স্থপতি হব এমন পরিকল্পনা কোনো কালেই ছিল না। ১৯৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। তখনকার দিনে যা হতো—যে বিষয় পাব তা–ই পড়ব, এমনটাই জীবনের লক্ষ্য। পড়াশোনায় আমি খারাপ ছিলাম না। অথচ কোনো এক অজানা কারণে পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হলো না। প্রথম বিভাগ পাই, কিন্তু কোনো বিষয়ে স্টার পেলাম না। তার মানে স্থাপত্য ছাড়া বুয়েটের প্রকৌশল বিষয়গুলোতে ভর্তির জন্যই পরীক্ষা দিতে পারব না ।
স্থাপত্য বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগে গেল। হয় স্থপতি হব, নয় কিছুই না—এমন একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকে গেল। শেষমেশ পরীক্ষায় আমি প্রথম হলাম।
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়। নভেম্বরে কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে আরবানা নামক একটি সংস্থা চালু করি। শুরুর দিনগুলো ছিল ভীষণ কঠিন। ছোট ছোট প্রকল্পে কাজ করি। তার মধ্যে লালমাটিয়ায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণের প্রতিটি ধাপে আমরা জড়িত ছিলাম। মূল চ্যালেঞ্জ ছিল, কী করে আন্তর্জাতিক মানে কাজটা করা যায়। আবার একই সঙ্গে বাংলার স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যও থাকবে।
এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভের নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আরবানার নকশা তাতে জয়ী হয়। আমাদের জন্য এটা বড় ব্যাপার ছিল। ২০০১ পর্যন্ত কাজ চলে। এরপর চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্পের খরচ কমানো, নকশা নতুন করে তৈরির কথা বলা হয়। আমরা রাজি হইনি। একপর্যায়ে আরবানাকে প্রকল্প থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। পরে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবার আমাদের ডাক পড়ে। ১৬ বছর পর স্বাধীনতাস্তম্ভের কাজ শেষ হয়।
আর বাইতুর রউফ মসজিদের গল্পের শুরু ২০০৫ সালে। আমার নানি তখন খুবই অসুস্থ। একদিন আমাকে চায়ের দাওয়াত দিলেন। দুই মেয়েকে পরপর হারিয়ে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। ২০০২ সালে মা মারা যান, পরের বছর এক খালা। আর নানা মারা গেছেন ১৯৭১ সালে। সাত মেয়ে, তিন ছেলেকে প্রায় একা হাতেই মানুষ করেছেন নানি।
তুরাগ নদের ধারে নানার কিছু জমি ছিল। নানি বললেন, এলাকায় ভালো কোনো মসজিদ নেই। তিনি জমি দিতে চান। আমি যেন মসজিদের নকশা করি।
সবাই মিলে জমি নির্বাচন করা হলো। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা মিলাদ পড়িয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর মসজিদের কাজ শুরু করি। সে বছরই নানি মারা গেলেন; ডিসেম্বরে।
জরিপ, নকশা তৈরি, অর্থ জোগাড়ের কাজ চলতে থাকল। সুলতানি আমলের নকশা বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে নকশা হলো। ২০০৮ সালে শুরু হলো মসজিদ নির্মাণের মূল কাজ। সবাই জানত আমার নানি মসজিদের জমি দিয়েছেন। তাই কখনো কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হইনি। ইমাম সাহেব, স্থানীয় লোকজন—সবাই খুব সাহায্য করেছেন।
২০১২ সালে মসজিদের মূল কাজ শেষ হয়। আরও দুই বছর ছোট ছোট কিছু কাজ হয়েছে। মসজিদ হওয়ার পর স্থানীয় ব্যক্তিরা একে পছন্দ করেছেন। পুরস্কার পাওয়ার পর বিদেশিরা এসে মসজিদ দেখেন। স্থানীয় মানুষেরাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। তাঁরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই এখানে আসতে পারেন।
২০১৬ সালে মসজিদের জন্য আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার দেওয়া হলো। তিন বছর পরপর এটি দেওয়া হয়। স্থাপত্যজগতে পুরস্কারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরস্কারের প্রক্রিয়াটা খুবই জটিল। সব কটি ধাপ নিয়ন্ত্রিত হয় আগা খান নেটওয়ার্ক থেকে। বাংলাদেশ থেকে আরও পুরস্কার পায় গাইবান্ধার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। এ ছাড়া চীন, লেবানন, ইরান ও ডেনমার্কের ছয়জন স্থপতি পুরস্কার পান।
এ বছর বাইতুর রউফ মসজিদের জন্য পেলাম জামিল প্রাইজ। দুবাইভিত্তিক আর্ট জামিল সংস্থা ও যুক্তরাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম মিলে পুরস্কারটি দেয়। সাধারণত ইসলামিক ঐতিহ্যের শিল্পকলা ও নকশাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এই প্রথম কোনো স্থাপত্য পুরস্কার পেল।
বাংলাদেশের স্থাপত্য নিয়ে আমার আশা-নৈরাশ্য দুটোই আছে। এ কথা মানতেই হবে, আমাদের কিছু স্থপতি বিশ্বমানের কাজ করছেন। কিন্তু বেশির ভাগই চলছেন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী।
কেন আমাদের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এত কাচঘেরা ভবন হবে? ঠান্ডার দেশে সূর্যের আলোর পূর্ণ ব্যবহারের জন্য সেটা হয়। দেশে এখন এমন ভবন তৈরির ফলে প্রচুর শীতাতপযন্ত্র চালাতে হচ্ছে, বিদ্যুৎ খরচ হয় প্রচুর। স্থাপত্য করার সময় এসব বিষয় ভাবতে হবে। কারণ আজ যা ট্রেন্ডি, পাঁচ-দশ বছর পর তা আর থাকবে না। তখন এসব স্থাপত্য তার আবেদন হারাবে। স্থাপত্য শুধুই দেখার বিষয় নয়, অনুভবের বিষয়।
একনজরে
বাবা: মো. আবদুল হাই, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ
মা: প্রয়াত তাহামিনা হাই, গৃহিণী
জন্ম: ঢাকায়, বেড়ে ওঠা শান্তিনগরে
গুরুত্বপূর্ণ কাজ
স্বাধীনতাস্তম্ভ
বাইতুর রউফ মসজিদ
পানিগ্রাম রিসোর্ট (যশোরে নির্মাণাধীন)
পুরস্কার
আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার (২০১৬)
জামিল পুরস্কার (২০১৮)
অনন্যা শীর্ষ ১০ (২০০৪)
জে কে সিমেন্ট আওয়ার্ড (২০০৪)
মেরিনা তাবাশ্যুম স্থপতি