টাঙ্গাইল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লোহজঙ্গ নদের ধারে নিজ গ্রামে বর্ধিষ্ণু খান পরিবারে ১৯৭৪ সালে জন্ম মনিরুল হাসান খানের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মনিরুল।
সেকালে টাঙ্গাইল শহরের আশপাশের এলাকাগুলোয় প্রচুর গ্রামীণ জীবজন্তু দেখা যেত। পরিবারে ছিল শিকারের ঐতিহ্য। বাবা মোহাম্মদ সা’দত আলী খান বড় ভাইদের সঙ্গে শিকারে বের হলে ছোট্ট মনিরুল শিকার বয়ে আনতে শিকারসঙ্গী হতেন। সেই থেকে তাঁর অবাধ মুক্ত প্রকৃতি আর বন্য প্রাণীর সঙ্গে পরিচয়। মনিরুলের বাবা ব্রিটিশ আমলে কর্মসূত্রে মধুপুরের জঙ্গলে কিছুকাল কাটিয়েছেন। বাবার মুখে মনিরুল শুনেছেন, তখন মধুপুরের জঙ্গলে শুধু স্থানীয় কিছু গারো সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়া খুব একটা জনবসতি ছিল না। বিশাল বিস্তৃত শালবনে ছিল ডোরাকাটা বাঘ, চিতা, সম্বর হরিণ, ময়ূরের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। বাবার মুখে সেই সব বন্য প্রাণী শিকারের কাহিনি শুনে শিহরিত হতেন মনিরুল।
উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে। আমাদের সেরা প্রাকৃতিক অংশগুলো খুব শক্তভাবে রক্ষা করতে হবে। মনিরুলের প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার হাতেখড়ি হয় টাঙ্গাইল মডেল প্রাইমারি স্কুলে। পড়াশোনা বাদে বাদবাকি সময় কাটাতেন আশপাশের গ্রামীণ জঙ্গলে বন্য প্রাণী, বিশেষ গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের দুরন্তপনায়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল থেকে। মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, যেটা কাগমারী কলেজ নামে সমধিক পরিচিত—সেখানে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন মনিরুল। ইতিমধ্যে তাঁর চোখের সামনেই গ্রামীণ জঙ্গলের ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পান। জঙ্গলগুলো কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে। শিয়াল, বাগডাশ, ভাম নিঃশেষ হয়ে আসছে, পাখির সংখ্যা কমে গেছে। ভাবতে থাকেন সামনে কী হবে! থাকবে না কিছুই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তখন থেকেই বন্য প্রাণীর জন্য মমতা জেগে ওঠে মনিরুলের মনে। ভাবতে থাকেন পুনর্বাসনের জন্য কিছু একটা করতে হবে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মনিরুল ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিসর্গ ভালো লেগে যায় তাঁর। অনেক গ্রামের চেয়ে পাখি, জীবজন্তু এখানেই বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার দিনে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে বন্য প্রাণী গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না—অন্তত মনিরুল যতটা আশা করেছিলেন। তবু পাঠক্রমের মাঠকর্মের (ফিল্ডওয়ার্ক) মাধ্যমে দেশের নানা বনজঙ্গল ও বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ পান। মনে গড়ে ওঠে বন্য প্রাণীর প্রতি তীব্র ভালোবাসা—অরণ্য, মাঠ, প্রান্তর, জলাভূমি হয়ে ওঠে নিত্যদিনের আকর্ষণ। তখন থেকে বন্য প্রাণী ও নিসর্গের ছবিও তুলতে শুরু করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়ে মনিরুল যোগ দেন আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনে। কিছুকালের মধ্যেই কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে চলে যান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম কেমব্রিজ। প্রাকৃতিক ইতিহাস পঠন-পাঠন, গবেষণায় এর ঐতিহ্য বিশ্ববিশ্রুত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ‘ডারউইনের অভিযান’ প্রবন্ধটি মনিরুলের খুব ভালো লেগেছিল। সেই মহামতি ডারউইন ছিলেন কেমব্রিজের শিক্ষক—ভাবতেই শিহরিত হন মনিরুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একজন ছিলেন মনিরুলের পূর্বপরিচিত। ডক্টরিয়াল থিসিসের জন্য মনিরুল নির্বাচন করেন সুন্দরবনের বাঘ ও তার প্রতিবেশ সংরক্ষণ। উদ্দেশ্য—এমন একটি প্রাণীর জীবনাচার পর্যবেক্ষণ করা, ঐতিহ্যমণ্ডিত সে প্রাণীটির সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রভাবশালী সম্পর্ক রয়েছে। দেড় বছর সুন্দরবনে ফিল্ডওয়ার্ক করেন। নিবিড়ভাবে পরিচিত হন প্রায় অলৌকিক জোয়ারি বন সুন্দরবন আর তার খ্যাত-কুখ্যাত বাঘের সঙ্গে।
দিনের পর দিন ডিঙিনৌকায় ছোট খালে ঘুরেছেন বাঘের সন্ধানে, সোলায় আকীর্ণ নরম কাদায় খুঁজে বেড়িয়েছেন বাঘের নিশানা। কোথাও মিলেছে সদ্য পায়ের ছাপ, মারা শিকার, মল, গাছ আঁচড়ানোর দাগ, ফেরোমেন লেপা গাছ। খোঁজ নিয়েছেন বাঘের শিকার—হরিণ, শূকর, গুইসাপ, মাছ-কাঁকড়াদের। খোঁজ করেছেন সহশিকারি, কুমির, মেছো বিড়াল, চিতা বিড়ালদের। লক্ষ করেছেন টিকে থাকার সংগ্রামে থাকা পাখপাখালি, সরীসৃপের জীবনাচার, ম্যানগ্রোভের বৈশিষ্ট্য। সেই থেকে বাঘ হয়ে পড়ে ধ্যানজ্ঞান।
