ, লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ—এসবের বিনিময়ে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। কিন্তু কীভাবে? কবি মাশুক চৌধুরীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
ইতিহাসের বুকের ওপর
হাজার বছরের পুরোনো একটা পাথর ছিল
সেই পাথর ভেঙে ভেঙে
আমরা ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতা
এই ইতিহাসটুকু আজো লেখা হয়নি।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
তথ্যসূত্র
১. বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, মাওলা ব্রাদার্স;
২. মহিউদ্দিন আহমদ, আমার জীবন আমার রাজনীতি, আগামী প্রকাশনী;
৩. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাবমহল;
৪. মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব: ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক