>
সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ও আয়োজনকে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। শুধু উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আয়োজনেই নয়, তারা যুক্ত হয়েছে চিত্রকলা, প্রকাশনা, চলচ্চিত্র ও স্থাপত্যে। এসব উদ্যোগের পেছনের ভাবনা নিয়ে বলেছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
মা খুব ভালো ছবি আঁকতেন, বিশেষ করে স্কেচ—পাখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিকৃতি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। ১৯৬৫ সালে স্কুলে মায়ের আঁকা নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। ছিলাম আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। স্কুলে প্রদর্শনী করার উপায় ছিল না। হেড স্যারকে গিয়ে বললাম। শুরুতে তিনি রাজি না হলেও পরে কী যেন ভেবে অনুমতি দিলেন। মায়ের ছবি নিয়ে শিক্ষকদের কক্ষে হলো প্রথম প্রদর্শনী। মায়ের আঁকা ছবি দেখে দেখে শৈশব থেকে চিত্রকলার প্রতি আমার ভালোবাসার উন্মেষ।
আমরা যখন শান্তিনগরে থাকি, আমাদের পাশের তিনটি বাড়িতে থাকতেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সংগীতশিল্পী সোহরাব হোসেন ও ফুল মোহাম্মদ। আমার চাচা জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল বড় বড় সব মানুষের। তিনি কখনো কবি জসীমউদ্দীন, কখনো জয়নুল আবেদিনের বাড়িতে গল্প করতে যেতেন। সঙ্গে করে নিয়ে আমাকে। শিল্পাচার্য একটা একটা করে কাগজে ছবি এঁকে নৌকা বানিয়ে দিতেন। আমি সেসব পুকুরে ছেড়ে আসতাম। পুকুরে যেতে-আসতে যেটুকু সময়, ততক্ষণ তাঁরা একান্তে আলাপ করতেন। তাঁর বাড়িতে এন্তার ছবি ছিল। চিত্রকলার প্রতি আমার অনুরাগের জন্ম মূলত সেখান থেকেই।
আব্বা ছিলেন গানপাগল মানুষ। বাড়িতে রাতে কে এল সায়গলের গান বাজত। শুনে অপার্থিব অনুভূতিতে মন ভরে যেত। তবে বিশেষ করে বলতে হবে চিত্রকর আবদুল মুক্তাদিরের কথা। শৈশবে তিনি আমাদের ভালো ভালো গান শোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল দারুণ। ওসব গান আমার ভেতরে সংগীতের প্রতি ভালোবাসার বীজ বুনে দেয়।
স্নাতক শেষ না হতেই আমি টুকটাক ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আমাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায় বেশি দিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারতাম না। মন পড়ে থাকত শিল্পসংস্কৃতিতে। শুরু থেকেই আমার সংস্কৃতির সব শাখায় কাজ করার ইচ্ছে ছিল। স্বাধীনতার পর নতুন একটা দেশ পেয়েছি। কাজের তো শেষ নেই। মনে হলো, সবার আগে দরকার নতুন দেশে মানুষের মন সুন্দর করে গড়ে তোলা। ভাবলাম, মানুষকে তাহলে ভালো ভালো চিত্রকলা দেখাই, গান শোনাই। সেই উপলব্ধি থেকে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। নেমে পড়লাম কাজে।
আমার চাচা আব্দুর রাজ্জাক শিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। রাজ্জাক সাহেবের ফুলার রোডের বাড়ির নিচতলার একটা কামরায় ৬০-৭০টি বড় আকারের ছবি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে সেগুলোর একটি প্রদর্শনী করেছিলাম ঢাকা আর্ট কলেজের সামনের রাস্তায়। ১৯৮৫ সালে সেই প্রদর্শনীটিই নিয়ে যাই গ্যেটে ইনস্টিটিউটে।
১৯৯০ সালে আমরা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করি। ধানমন্ডিতে এর কাজ শুরু হয়। এর প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, পরিচালক কলিম শরাফী। আমাদের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান ‘আবাসন উপদেষ্টা’য় স্থপতি হিসেবে লুভা নাহিদ চৌধুরী যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। সরকারি চাকরি ও স্থপতির কাজ ছেড়ে তিনি বেঙ্গলের দায়িত্ব নেন। বেঙ্গলের আজকের সাফল্যে তাঁর অবদান বিপুল।
মানুষকে মানবিক করে তুলতে শিল্প ও সংস্কৃতির বিকল্প নেই। শিল্পের সব শাখা একত্র করার স্বপ্ন দেখেছিলাম; কারণ, মনে হয়েছিল সেটা করতে পারলে একটা বড় কাজ হয়। মানুষের মূল্যবোধ ও রুচি গড়ে ওঠে, তাদের মন পরিশীলিত হয়। তাতেই তো বিরাট এক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে যায়। আমাদের উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব, চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রকলা প্রদর্শনী, বইয়ের বিপণি ও প্রকৌশলবিদ্যা—এত বিচিত্র উদ্যোগ-আয়োজনের পেছনে এটিই কারণ। বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ এক ভাষায় কথা বলে। কাজটা এখানে করা সহজ।