বাঘের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুরারোহ পাহাড়ি মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গলে ছুটে যান। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেন একদিকে যেমন অত্যন্ত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে আমাদের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য বন্য প্রাণিসম্পদ, অন্যদিকে কিছু অগম্যপ্রায় গহন অঞ্চলে টিকে আছে কিছু ডোরাকাটা চিতাসহ গাউর, লাল সিঁরো, রাম কুত্তা, সম্বর, ভালুক, এশিয়ান সোনালি বিড়াল, মর্মর বিড়াল, গোলবাহার অজগর, মেঘলা চিতা, পাহাড়ি কাছিমসহ বিশ্বজুড়ে বিপন্ন কিছু প্রাণী।
সিলেটের বনে পর্যবেক্ষণ করেন বানর-নরবানর আর হাওরে পরিযায়ী পাখিদের। মাঠকর্মের সঙ্গে এদের নিয়ে বন ও পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন মনিরুল।
২০০৪ সালে ডক্টরেট সম্পন্ন হলে মনিরুল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। এরপর থেকে দেশের যে যে প্রান্তে বন্য প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন, ছুটে যেতে কখনোই গড়িমসি করেননি। সেই খোঁজ আজও চলছে তেমনি নবনবীন উৎসাহে।
২০০৮ সালে নিসর্গ প্রকল্প থেকে প্রকাশিত হয় মনিরুলের বই প্রটেকটেড এরিয়াস অব বাংলাদেশ, এ গাইট টু ওয়াইল্ড লাইফ শীর্ষক সচিত্র বইটি। বাংলাদেশে ছবি সম্পর্কিত বন্য প্রাণী নিয়ে এটাই প্রথম বই। (১৯৮২ সালে দেশবরেণ্য বন্য প্রাণীবিদ ড. রেজা খান একটি সচিত্র চেকলিস্ট প্রকাশ করেছিলেন। বইটি অসাধারণ কিন্তু সাদাকালো ছবি। যেটি কিছুকাল আগে সংস্কার করেছেন তিনি)। তবে বাংলাদেশের বন্য প্রাণী গবেষণায় ড. রেজা খান এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাম। একাধারে মাঠপর্যায়ের গবেষণা, জনসাধারণের বোঝার উপযোগী করে মাঠের খবরাখবর পত্রপত্রিকায় লেখা, সাংবাদিকদের আকৃষ্ট করায় রেজা খান হয়ে আছেন পথিকৃৎ।
বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের দুটি সমৃদ্ধ প্রাণভৌগোলিক এলাকার মধ্যে। এ দেশের গাছপালা, ভূপ্রকৃতি বন্য প্রাণী, তাই ইন্দোহিমালয়ান ও ইন্দোমালয়ান বাস্ত্ততন্ত্রের আদল পেয়েছে। এ দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র, নিচু পাহাড়, আর্দ্র গরম আবহাওয়া প্রাণবিকাশের ও বৈচিত্র্য তৈরির অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ।
এ দেশে চার ধরনের বন দেখা যায়। পাহাড়ি আধা চিরহরিত মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গল (চট্টগ্রাম ও সিলেট), শালবন (মধুপুর, দিনাজপুর, শেরপুর), জোয়ারি বন (সুন্দরবন, চকরিয়া) ও গ্রামীণ জঙ্গল। এই সব বনই এখন মনিরুল এইচ খানের কর্মক্ষেত্র।
২০০৬ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতিতে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা নির্ধারণের চেষ্টা চালান মনিরুল। তাঁর গণনায় বাঘের সংখ্যা হয়েছিল কম-বেশি ২০০।
সাম্প্রতিক গণনায় বাঘের সংখ্যা এসেছে এক শর কিছু বেশি।
বাঘের সংখ্যা কমার বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে মনিরুল বলেন, সুন্দরবনে চোরাই শিকার বেড়েছে। বাঘ-হরিণ দুই-ই এখন শিকারিদের লক্ষ্য। মনিরুল মনে করেন, উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে। আমাদের সেরা প্রাকৃতিক অংশগুলো খুব শক্তভাবে রক্ষা করতে হবে। জলা-জঙ্গলের ধারের জনসাধারণের মধ্যে বন্য প্রাণীর উপকারিতা বোঝাতে হবে। বন্য প্রাণী যে সেবা দেয়, সেটা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
মনিরুল এইচ খান
জীববিজ্ঞানী ও বাঘ বিশেষজ্ঞ
স্বীকৃতি
২০০৭: ফর্কটেল জাইস পুরস্কার
২০০৪: ফিউচার কনসারভেসনিস্ট পুরস্কার (জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন)
২০১৫: বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী সংরক্ষণ পুরস্কার
উল্লেখযোগ্য বই
টাইগারস অব দ্য ম্যানগ্রোভস
এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু ওয়াইল্ড লাইফ অব বাংলাদেশ
চিটাগাং হিলট্রাক্টস—দ্য ল্যান্ড অব ডাইভারসিটি
সুন্দরবনস—দ্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ (প্রকাশিতব্য)
হারিয়ে যাওয়া প্রাণী
এশীয় এক শিংয়ের জাভান গন্ডার, এশীয় দুই শিংয়ের গন্ডার, নীল গাই, বুনো মোষ, গাউর, বারোশিঙা হরিণ, পারা হরিণ, শ্লথ ভালুক, হিসপিড খরগোশ, ছোট শূকর, মালয়ী ইঁদুরে হরিণ, রঙিন বাদুড়, ময়ূর, গোলাপি হাঁস, বাদি হাঁস, ফরেস্ট বিন গুজ।
খসরু চৌধুরী, সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