রিকশাচিত্র এখন
ঢাকা শহর মানে রিকশা। রিকশার এই টুংটাং ঘণ্টা আর রঙের উজ্জ্বলতা রাস্তাঘাটের সৌন্দর্যও বটে। এখানে বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকা হয়ে থাকে। যেমন পশুপাখি, নায়ক–নায়িকা, সিনেমার পোস্টার, মুক্তিযুদ্ধের ছবি ইত্যাদি।
অন্দরসজ্জায় যেন হঠাৎ করেই রঙিন নকশা কথা বলে উঠছে। চিত্রকরদের মতে, রিকশাচিত্রের টান বা আঁচড়গুলো খুবই সাবলীল, প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট এবং ছোট ছোট ও নিখুঁত।রিকশাচিত্রের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করা। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন বা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ছবি আঁকেন। ইদানীং ঢাকার রিকশা পেইন্টার—যাঁরা এখন সক্রিয়, তাঁরা মূলত বিদেশি ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। শুধু বিদেশিদের জন্য ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন। হাতে আঁকা রিকশাচিত্রের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম দামি স্ক্রিন প্রিন্টের পেইন্টিংয়ের ব্যবহার এবং বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা ছাড়াও নানা কারণে রিকশাচিত্র হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ডিজিটাল প্রিন্ট চলে আসার কারণে শিল্পীর তুলিতে ফুল–লতাপাতার বদলে রিকশামালিকেরা গ্রহণ করলেন কম খরচে, স্বল্প সময়ে পাওয়া এই উপকরণ। এই অবস্থায় শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্র কমে গেল, এমনকি শিল্পীদের মনের ক্ষুধাও যখন পূরণ হলো না, তখন তাঁরা কাজের অন্য মাধ্যম খুঁজতে লাগলেন। রিকশা পেইন্টারদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিল্পীসমাজও ভাবতে লাগল, কীভাবে এই শিল্পের চর্চা অব্যাহত থাকবে। তখন রিকশা পেইন্টিং (চলমান একটি পেইন্টিং, কারণ এটি রিকশায় করে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়) জায়গা করে নিল অন্দরে—আমাদের সোফায়, পর্দায়, ফুলদানিতে।
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর চারুশিল্পের ইতিহাসেও রিকশা পেইন্টিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এই শিল্প আর শুধু রিকশার গায়েই সীমাবদ্ধ নেই, রিকশা পেইন্টারদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পীদের যৌথ প্রদর্শনীও হচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর কাজেও রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিদেশ থেকে কোনো শিল্পরসিক এলে রিকশা আর্টেই বাংলাদেশকে খুঁজে পান, আমাদের শিল্পকৌশলের হদিস পান। আমাদের দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি এই রিকশা পেইন্টিং ভীষণ রঙিন। আমরা রং পছন্দ করি, আমরা রং গায়ে মাখি, মানে আমরা রঙিন কাপড় পরতে পছন্দ করি, এমনকি রঙিন নকশার এই ছোঁয়া চলে আসছে আমাদের ঘরেও। বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিসের ওপর রিকশার নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। যাঁরা একটু রঙিন করে ঘর সাজাতে পছন্দ করেন, তাঁরা অনেকেই এ ধরনের জিনিস ব্যবহার করছেন। ফুলের টব, চেয়ার, টেবিল, আসবাব, চায়ের কাপ, ট্রে—সবকিছুতেই রিকশা পেইন্টিং নিয়ে কাজ করছেন ডিজাইনাররা। মাঝেমধ্যে ঘরের দেয়াল ও ক্যানভাস হয়ে উঠছে রিকশা পেইন্টারদের।
অন্দরসজ্জায় যেন হঠাৎ করেই রঙিন নকশা কথা বলে উঠছে। চিত্রকরদের মতে, রিকশাচিত্রের টান বা আঁচড়গুলো খুবই সাবলীল, প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট এবং ছোট ছোট ও নিখুঁত। অথচ এই বিশেষ চিত্রকলার জন্য নেই কোনো আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, একেবারে দেশজ কুটিরশিল্পের মতোই শিল্পীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে শিখে থাকেন এই চিত্রশিল্প এবং নিজের কল্পনা থেকেই আঁকেন এসব। রিকশা পেইন্টাররা যেসব মোটিফ ব্যবহার করেন, তার মধ্যে ফুল, লতা–পাতা, ময়ূর, শাপলা, পদ্ম, চোখ, মানুষের মুখ—যা–ই আঁকুন না কেন, তাঁদের যে রেখার টান, কাটা কাটা রঙের ব্যবহার, অর্থাৎ কন্ট্রাস্ট রঙের আধিক্য অবলীলায় তাঁরা ব্যবহার করে যাচ্ছেন বেশ ভারসাম্য বজায় রেখে। এটা একেবারেই তাঁদের নিজস্ব ধরন। পাখি বা ফুল–লতাপাতাকে যখন তাঁরা প্লাস্টিক কাটআউট করে বের করছেন কিংবা ঝালরের মধ্যে সোনালি–রুপালি রঙের ব্যবহার—সবকিছু মিলিয়ে এটা এত পূর্ণাঙ্গভাবে দাঁড়ায় যে একে আলাদা মনে হয় না। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাঁদের এই সহজ–সরল মোটিফ, রঙের ব্যবহার পরিপূর্ণভাবে আমাদের ব্যবহারিক জিনিসের সঙ্গে মানিয়ে যায়। ফুল–লতাপাতার যে ড্রয়িং, তা পোশাক অলংকরণে সহজে মানিয়ে যায়। তাই ফ্যাশন নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা অবলীলায় এসব মোটিফ ব্যবহার করেন স্বাচ্ছন্দ্যে। এমনকি ঝালর কেটে যে ধরনের কাজ রিকশাশিল্পীরা করে থাকেন, একই ধরনের কাজ পোশাকেও ফুটে ওঠে এপ্লিকের মাধ্যমে।
দেশীয় অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ড রিকশা পেইন্টিং নিয়ে কাজ করছেন পোশাকের ক্যানভাসে। রংবেরঙের ডিজাইনে রিকশা পেইন্টের মোটিফ ভিন্নতা পাচ্ছে ডিজাইনারদের মুনশিয়ানাতে। এই শিল্পীদের আঁকা, গড়া বা এই যে রূপ নির্মাণ—এর মধ্যে যে সহজতাটা আছে, তা ভীষণভাবে গ্রহণ করছে মানুষ। মাঝখানে একটা সময় রিকশার গা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল এই চিত্রকলা। ফ্যাশন শুধু পোশাকেই নয়, তৈজসপত্রে, অন্দরসজ্জায়, এমনকি যানবাহনেও চির–আবর্তনশীল। তাই আবার ফিরে এসেছে রিকশা অঙ্কন এবং আরও ব্যাপক আকারে। ধীরে ধীরে আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প এর ব্যতিক্রমী রংচঙা বৈশিষ্ট্যের কারণেই বৈচিত্র্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছে।
ঊর্মিলা শুক্লা : ডিজাইনার