উৎকৃষ্ট সবকিছু যে এ দেশের মানুষ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে, তার প্রমাণ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। বিশাল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষ রাত জেগে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনেছেন।উৎকৃষ্ট সবকিছু যে এ দেশের মানুষ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেন, তার প্রমাণ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। লোকে নাকি উচ্চাঙ্গসংগীত শোনেন না। অথচ আমরা আনন্দের সঙ্গে দেখেছি, বিশাল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষ রাত জেগে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনছেন। প্রথম বছর শ্রোতা এসেছিলেন ২০ হাজার। পরে এ সংখ্যা পৌঁছেছে ৫০ হাজারে। যে দেশে ১১ ঘণ্টা করে টানা ৫ রাত ৫০ হাজার দর্শক এভাবে উচ্চাঙ্গসংগীত শোনেন, সে দেশের উন্নতি কে ঠেকিয়ে রাখবে? পরিকল্পিত ও নান্দনিকভাবে মানুষকে যুক্ত করার পথ খুলে দিলে, সমবেত তাঁরা হবেনই, এগিয়ে তাঁরা যাবেনই।
উৎসব আয়োজনেই আমরা দায়িত্ব শেষ করিনি। শিল্পী তৈরির জন্য আমরা বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় খুলেছি। ভারত থেকে বিখ্যাত গুরুরা এখানে শেখাতে আসেন। আগামী ৩ বছরের মধ্যে এখান থেকে অন্তত ১০ জন শিল্পী তৈরি হবে। আগামী ১০ বছরে যে ১০০ জন শিল্পী তৈরি হবেন, তাঁরা হবেন দেশের সম্পদ। ওস্তাদ রশিদ খাঁ বলেছেন, ‘মঞ্চের ভয় দূর করতে আমাদের লেগেছে ২০ বছর। ওদের লাগবে ৩ বছর।’
আন্তর্জাতিক মানের বিরাট সব সাংস্কৃতিক আয়োজনের নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেছে ব্লুজ কমিউনিকেশন। বেঙ্গল এক্সপ্রেসের তত্ত্বাবধানে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছি চিরন্তন দেশি খাবার ও মিষ্টি।
আমাদের প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টস ঢাকাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা করেছেন। দেশের সেরা প্রকৌশলীদের পাশাপাশি হার্ভার্ড, বেইজিং ইউনিভার্সিটি, এমআইটির মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা এ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। প্রকল্পটির নাম ঢাকা নেক্সাস। সেটি আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে ঢাকা থেকে এক কোটি লোককে কেরানীগঞ্জ, ত্রিশাল, কাপাসিয়া, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে সুন্দরভাবে স্থানান্তর করা যাবে। তাতে ঢাকা হয়ে উঠতে পারবে আগামী দিনের অনুপম রাজধানী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা করেছেন। দেশের নদীগুলোকে সচল করতে এবং নদীর দুই পারে রাস্তা করতে বলেছেন। এটি একটি অসাধারণ চিন্তা। এসব উদ্যোগ ঢাকার চাপ কমাবে, ঢাকাকে সুশৃঙ্খল করবে। যাতায়াত ও পরিবহনে নদীপথ ব্যবহার করা গেলে সারা দেশ থেকেই চাপ কমবে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে আসতে কম বাধা পেরোতে হয়নি। তবে সমর্থনও পেয়েছি বহু মানুষের। আমার পরিবারের, চাচার বন্ধুবান্ধবের, নিজের বন্ধু-শুভার্থীদের।
আগে একবার বলেছি, শিল্প-সংস্কৃতিতে মন পড়ে থাকায় ব্যবসায় আমি অনেক বড় কিছু করতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, বহু শীর্ষ ব্যবসায়ীর চেয়েও এখন আমি বেশি সুখী, বেশি তৃপ্ত।
উল্লেখযোগ্য কাজ
উদ্যোগ
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস
বেঙ্গল মিউজিক
এস এম সুলতান বেঙ্গল আর্ট কলেজ (নড়াইল)
বেঙ্গল ক্রিয়েশনস (চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা)
জ্ঞান তাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট
বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়
ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টস
বেঙ্গল বই (বই বিপণি ও সমাজকেন্দ্র)
আয়োজন
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উত্সব
জয়নুল জন্মোত্সব
হেনরি ম্যুরের ভাস্কর্যের প্রদর্শনী
ফ্রানসিসকো গয়ার মূল প্রিন্ট প্রদর্শনী
এশিয়ান আর্ট ক্যাম্প
কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার
জীবনানন্দ দাশ-ভূমেন্দ্র গুহ সাহিত্য পুরস্কার
গণেশ হালুই বেঙ্গল গবেষণা পুরস্কার
শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার
আবুল খায়ের বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান