শারদীয় শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা
ধর্মীয় উৎসবের দুটি দিক। একটি শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা, প্রার্থনা প্রভৃতি। আরেকটি সামাজিক দিক। শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শুধু ধর্মাবলম্বী ভক্তদের জন্য। কিন্তু উৎসবের সামাজিক–সাংস্কৃতিক দিকটি খুব বড়। সেটা ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবার জন্য।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা হয় শরৎকালে। তাই এর নাম শারদীয় দুর্গোৎসব। শাস্ত্রমতে, এই সময় দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসেন, দশমীর দিন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁর বিদায়।
দুর্ভিক্ষ, মহামারি প্রভৃতি দুর্যোগ মানুষের পৃথিবীতে থাকবেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দুর্গতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেই দুর্গতিনাশিনীর মর্ত্যে আগমন। এবার মাতৃরূপী দেবী দুর্গা এসেছেন দোলায়। পূজার পরে মা যাবেন গজে। করোনার প্রতিকূলতার মধ্যে দুর্গাপূজা হচ্ছে। ভক্তরা অঞ্জলি দেবেন। মায়ের আরতি হবে। ভক্তদের প্রত্যাশা, পৃথিবী হবে আবার দুর্গতিমুক্ত।
৭০ বছর আগের ১৯৫০ সালের দুর্গাপূজার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। তেওতার জমিদারদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল দু–তিন শ বছরের। মানিকগঞ্জ জেলা (তখন মহকুমা) প্রথম মাধ্যমিক স্কুল তেওতা একাডেমি ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তেওতার জমিদার হরশংকর রায় ও পার্বতীশংকর রায় তাঁদের বাড়ির পাশেই। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে একজন শিক্ষক ছিলেন আমার দাদা সৈয়দ জিয়াউদ্দিন মোহাম্মদ ইউসুফ। ওই পরিবারের কৃতী সন্তান কংগ্রেস নেতা কিরণশংকর রায় তাঁর ছাত্র ছিলেন। আমার আব্বা ছিলেন তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র। ১৯৪৭-এর পর কিরণশংকর পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে ছিলেন প্রথম বিরোধীদলীয় নেতা। পরে ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন।
জমিদারবাড়ির মন্দিরটি ছিল এক অসামান্য স্থাপত্য। সেখানে জীবনে প্রথম প্রতিমা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর নাটমন্দিরে প্রথম দেখি নাট্যাভিনয়। সে কী আয়োজন! কিন্তু আব্বার কাছে শুনেছি, সেই বছরই সবচেয়ে কম আনন্দ–উৎসব হয়। কারণ, দেশভাগ ও কিছুদিন আগে কিরণশংকরের আকস্মিক মৃত্যু।
জমিদারবাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপূজার বাইরে সাধারণ হিন্দুপাড়ার পূজাও দেখেছি। পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চোখ ছিল হিন্দুদের জমিজমার প্রতি, কিন্তু দুর্গাপূজা উদ্যাপনে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তখন মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তবু হিন্দুপ্রধান সব গ্রামেই প্রতিমা স্থাপন ও পূজা হতো। গ্রামের দিকে কয়েক দিনব্যাপী হতো সার্কাস, নাটক ও যাত্রানুষ্ঠান। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দেশে বহু যাত্রা পার্টি ছিল। ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মন্দির ও সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের পরে সবচেয়ে বেশি অানন্দ–উৎসব হতো তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারে। ১৯৬৯-এ এক বন্ধুর সঙ্গে পূজার সময় চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। দেখেছি পাড়ায় পাড়ায় বিপুল আয়োজন। তাতে সব ধর্মের মানুষেরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
আগে পারিবারিক পূজাই বেশি হতো, বারোয়ারি দুর্গাপূজা হতো কম। গতবার ৩২ হাজার মন্দিরে পূজা হয়েছিল। এবার করোনার কারণে সম্ভবত কম হয়েছে। সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি মানার কারণে আনন্দও অন্যবারের মতো হলো না।
১৯৩৯ সালে নজরুল দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিজয়া শীর্ষক একটি গীতিনাট্য আকাশবাণী থেকে প্রচার করেন। ‘নাটমন্দির থেকে সানাই-এর করুণ সুর’-এর সঙ্গে নারী ও পুরুষের সমবেত কণ্ঠে গীত হয়েছিল, ‘বিজয়োৎসব ফুরাইল মাগো/ ফিরে আয় ফিরে আয়।/ মা আনন্দিনী গিরিনন্দিনী/ শিবলোকে অমরায়।’
পূজায় ভক্তের প্রার্থনা শুধু নিজের জন্য নয়, সবার মঙ্গল কামনা করে তার প্রার্থনা। গীতিনাট্যে সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত শেষ সংগীতটিতে প্রকাশ পেয়েছিল নজরুলীয় জীবনদর্শন। সেটা দিয়েই শেষ করি: ‘এবার নবীন মন্ত্রে হবে/ জননী তোর উদ্বোধন।/ নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে/ হবে না তোর বিসর্জন।/ মোরা এক জননীর সন্তান সব, জানি/ ভাঙব দেয়াল, ভুলব হানাহানি,/ দীন দরিদ্র রইবে না কেউ/ সমান হবে সর্বজন/ বিশ্ব হবে মহা-ভারত/ নিত্য-প্রেমের বৃন্দাবন।’
সবার প্রতি শারদীয় শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।